• facebook
  • twitter
Monday, 23 December, 2024

নবরূপে আরাধনা-মা দুর্গাকে

দুর্গা পুজোর অষ্টম দিনে মা মহাগৌরীর পুজা হয়। এর শক্তি অমোঘ ও সদ্য ফলদায়িনী। এর উপাসনা করলে ভক্তের সকল কলুষ নাশ হয়, পূর্বের কৃত পাপ নষ্ট হয়ে সর্বপ্রকার পবিত্র ও অক্ষয় পূর্ণের অধিকারী হন।

নবরাত্রি ব্রত হল ৯ দিন উপবাস করে দুর্গাপুজোর ধর্মীয় অনুষ্ঠান শরৎকালে আশ্বিনের শুক্লপক্ষের প্রতিপদ থেকে শুক্লনবমী পর্যন্ত এই নয় দিন ধরে নবরাত্রি ব্রত পালন করে থাকে মারোয়াড়ি সম্প্রদায়ের ধর্মপ্রাণ মানুষেরা পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে। এই সময় মা দুর্গাকে নয়টি বিশেষ রূপে আরাধনা করা হয়। দেবীর এই নয়টি রূপই ‘নবদুর্গা নামে পরিচিত?
নবরাত্রি
শৈলপুত্রী, ব্রহ্মচারিণী, চন্দ্রঘণ্টা, কুস্মান্ডা, স্কন্দমাতা, কাত্যায়ণী, কালারাত্রি, মহাগৌরী, সিদ্ধিদাত্রী,
শৈলপুত্রী: নবদুর্গার প্রথম রূপ। পূর্বজন্মে তিনি সতী নামে প্রজাপতি দক্ষরাজের কন্যা ছিলেন। দেবাদিদেব মহাদেবের সঙ্গে তাঁর পরিণয় হয়। দক্ষরাজ এক মহাযজ্ঞে শঙ্করকে বাদ দিয়ে সমগ্র দেবতাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন! সতী বিনা আমন্ত্রণে বাবার বাড়িতে যজ্ঞস্থলে এসে হাজির হলে পিতার মুখে অপমান জনক কথাবার্তা ও সকলের সামনে স্বামীর বহুবিধ নিন্দাজাতীয় কথাবর্তা শুনে মর্মাহত হন ও যোগাগ্নি দ্বারা নিজ দেহ ভষ্মীভূত করেছিলেন। মহাদেব ধ্যানে সব জানতে পেরে প্রচণ্ড ভাবে রাগবশত বীরভদ্র নামে এক মহাসূরকে ওই যজ্ঞস্থানে পাঠিয়ে দক্ষযজ্ঞ ধ্বংস করেন ও দক্ষের মুণ্ডু ছেদ করে ছাগমুণ্ড স্থাপন করেছিলেন। পরজন্মে সতী শৈলপুত্রী নামে হিমালয়ের কন্যা রূপে জন্মগ্রহণ ও ভগবান শঙ্করকে বিবাহ করেছিলেন। মা বৃষভবাহনা, তাঁর ডান হাতে ত্রিশূল ও বাঁহাতে কমলপুষ্প, মা অন্তর শক্তির আধার। শৈলপুত্রী দুর্গার মহত্ত্বও শান্তি অনন্দ, নবরাত্রি পুজার প্রথম দিন থেকেই পুজোও আরাধনা করা হয়। প্রথম দিনের পুজোয় যোগী তাঁর মনকে ‘মূলাধার’ চক্রে স্থিত করেন ও যোগ সাধনার শুরু হয় এখান থেকেই।
দেবীর ভোগ—গরুর দুধের ঘি, রাশি—মেষ, বৃশ্চিক।
ব্রহ্মচারিণী: মায়ের নবশক্তির দ্বিতীয় শক্তি ব্রহ্মচারিণী, বহ্ম শব্দের অর্থ তপস্যা, ব্রহ্মচারিণী অর্থহল ‘তপস্যা আচরণ কারিণী।’
হিমালয়ের কন্যারূপে সতী ভগবান শঙ্করকে পতিরূপে পাবার জন্য হাজার-হাজার বছর অনাহারে কঠিন তপস্যা করেন এবং শেষে পতিরূপে ভগবান শঙ্করকে লাভ করেছিলেন।
তেজজ্যোতিতে পূর্ণদেবী ব্রহ্মচারিণীর ডানহাতে জপের মালা ও বাঁ-হাতে কমন্ডল।
দুর্গাপূজার দ্বিতীয় দিনে এই শক্তিরূপে মায়ের আরাধনা করা হয়। তাঁর আরাধনায় সাধকের মনে পবিত্রতা, সদাচার, সংযম বৃদ্ধি পায়। দেবীর কৃপায় সাধন সর্বত্র সর্বসিদ্ধি ও বিজয় প্রাপ্ত হয়। এ দিন সাধকের মন ‘স্বাধিষ্ঠান’ চক্রে স্থিত হয়। এই চক্রে কিত প্রতিষ্ঠিত যোগী তাঁর কৃপা ও ভক্তি লাভ করে।
দেবীর ভোগ—চিনি। রাশি—তুলা।
চন্দ্রঘণ্টা: মা দুর্গার নবশক্তির তৃতীয় রূপ চন্দ্রঘণ্টা, দেবীর মস্তকে ঘণ্টার মতো অর্ধচন্দ্র শোভা পায় তাই মায়ের নাম চন্দ্রঘণ্টা মা তাঁর ঘণ্টার মতো চন্দ্রধ্বনিতে দুরাচারী রাক্ষস-দৈত্য ও দানবদের দমন করেন।
মা দশভূজা এবং দশহাতে নানাবিধ অস্ত্র সুসজ্জিত আছে। দেবীর গাত্র স্বর্গের মতো এবং বাহন হল সিংহ।
দুর্গাপূজার তৃতীয় দিনে মায়ের আরাধনা করা হয়। এতে সাধকের সমস্ত পাপ ও বিঘ্ন নাশ হয়, সাহসী, নগ্নতা ও কণ্ঠস্বর মিষ্টতা প্রাপ্তি হয়। এইদিন সাধকের মন ‘মণিপুর’ চক্রে প্রবিষ্ট হয় ফলে সাধকের অলৌকিক বস্তুর দর্শন হয় এবং দিব্য সুগন্ধীর অনুভব হয় এবং নানারকম দিব্য ধ্বনি শোনা যায়।
দেবীর ভোগ—দুধ ও চিনি (দুধে সামান্য চিনি মিশিয়ে নিতে হয়)। রাশি কন্যা, মিথুন।
কুস্মণ্ডা: মায়ের নবশক্তির চতুর্থ রূপ কুস্মণ্ডা। আন্তমে এই জগৎ প্রাণহীন ও অন্ধকারাছন্ন ছিল। তখন দেবীর ঈষৎ হাসির ফলে এই চরাচর জগৎ সংসার সৃষ্টি হয়। তাই দেবীর নাম কুস্মাণ্ডা। দেবীর দেবীর দেহকান্তি সূর্যের মতো দীপ্তমান এবং ইনি সূর্যমণ্ডলের অন্তরালে অবস্থান করেন। ফলে দেবীর দেহ নির্গত তেজ শক্তি ব্রহ্মাণ্ডের সকল প্রাণীর মধ্যে সতত সঞ্চারিত হতে থাকে।
দেবী অষ্টভূজা, সিংহবাহিনী, তিনি সাত হাতে যথাক্রমে— কমণ্ডুল, ধনুক, তীর, পদ্মপুষ্প, অমৃতপূর্ণ-কলসী, চক্র ও গদা ধারণ করে আছেন এবং অষ্টম হাতে রয়েছে সিদ্ধি প্রদানকারী জপমালা। দেবীর পূজায় কুমড়ো বলি দিলে-মা-অতিশয় সন্তুষ্ট হন। দুর্গা পুজোর চতুর্থ দিনে মায়ের আরাধনা করা হয় ফলে মায়ের ভক্তের কোনও রোগ, শোক, থাকে না ও মায়ের কৃপায় সাধক আয়ু-সুখ-যশ, শক্তিবৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়।
এদিন সাধকের মন ‘অনাহত’ চক্রে অবস্থান করে। তাই এই দিন অত্যন্ত পবিত্র ও অচঞ্চল মনে মায়ের ধ্যান করা উচিত।
দেবীর ভোগ—মালপোয়া। রাশি ধনু।
স্কন্ধমাতা: মা দুর্গার নবশক্তির পঞ্চম রূপ হল স্কন্ধমাতা। স্কন্ধ ভগবান কর্তিকের অপর নাম। স্কন্ধমাতা তাই মা দুর্গার নাম স্কন্ধমাতা।
দেবী সূর্যমণ্ডলের অধিষ্ঠাত্রী গওয়ায় তাঁর ভক্তদের শরীরে এক দিব্যজ্যোতি ও সৌম্যকান্তির প্রকাশ দেখা যায়। মা দুর্গার সিংহবাহিনী আবার কখনও কখনও পদ্মের ওপর অবস্থিত দেবী চতুর্ভুজা। তিনি একহাতে বালক স্কন্ধকে কোলে নিয়ে আছেন, অন্য দু-হাতে পদ্ম এবং অপর হাতে মা সকলকে আশীর্বাদ দান করছেন।
নবরাত্রির পঞ্চম দিনে স্কন্ধ মাতার আরাধনা করা হয় এবং একই সঙ্গে বালক স্কন্ধের ও পুজা হয়। এই পুজার ফলে ভক্তের সমস্ত কামনা বাসনা সফল হয়।
এদিন সাধকের মন বিশুদ্ধ চক্রে অবস্থান করে।
দেবীর ভোগ—কলা। রাশি-কুম্ভ।
তিনি একহাতে বালক স্কন্ধকে কোলে নিয়ে আছেন, অন্য দু-হাতে পদ্ম এবং অপর হাাতে মা সকলকে আশীর্বাদ দান করছেন।
কাত্যায়ণী: নবদুর্গার ৬ রূপ কাত্যায়ণী। মহর্ষি কতের পুত্র হলেন কাত্য। কাত্যেগোত্রে বিখ্যাত কাত্যায়ন ঋষি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বহু তপস্যার পর মা-ভগবতীকে নিজ কন্যারূপে পান। মহিষাসুরের অত্যাচারে দেবতারা পরাজিত ও স্বর্গচ্যুত হলে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর নিজ-নিজ তেজদ্বারা দেবীমূর্তি করলেন মহিষাসুরকে নিধনের জন্য। ঋষি কাত্যায়ন সর্বপ্রথম এই দেবীমূর্তির পূজা করেন এই কারণেই দেবীর নাম কাত্যায়ণী।
দেবীর গাত্র স্বর্গের ন্যায় দীপ্তমান। মা চতুর্ভূজা ও সিংহবাহনা মায়ের ডান হাতে অভয়মুদ্রা ও বরমুদ্রা প্রদান করছেন আর বাঁ হাতে অসি ও পদ্মপুষ্প ধারণ করে আছেন। ব্রজের গোপিনীরা শ্রীকৃষ্ণকে স্বামীরূপে পাওয়ার জন্য দেবী কাত্যায়ণীর আরাধনা করেন।
দুর্গা পূজার ষষ্ঠ দিনে মায়ের পুজা হয়। এ দিন সাধকের মন ‘আজ্ঞাচক্রে’ স্থিত হয়, ফলে সাধক মায়ের চরণে সর্বস্ব নিবেদন করে ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ হতে মূর্তি লাভ করে।
দেবীর ভোগ—মধু। রাশি-মকর।
কালরাত্রি: দেবীর নবশক্তির সপ্তম রূপ কালরাত্রি।
মায়ের গায়ের রং ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, মাথার কেশ বিধ্বস্ত এবং কন্ঠে বিদ্যুৎ রশ্মির মতো উজ্জ্বল মালা, তাঁর গোলাকার চক্ষুত্রয় সর্বদা ভীষণ তেজরশ্মি ও শ্বাস-প্রশ্বাস হতে ভয়ংকর অগ্নি-নির্গত হয়। মা চতুর্ভূজা, তাঁর বাহন গর্ধভ। মা ডান হাতে যথাক্রমে বরমুদ্রা ও খড়্গ। মায়ের রূপাকৃতি ভয়ঙ্কর হলেও সর্বদা শুভফল প্রদান করেন তাই মায়ের আরেক নাম ‘শুভঙ্করী’।
দুর্গা পুজার সপ্তম রাত্রিতে মায়ের পূজা হয়, এ দিন সাধকের মন ‘সহস্রার’ চক্রে অবস্থান করে ফলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল সিদ্ধির দ্বার অবারিত হয়ে যায় এবং সাধক মহাপূণ্যের ভাগী হন।
দেবীর ভোগ—আখের গুড়। রাশি-সিংহ।
মহাগৌরী: মায়ের নবশক্তির অষ্টম রূপ মা মহাগৌরী। ভগবান শঙ্করকে পতিরূপে পাওয়ার জন্য দেবী ভগবতী বহু বছর কঠোর তপস্যা করায় মায়ের গাত্রবর্ণ ঘোর কৃষ্ণবর্ণ হয়ে যায়। এরপর তপস্যায় প্রসন্ন হয়ে দেবাদিদেব মা ভগবতীকে গঙ্গায় স্থান করান স্থানান্তে দেবীর গাত্র পুনরায় গৌরবর্ণ ও দীপ্তমান হয়। সেই থেকে মায়ের নাম হল হরগৌরী।
মায়ের গাত্রবর্ণ শঙ্খ বা চন্দ্রের মতো শুভ্র। মায়ের পরিধান বস্ত্র ও অলঙ্কার সমূহ শুভ্র। মা বৃষবাহনা ও চতুর্ভূজা। তাঁর ডান হাতে যথাক্রমে ত্রিশূল অভয় মুদ্রা এবং বাঁ হাতে ডমরু করমুদ্রা।
দুর্গা পুজোর অষ্টম দিনে মা মহাগৌরীর পুজা হয়। এর শক্তি অমোঘ ও সদ্য ফলদায়িনী। এর উপাসনা করলে ভক্তের সকল কলুষ নাশ হয়, পূর্বের কৃত পাপ নষ্ট হয়ে সর্বপ্রকার পবিত্র ও অক্ষয় পূর্ণের অধিকারী হন।
দেবীর ভোগ—ছোলা, হালুয়া। রাশি-বৃষ।
সিদ্ধিদাত্রী: মা দুর্গার নবশক্তির নবম রূপ হল সিদ্ধিদাত্রী। মা সাধককে সমস্ত রকমের সিদ্ধি প্রদান করেন।
ভগবান শঙ্কর দেবীর কৃপায় সর্বসিদ্ধ লাভ করেন। এবং তাঁর অনুগ্রহেই শঙ্করের অর্থ শরীর দেবীর হয়েছিল। তাই তিনি ধরণীতে অর্ধনারীশ্বর নামে খ্যাত।
মা সিদ্ধিদাত্রী পদ্মসনা অষ্টভূজা, কখনও বা তিনি সিংহবাহনা। মায়ের ডান দিকের হাতে যথাক্রমে চক্র, তরোয়াল, ত্রিশূল ও অভয়মুদ্রা এবং বাঁহাতে যথাক্রমে পদ্ম, গদা, ধনুক ও শঙ্খ।
নবরাত্রির ৯ দিনে মা সিদ্ধিদাত্রীর নবম দিনে মা সিদ্ধিদাত্রীর পুজো করা হয়। সাধক ঐ দিনে পূর্ণ নিষ্ঠার সঙ্গে পুজো করলে তার সকল সিদ্ধি প্রাপ্ত হয় ও ভক্তের সর্বপ্রকার কামনা পূরণ হয়।
দেবীর ভোগ—পায়েস। রাশি-কর্কট, মীন।
শ্রী শ্রী দুর্গা দেবীর তত্ত্ব
দুর্গো দৈত্যে মহা বিঘ্নে ভব বন্ধে কুকমনি।
শোকে দুঃখে চ নরকে যমদণ্ডে চ জন্মানি।।
মহাভয়ে হতিরোগে চাপ্যাশব্দে হন্তবাচক।
এতান হন্ত্যেব যা দেবী সা দুর্গা পরিকীর্তিতা।
দুর্গা শব্দের অর্থ দুর্গা নামক দৈত্য, মহাবিঘ্ন,
কুকার্য, শোক, দুঃখ, নরক, যমদণ্ডে জন্ম, মহাভয় ও অত্যন্ত
ব্যধি। অ শব্দের অর্থ হন্তা বা নাশক। অর্থাৎ দৈত্য,
বিঘ্ন প্রভৃতিকে যিনি নাশ করেন তিনিই দুর্গা।