• facebook
  • twitter
Sunday, 22 September, 2024

দেরাজ

তিনি কে? আমিই বা কে? আর মাথা কাজ করছিলো না। ধপ করে মাটিতেই বসে পড়লাম। তবে কি চাবির গোছাখানা সত্যিই হারিয়ে গেছে, না গোপন রহস্য গোপনে রাখার জন্যেই তাকে ইচ্ছাকৃত ভাবেই কোথাও নির্বাসন দেওয়া হয়েছে?

আমাদের বাড়িটা পুরনো দিনের, বয়স তাও বছর ৮০ তো হবেই! মধ্য কলকাতার পুরনো আমলের বাড়িগুলো যেমন হয়, গঠন তেমনই। সদর দরজা দিয়ে ঢুকে সামনে মস্ত উঠোন, একধারে কলপাড়, একটা তুলসিতলা। তার চারপাশে উঠে গেছে বারান্দা আর সারি দেওয়া ঘর। সেখানে আবার কী বৈঠকখানা, কী নিরামিষ-আঁশ রান্নাঘর সবই বিদ্যমান। অনেককাল অবধি বাড়িটা একতলাই ছিল। তারপর উত্তরাধিকার- কূলের স্থান সংকুলান করতে না পেরে আমার ঠাকুরদাই বছর কুড়ি আগে দোতলাটি তোলেন। তবে শুধু বাড়ির বাসিন্দাদেরই মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের অভাব ঘটত, এমনটা নয়; হরিনাভি থেকে বাবার খুড়তুতো দাদার ডাক্তার দেখানোর দরকার হোক, বা নলহাটীর মামাতো বোনের কলকাতার কলেজে ভর্তি হওয়া, সবারই বিনা পয়সার পান্থনিবাস বলতে কলকাতায় বাড়ি ছিল এই একটিই। পুরো বাড়িতে ঘরসংখ্যা নেহাত কম নয়, সর্বসাকুল্যে ২০-২২টা তো হবেই। তাও সবার ভাগে শিকে ছিঁড়েছিল একটা কি বড়জোর দুটো করে। ছাদ একদম পাশের বাড়ির ছাদের সঙ্গে লাগানো, ছোটবেলায় ঘুড়ি ওড়ানোর সময় এটা একটা মস্ত বড় সুবিধার ব্যাপার ছিল। যাক, সেই যৌথ পরিবারের মস্ত বড় বড় কড়া, হাঁড়ি বিভক্ত হতে হতে অনু, পরমাণুতে এসে ঠেকে এখন প্রকৃতিতে বিলীন হয়ে গেছে। অর্থাৎ, পরিবার থেকে বেশিরভাগ সদস্যই ‘বার’ হয়ে গেছে নিজেদের আলাদা গড়া আস্তানায়। এখন ‘পড়ি’ রয়েছি একমাত্র আমরা ৫-৬ জন।
এবার আমার পরিচয়তে আসা যাক। আমার নাম প্রদীপ চৌধুরী, আক্ষরিক অর্থেই চৌধুরী বংশের শেষ প্রদীপ। জিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়াতে কর্মরত, তাই সারা বছরই দেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ছুটে বেড়াতে হয়। আমার দুই কন্যা। একজন বিবাহিত আর অন্যজন কলেজে পাঠরতা। আমার গিন্নির পক্ষে শুধু একজন রাতদিনের লোক, আর একঘর ভাড়াটের ভরসায় এই এতবড় বাড়িতে বসবাস করা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে, এ অভিযোগ তার বহুদিনের। অভিযোগটি অবশ্য খুব অসঙ্গত নয়, আমার পক্ষেও এই হাতি পোষার খরচা বহন করা দিন দিন দুষ্কর হয়ে উঠছে। তাই প্রথমে বেশ কিছু প্রোমোটারকে খালি হাতে ফেরালেও শেষ পর্যন্ত হালের রীতি মেনেই বাড়ি ভেঙে খণ্ড খণ্ড ফ্ল্যাটে বিভক্ত করতে সায় দিতে বাধ্য হলাম।
সিংহভাগ ঘর তালাবন্দি হয়েই পড়েছিলো, ঘরের মালিকরা বেশীরভাগই হিসাব নিকেশের ঊর্ধ্বে, হাতেগোনা যে ক’জন বেঁচে রয়েছে তারা নিজেদের প্রাপ্য টাকাটুকু বুঝে নিয়েই খালাস। এই ভূতুড়ে বাড়ির প্রতি কারোরই আর তেমন মায়া-মমতা অবশিষ্ট নেই। সব আয়োজন সম্পূর্ণ। এখন শুধু চলছে পুরনো আসবাবপত্র বিক্রির পালা। সবাই যাবার সময় নিজেদের আসবাব নিয়েই গেছে, তাও এদিক ওদিক কুড়িয়ে বাড়িয়ে যা পড়ে আছে, তার দামও নেহাত কম হবে না; পুরনো দিনের খাঁটি জিনিস বলে কথা। তাও প্রায় সবকাজই শেষের পথে। শুধু বাধ সাধল পুরনো দিনের একটা কালো দেরাজ আলমারি।
একতলার একদম শেষ প্রান্তে ছিল ভাঁড়ার ঘর। সেখানে প্রথম দিকে রান্নার উপকরণ থাকলেও পরে সেটি রূপান্তরিত হয় গুদাম ঘরে। ছোটবেলায় এই ঘরটিই ছিল আমাদের প্যান্ডরা’জ বক্স। ভাঙা সাইকেল থেকে চোখ পিটপিট পুতুল, লাফিং বুদ্ধ থেকে উঠতি বয়সের সিগারেটের লাইটার, সবকিছুর মুশকিল আসান ছিল এই ঘরটা। শুধু তাই নয়, বাবা-কাকাদের ছোটবেলার জামা-সোয়েটার, বই-খাতাও পরম মমতায় ঠাকুমা আগলে রাখতেন এই ঘরেই। আমরা মজা করে বলতাম, খুঁজলে ভগবানকেও বোধয় পাওয়া যাবে এ ঘরে। খালি দেরাজের চাবিটা সযত্নে ঠাকুমার আঁচলের চাবির গোছায় বাঁধা থাকতো। দেরাজ খোলার অনুমতি কখনো কাউকে দেওয়া হতো না। খালি ঠাকুরদাকে মাঝে মধ্যে খুলতে দেখেছি ঠাকুমার থেকে চাবি চেয়ে। কাজ মিটে গেলে চাবি আবার ফিরে যেত সস্থানে। এখন এই দেরাজ আলমারিটাকে নিয়েই হল সমস্যা। ঠিকেদার এসে জানালো, ‘এ বড্ড ভারী বাবু, ভেতরের জিনিস না বের করলে আমরা ৩-৪ জন মিলেও টানতে পারছি না। আবার এখানে ভাঙাও সম্ভব নয়।’ কিন্তু খুলবো কীভাবে? ঠাকুমা গত হবার পর সেই চাবির গোছাও কালের নিয়মে কোথায় হারিয়ে গেছে, সত্যি বলতে কখনো খুঁজেও আর দেখা হয়নি। অগত্যা ডেকে আনা হল চাবিওয়ালাকে। সে আধবেলার কসরতের পর অবশেষে সফল হল তিন পুরুষের মরচে ধরা তালা খুলতে। আর আমার সামনে প্রথমবারের জন্য উন্মোচিত হল তার দ্বার। কেন জানি না বুকের ভিতর অনুভব করলাম একটা মৃদু দ্রিম-দ্রিম শব্দ। যা আমার পূর্বপুরুষ দ্বারা এতকাল সযত্নে ছিল রক্ষিত, এমনকি যা খোলার অধিকার উত্তরাধিকার সুত্রেও কেউ পায়নি, সেখানে আমি অনুপ্রবেশ করে ফেলছি না তো? কিন্তু এই পরিস্থিতিতে তো আমার সামনে আর কোনও পথ খোলা নেই। সেদিনের মত লোকজনকে বিদায় দিলাম। ঠিক করলাম, এর সামনে দাঁড়াতে হবে আমাকে, একা। আর তার জন্য চাই অবসর।
দুপুরে খাবার পালা তাড়াতাড়ি চুকিয়ে আবার দাঁড়ালাম আমি, তার সম্মুখে।
প্রথমে চোখে পড়লো একটা পাগড়ি, মাথায় যে পাথরটি বসানো আলোর স্বাদ পেতেই সেটা থেকে ঠিকরে বেরচ্ছে নীল রঙের রশ্মি। নীলা! আমাদের পূর্বপুরুষের কেউ নবাব আমলের সুবেদার গোছের কিছু ছিলেন বলে শুনেছি। তবে কি তাঁর সম্পত্তিই হাত বদল হয়ে এতদূর এসেছিলো? পাশেই রয়েছে একটি হাতির দাঁতের বাক্স, তাতেও বেশ কিছু ছোটবড় মূল্যবান সামগ্রী, যাদের বিগত কয়েক শতক হয়ত এই কয়েদখানার বাইরে আসার সৌভাগ্য হয়নি। ওই তাকেই রয়েছে একতাড়া দলিল গোছের কিছু কাগজ, তবে সেই আমলের কতশত হতভাগ্যের জমি-জমার অন্তিম পরিণতি যে এর ভেতর আছে, তা এত পুরনো হলদে, ফাটা কাগজ দেখে আর বোঝা সম্ভব নয়।
এর ঠিক ডানপাশের তাকটি অপেক্ষাকৃত বড় এবং ভিতরের দিকে প্রশস্ত। প্রথমেই তাক জুড়ে যার আবক্ষ পাথরের মূর্তিটি নজরে এলো, তাঁকে এতদিন ইতিহাসের বইয়ের পাতায় আমরা স্বদেশী আন্দোলনের অন্যতম জনক বলে জেনে এসেছি, শ্রী অরবিন্দ ঘোষ। কিন্তু এই মূর্তি যে ঋষি হবার অনেক আগে, তা মুখের গড়নেই সুস্পষ্ট। বিদ্যুৎ ঝলকের মতো মনে পড়ে গেল, আমার বড়ঠাকুরদা অর্থাৎ ঠাকুরদার একমাত্র সহোদর ভাইয়ের কথা, যাকে চোখে দেখার সৌভাগ্য কখনো না হলেও তিনি যে স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন, তা আমাদের কারোর অজানা নয়। ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে বড়ঠাকুরদার ছায়াসঙ্গী নন্দদাদু মাঝে মধ্যেই আসতেন। আর তাঁর মুখ থেকেই তাঁদের সব ভয়ানক কীর্তিকলাপের গল্প শুনতে শুনতে আমাদের ছোটদের গায়ে কাঁটা দিত। না, বড়ঠাকুরদা তাঁর বন্ধুর মতো বৃদ্ধ বয়স অবধি নাতি-নাতনিদের গল্প শোনানোর জন্য জীবিত থাকতে পারেননি। মাত্র সাতাশ বছর বয়সেই বাড়ি থেকে পালাতে গিয়ে ইংরেজদের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছিলো তাঁর শরীরটা। তার আগে বন্ধুর কাছে ছিল তাঁর শেষ অনুরোধ, তাঁর অবর্তমানে বৃদ্ধ বাবা-মা এবং অসহায় ভাইবোনদের তিনি দেখবেন। না, বন্ধু তাঁর কথার খেলাপ করেননি। জীবনের শেষ দিন অবধি নন্দদাদু এই পরিবারকে বুকে করে আগলে রেখেছিলেন।
মূর্তিটা একটু সরাতেই পিছন থেকে উঁকি মারল একটা ছোট ড্রয়ার। অন্ধকারে ভালো ঠাহর হচ্ছিলো না, তাই একটা দেশলাই জ্বেলে টান দিলাম তাতে। আর দেশলাইয়ের আলোয় মুহূর্তেই দম্ভের সঙ্গে যে ধাতব বস্তুটি নিজের অস্তিত্ব জানান দিলো তা দেখে এই বয়সেও আমার কপাল ঘেমে উঠলো। নিশ্চিত হতে বের করে নিয়ে এলাম বস্তুটা। একটা কোল্ট .৩২ অটোমেটিক পিস্তল। ঠিক তার পাশে একটা খোলের ভেতর নিকেল কোটেড ছ-ছটি গুলি, অব্যবহৃত। সেদিন পুলিশের অতর্কিত হানায় হয়ত বড়ঠাকুরদা এটা বের করার সময় পাননি, না হলে গল্পটা অন্যরকম হতে পারত, হয়ত! আবার এর গায়েই হয়ত লেখা আছে কত সাদা চামড়ার শেষ নিঃশ্বাসের গল্প, যা এতকাল ধরে সযত্নে রক্ষিত আছে এই দেরাজের দেওয়ালের ভেতর।
চোখ গেলো নিচের তাকে। পুরনো পোস্টকার্ডে লেখা কিছু চিঠি। প্রত্যেকটিরই প্রেরণ দিবস আজ থেকে বছর ৩৫-৪০ আগে এবং প্রেরকের ঠিকানা লালবাগ, মুর্শিদাবাদ। প্রেরকের নাম দেখে একটু নাড়া খেলাম আমি। সুধা মিত্র, আমার বড়পিসি। প্রতিটা চিঠিজুড়ে রয়েছে শ্বশুরবাড়িতে তাঁকে কী অকথ্য অত্যাচারের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে তার বর্ণনা, সেই সঙ্গে ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য কাতর আকুতি। আবছা মনে পড়লো এক সন্ধেবেলা, তখন আমি শৈশব পেরিয়ে কৈশোরের দিকে পা বাড়িয়েছি। বাবা, কাকারা কাজকর্ম থেকে ফেরার পর বৈঠকখানায় বসেছে এক গভীর আলোচনা। যদিও সেই সময় বড়দের আলোচনায় ঢোকার কোনও অধিকার আমাদের ছিলনা, তবু বাইরে ভাইবোনদের সঙ্গে লুডো খেলতে খেলতে কানে আসছিল কিছু টুকরো কথা; ঠাকুমার গলা— ‘সুধা ভালো নেই…।’
বাবার গলা— ‘আমার বোনটা ওখানে এত কষ্ট পাচ্ছে? আমি কালই নিয়ে আসব।’
তারপর ঠাকুরদার জলদ্গম্ভীর স্বর, ‘না। সমাজে আমার একটা মান-সম্মান আছে। শশধর চৌধুরীর মেয়ে বিয়ের পর শ্বশুরঘর না করতে পারলে লোকে কী বলবে? ওকে মানিয়ে নিতে হবে।’
না। গৃহকর্তার ওই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার সাহস তখন বাড়ির কারোর ছিল না। শেষপর্যন্ত বিবাহিত মেয়ের পক্ষে পুনরায় বাবার বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে ভিতরে ঢোকা আর সম্ভব হয়নি। এর কয়েকমাসের মধ্যেই বাড়িতে আসে একটা টেলিগ্রাম। ‘সুধা ইজ ডেড। অ্যাক্সিডেন্ট।’ রান্না করতে গিয়ে নাকি গায়ে আগুন ধরে যায়। কিন্তু এর পিছনের আসল সত্য যে কী, তা চিঠির অসহায় অক্ষরগুলো ছাড়া বোধয় আর কেউ জানে না।
এক একটা তাক যেন এক একটা ডাকবাক্স। ডাকছে আমায়। নিজের পরিবারের ডাক। হাত দিলাম সবার উপরের তাকে। এখানে একটা টিনের তোরঙ্গ, তালাবন্দি। এই তালা খুলতে অবশ্য আমাকে বেশি বেগ পেতে হলো না। সাঁড়াশির এক মোচড়েই খুলে গেলো বহুদিনের মরচে-ধরা ছোট্ট জিনিসটা। এর ভেতরে আরও দুটো বাক্স; একটায় আবারও ধাতব ঝিলিক, এবারেরটা অবশ্য সোনার। গলার, হাতের ও কানের মিলিয়ে যার ওজন অন্তত ভরি চারেক তো হবেই। অন্যটায় রয়েছে পুরনো আমলের কিছু টাকা, রানী ভিক্টোরিয়ার ছবি আঁকা। গুনে দেখলাম সব মিলিয়ে হাজার পাঁচেক। এটা মনে রাখতে হবে স্বাধীনতার আগের হাজার পাঁচেক, কিন্তু একেবারেই কম টাকা নয়। উপরে একটা লাল শালুতে মোড়া একটা চিঠি—
স্নেহের সুশীলা,
আশা করি কুশলে আছো। একটি বিশেষ অনুরোধ জানাতে তোমাকে এই চিঠি পাঠালাম। তুমি তো জানো আমার পুত্র মেক্সিকোতে বিজ্ঞান গবেষণা করতে গেছে আজ দু’বছর। কিছুদিন আগে সংবাদ পেলাম, সেখানে আমার পুত্রবধু একটি পুত্রসন্তান লাভ করেছে। তাই তাদের বিশেষ অনুরোধে আমি ও তোমার দাদাবাবু কয়েকমাসের জন্য সে দেশে গিয়ে বসবাস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেইমতো কাল বিকেলে আমরা জাহাজে করে রওনা দেব। তাই এই বিশ্বস্ত ছেলেটিকে দিয়ে কিছু অস্থাবর সম্পত্তি তোমার কাছে পাঠালাম। গচ্ছিত রাখো। দেশে ফিরে ফেরত নেব। আশা করি তোমার দিদির এই উপকারটুকু তুমি করবে। সবাই ভালো থেকো।
         আশীর্বাদপূর্বক,
বড়দিদি
সালটা ১৯৬৮। সম্পর্কে আমার ঠাকুমার দিদি। যতদুর মনে পড়ছে, ওখানে যাবার কিছুদিনের মধ্যেই মেসোদাদুর হার্ট ফেলিওর হয়। তারপর আর ওই ঠাকুমাও দেশে ফিরে আসেননি। নাতির টানে ওখানেই শেষবয়স পার করেন।
একদম কোণের দিকে হঠাৎই চোখ গেলো। এখানে একসঙ্গে রাখা দুটো খাম। একটা খিদিরপুর থেকে আসা। আর একটা সাঁওতাল পরগণা, বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্যের অন্তর্গত।
প্রথমটাই খুললাম। কোনও এক নাজিয়া সুলতানার লেখা। সুরজিত চৌধুরীকে উদ্দেশ করে। অর্থাৎ আমার ছোটকাকু। একটু ইতস্তত করে খুলেই ফেললাম চিঠিখানা।
প্রিয় সুরজিৎ,
নেহাত বিপদে পড়েই আজ চিঠি লিখলাম। কাল তোমার অফিসে গিয়েছিলাম। শুনলাম তুমি তিনদিন ধরে অসুস্থ, অফিস যাওনি। বাধ্য হয়ে বাড়ির ল্যান্ডলাইনে ফোন করলাম। কিন্তু ফোন ডেড বলছে। এদিকে আমার বাড়ির সঙ্গে আমি আর দ্বন্দ্বে পেরে উঠছি না। বাবা তাঁর সিদ্ধান্তে অনড়। কোনও হিন্দু ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে দেবে না। তাঁর কড়া হুকুম, আগামী রবিবার আমাদেরই জাতের এক ছেলে আমাকে দেখতে আসবে, এবং ওইদিনই পাকা কথাও বলে নেওয়া হবে। উনি আর একটুও দেরি করতে রাজি নন। কিন্তু সেই আর্ট কলেজে পড়ার সময়   আমরা যে পরস্পরকে কথা দিয়েছিলাম, যতই ঝড় আসুক, একসঙ্গে চলবো! এখন তা ভুলি কীকরে? চলো, আমরা দূরে কোথাও গিয়ে সংসার পাতি। চিঠি পেলে সত্বর যোগাযোগ করো।
          ইতি তোমার,
নাজিয়া
এরপরের বাড়িতে বয়ে যাওয়া ঝড়খানা মনে করতে আমাকে অবশ্য বেশি বেগ পেতে হয় না। তখন আমার মুখে সদ্য গোঁফের রেখা ফুটে উঠেছে, এসব বোঝার মতো যথেষ্ট বোধশক্তিও তৈরি হয়ে গেছে। চিঠিটা কোনোভাবে ঠাকুরদার হাতে পৌঁছয়, এবং একটি হিন্দু পরিবারও যে কোনও মুসলিম পরিবারের থেকে গোঁড়ামিতে এক চুলও কম নয়, সেই বোধ বোধহয় এই নাজিয়া সুলতানা নামক বোকা মেয়েটির ছিল না। এরপর ঠাকুমা রীতিমতো নিজের মাথায় হাত দিয়ে কাকুকে শপথ করিয়ে নেয়, ওই মেয়ের সঙ্গে আর কোনও যোগাযোগ সে রাখবে না, নাহলে তাঁর মরা মুখ দেখতে হবে। না, মায়ের জীবনের বিনিময় কাকু সুখী জীবন চাননি। তাই সেই জীবন বেছেও নেননি। কিন্তু নিজের জীবনের খাত তিনি অন্যপথে বইয়ে দেন। সাঁওতাল পরগনার কোনও এক গ্রামে একটা স্কুল খুলে সেখানকার বাচ্চাদের দায়িত্ব তুলে নেন নিজের কাঁধে।
পরের চিঠিটার প্রেরক আমার ছোটকাকা। প্রথম চিঠির বছর দুয়েক পরের তারিখ। পড়ে বোঝা গেল, আমার ঠাকুরদার পাঠানো কোনও এক চিঠির উত্তর। হয়ত সেই চিঠিতে ছিল ফিরে আসার হুকুম, নয়তো ত্যাজ্য পুত্র করবার হুমকি। তাই এই চিঠির ছত্রে ছত্রে তীব্র উদাসীনতা। চিঠির শেষ ছত্রে লেখা,
‘…যেদিন থেকে আমি একজনকে দেওয়া কথা রাখতে পারিনি, সেদিন থেকেই আমার নিজের কাছে নিজের মৃত্যু ঘটেছে। তোমাদের আদেশ শিরোধার্য করে আমি একটা নিষ্পাপ মেয়েকে কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু আমি বর্তমান জীবনটা নিজের ইচ্ছায় বেছে নিয়েছি। সম্পত্তির লোভ আমার কোনও কালেই ছিল না বাবা, তাই তোমরা এই অবাধ্য ছেলেকে মৃত ভাবতে পারো। আমাকে আর তোমরা কোনোদিন ফিরে পাবে না। এটাই তোমাদের সিদ্ধান্তের প্রতি আমার তীব্র প্রতিবাদ। এই অযোগ্য ছেলের সঙ্গে আর ভবিষ্যতে কোনোরকম যোগাযোগ না রাখলেই খুশি হবো।’
হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার চোখের কোণ কখন যেন ভিজে উঠেছে। এভাবেও ভালোবাসা যায়!
দেরাজের একদম তলায় একটা গুপ্ত সিন্দুক। সেটা এমনভাবেই আড়াল করে বানানো যে সহসা কারোর চোখে পড়বে না। কিন্তু আমার চোখে পড়ল। হয়ত নিয়তিতে ছিল বলেই পড়ল। একটা চুক্তিপত্র। কার্শিয়ঙের একটা অনাথ আশ্রমের সঙ্গে। তাতে লেখা শ্রী শশধর চৌধুরী এবং তাঁর স্ত্রী সুশীলা চৌধুরী একটি আটমাসের শিশু পুত্রকে আজ দত্তক নিলেন। শিশুটির নামকরণ করা হল সুদীপ চৌধুরী, অর্থাৎ আমার বাবা! ঘরের মধ্যে বজ্রাঘাত হলেও হয়ত এতটা অবাক হতাম না! হঠাৎ মনে হল আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেলো। মানে আমার বাবা দত্তক পুত্র? আমার ঠাকুরদা বিয়ের পর বছর ছয়েক উত্তরবঙ্গে ব্যবসার কাজে ছিলেন এটুকু জানতাম। বাবা হবার পর এখানে চলে আসেন। তার মানে বিয়ের বছর ছয়েক অব্দি অপেক্ষা করে নিজেদের সন্তান লাভের আসা ছেড়ে দিয়েই হয়ত এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এর আরও বছর পাঁচেক পর আমার বড়পিসির জন্ম। তাহলে তিনিই ছিলেন এ বাড়ির প্রথম সন্তান? আর আমরা আসলে এ বাড়ির কেউ নই, সম্পূর্ণ বহিরাগত? আমার বাবা জীবিত অবস্থায় এই সত্য জানতেন বলে আমার মনে হয় না। তবে তিনি কে? আমিই বা কে? আর মাথা কাজ করছিলো না। ধপ করে মাটিতেই বসে পড়লাম। তবে কি চাবির গোছাখানা সত্যিই হারিয়ে গেছে, না গোপন রহস্য গোপনে রাখার জন্যেই তাকে ইচ্ছাকৃত ভাবেই কোথাও নির্বাসন দেওয়া হয়েছে?
সপ্তাহখানেক অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত বদল করলাম। যে বাড়ি আমার নয়, যার উপর আমার কোনও রক্তের অধিকারই নেই, তার ভিত ভাঙার আমি কে? আমিও আমার মূলে ফিরে যাওয়াই শ্রেয় মনে করছি। একটা অনাথ আশ্রমের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কাল একটা দানপত্র করবো। আমার মৃত্যুর পর এ বাড়িতে আশ্রয় পাবে কতগুলো অসহায় অস্তিত্বহীন বাচ্চা, আমার বাবার মতো।