• facebook
  • twitter
Saturday, 23 November, 2024

বাংলার বন্যা পরিস্থিতির জন্য ডিভিসি-কে দায়ী করে প্রধানমন্ত্রীকে কড়া চিঠি মমতার

যার জেরে গত ১৭ থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেশ কয়েক দফায় প্রচুর পরিমাণে জল ছাড়া হয়। সেই জল রাজ্য সেচ দপ্তরের দুর্গাপুর ব্যারেজ দিয়ে দক্ষিণবঙ্গে প্রবেশ করতেই বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

বাংলার বর্তমান বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে ডিভিসি-কে দুষেছে রাজ্য সরকার। দুই দিন আগেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বান্দ্যোপাধ্যায় বিষয়টি নিয়ে ডিভিসি-কে সরাসরি তোপ দাগেন। তিনি গত বুধবার থেকে দক্ষিণবঙ্গের বন্যা দুর্গত জেলাগুলি পরিদর্শনে যান। প্রথমে হুগলি হয়ে পশ্চিম মেদিনীপুরে যান। সেখানে রাত কাটানোর পর বৃহস্পতিবার ফের পূর্ব মেদিনীপুরের বন্যা দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেন। মুখ্যমন্ত্রী দক্ষিণবঙ্গের এই বন্যাকে ‘ম্যান মেড’ বন্যা বলে দাবি করেছেন। মমতা এজন্য সরাসরি ডিভিসিকে দায়ী করেছেন। তিনি ডিভিসি-র সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করারও হুমকি দেন। এবার এই বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দ্বারস্থ হলেন মুখ্যমন্ত্রী। এজন্য তিনি মাইথন ও পাঞ্চেত জলাধার সংস্কার না করাটা প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেছেন, ঝাড়খন্ডকে বাঁচাতে পরিকল্পিতভাবে জল ছাড়ছে ডিভিসি। এজন্য বাংলার বিপদের কথা ভাবা হচ্ছে না।

মমতা এই ক’দিনে ডিভিসি-র জল ছাড়ার সমস্ত তথ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চার পাতার একটি চিঠি লিখেছেন। সেই চিঠিতে মমতা লেখেন, অপরিকল্পিতভাবে জল ছাড়ছে ডিভিসি। যে কাজ করার প্রয়োজন, সেটা না করে অন্য কাজে মনোনিবেশ করছে ডিভিসি। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, এইরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে আগামীতে ডিভিসি-র সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করা হবে।

মমতা আরও বলেন, ২০০৯ সালের পর দক্ষিণবঙ্গ এমন বন্যার সম্মুখীন হয়নি। ডিভিসি পরিচালিত পাঞ্চেত ও মাইথন জলাধার থেকে পাঁচ লক্ষ কিউসেক জল ছাড়া হয়েছে। যার কারণে দক্ষিণবঙ্গে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিম বর্ধমান, হাওড়া, হুগলি, পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর, বীরভূম এবং বাঁকুড়ার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। সেই সঙ্গে নিম্ন দামোদর ও সংলগ্ন এলাকাগুলিও প্লাবিত হয়েছে। এই ঘটনা নজিরবিহীন। মমতা লেখেন,’আমি নিজে বন্যাকবলিত এলাকাগুলি ঘুরে দেখে এসেছি। আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, এটা “ম্যান মেড” বন্যা। ডিভিসি আরও পরিকল্পিতভাবে বাঁধ এবং জলাধারগুলি নিয়ন্ত্রণ করলে এই বন্যা আটকানো যেত। ক্ষয়ক্ষতিও কমানো যেত।’

মমতা বলেন, রাজ্যের ১ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা বন্যা প্লাবিত। ক্ষতি হয়েছে চাষের জমি থেকে শুরু করে বহু ব্যক্তিগত সম্পত্তি। প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া চিঠিতে গত ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে কত পরিমাণ জল ছাড়া হয়েছে তার হিসেব দেন মমতা। চিঠিতে তিনি বলেন,’আমি নিজে ডিভিসি-র চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলেছি। জলাধারের জল ছাড়ার ফলে বাংলার নদীগুলির কী করুণ পরিণতি হয়েছে, তা তুলে ধরেন তিনি। নদীগুলির জলস্তরের অবস্থা সম্পর্কেও সজাগ করা হয়েছে। কিন্তু এত অনুরোধ সত্ত্বেও জলাধারের জল ছাড়া বন্ধ করেনি ডিভিসি। তিনি উল্লেখ করেন, গত ১৬ থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর এই তিনদিনে মাইথন ও পাঞ্চেত সহ অন্যান্য জলাধার থেকে মোট ৮ লক্ষ ৩১ হাজার কিউসেক জল ছাড়া হয়েছে। তাঁর অভিযোগ, জল ছাড়া নিয়ে রাজ্য সরকারের সঙ্গে ডিভিসি কোনও আলোচনা করেনি। সেটা করলে এই পরিস্থিতি এড়ানো যেত বলে তিনি দাবি করেন।

যদিও মমতার এই অভিযোগকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে কেন্দ্রের জল শক্তি মন্ত্রক। তাঁর অভিযোগকে কার্যত নস্যাৎ করে কেন্দ্র দাবি করেছে, ডিভিসি-র জল ছাড়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয় দামোদর ভ্যালি জলাধার নিয়ন্ত্রণ কমিটি। সেই কমিটিতে রাজ্য সরকারের প্রতিনিধিরা রয়েছেন। সেখানে কেন্দ্রীয় জল কমিশন এবং ডিভিসি-র প্রতিনিধিরা রয়েছেন। রয়েছেন ঝাড়খন্ড সরকারের প্রতিনিধিরাও। জল ছাড়ার আগে রাজ্য প্রশাসনকে নিয়ম মেনে জানানো হয়েছে।

প্রসঙ্গত প্রথমে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ ও পরে ঝাড়খণ্ডের ওপরে নিম্নচাপ বলয় তৈরি হওয়ার ফলে বাংলার দামোদর উপত্যকায় গত ১৪ ও ১৫ সেপ্টেম্বর প্রবল বৃষ্টি হয়। পরে ১৫ ও ১৬ সেপ্টেম্বর ঝাড়খণ্ডেও ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয়। ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে গেলেও জলাধারগুলিতে ব্যাপক জলের চাপ বাড়ে। দামোদর ও মুণ্ডেশ্বরী নদীতেও ব্যাপক জলের চাপ সৃষ্টি হয়। এই দুই নদীতে বিপদসীমার ওপর দিয়ে জল বইতে শুরু করে। পাশাপাশি, শিলাবতী, কংসাবতী, দ্বারকেশ্বর নদীতেও ব্যাপক জলের চাপ বাড়ে। এদিকে মাইথন, পাঞ্চেত সহ ডিভিসি-র জলাধারগুলিতেও জলের চাপ বাড়ে। যার জেরে গত ১৭ থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেশ কয়েক দফায় প্রচুর পরিমাণে জল ছাড়া হয়। সেই জল রাজ্য সেচ দপ্তরের দুর্গাপুর ব্যারেজ দিয়ে দক্ষিণবঙ্গে প্রবেশ করতেই বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

মমতার অভিযোগ, দামোদরের তীরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা ডিভিসি-র প্রধান কাজ হওয়া সত্ত্বেও তারা সেই দায়িত্ব পালন করছে না। উল্টে তারা বিদ্যুৎ উৎপাদনে মনোনিবেশ করেছে। যার জেরে বাংলার ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। তিনি বলেন,’এই বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঘাটাল। অথচ ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের জন্য আমরা বহুদিন ধরে কেন্দ্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছি। এজন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কেন্দ্র কোনও পদক্ষেপ করেনি।’

মমতা আরও জানিয়েছেন, মাইথন, পাঞ্চেত জলাধারগুলির সংস্কার প্রয়োজন। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে চিঠিতে বলেন,’গত ১০ বছর ধরে ডিভিসি-কে বলে আসছি, জলাধারের সংস্কার প্রয়োজন। কিন্তু ডিভিসি বা কেন্দ্রীয় সরকার সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করেনি। নীতি আয়োগের বৈঠকেও আমি এ বিষয়ে কেন্দ্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম। আমাদের সাংসদ এবং মন্ত্রীরাও বিষয়টি কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের সামনে বার বার তুলে ধরেছেন। তারপরেও কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি। এই দুই জলাধারের ধারণ ক্ষমতা ৩০ শতাংশ কমে গিয়েছে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে দিন দিন। বিষয়টিকে আর এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে আমরা ডিভিসির সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করতে বাধ্য হব। বছরের পর বছর এই বঞ্চনা আমরা মানতে পারব না। আপনার কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখুন। অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকে এ বিষয়ে পদক্ষেপের নির্দেশ দিন। বন্যা মোকাবিলার জন্য কেন্দ্র বাংলার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করুক। ‘