বদলের সময় এসেছে।
বাক্যটি লিখলেই প্রথমে যেটি মনে হবে সেটি হল, বোধহয় এই রাজ্যের শাসক বদলের কথা বলা হচ্ছে। না, আমাদের বক্তব্য তা নয়। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে পশ্চিমবঙ্গবাসী বুঝে গেছে এখানে শাসকের রং বদল হয়, চরিত্র বদল হয় না। সুতরাং নিছক শাসক বদলে এই পচে যাওয়া, গলে যাওয়া ব্যবস্থার আর কিছু হবে না।
আগস্টের নয় তারিখে একজন কর্মরত চিকিৎসককে তার কর্মস্থলে ধর্ষণ ও হত্যা করা হল। এমন একটি ঘটনায় উত্তাল ক্ষোভ, প্রতিবাদ আন্দোলন, কোনও কিছুই অস্বাভাবিক নয়, বরং অতি-স্বাভাবিক। কিন্তু এমন কোনও অতি-স্বাভাবিক ঘটনাই কি পশ্চিমবঙ্গবাসী স্মরণাতীত কালের মধ্যে ঘটতে দেখেছে? পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডে স্বল্পস্থায়ী, বিচ্ছিন্ন কিছু প্রতিবাদ, কিছু মোমবাতি মিছিল, তারপরই সব স্তিমিত হয়ে যায় এবং শাসকপক্ষ সুদক্ষ কৌশলে সবকিছু ধামাচাপা দিয়ে দেয়। কামদুনি ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ বরং কিছু দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল, মূলত দুজন অরাজনৈতিক প্রতিবাদীর লড়াইয়ে। কিন্তু শেষপর্যন্ত সেই প্রতিবাদও অপরাধীকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করে তার যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করে উঠতে পারেনি। এখানেও শাসকপক্ষ ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে, আদালতের মামলায় যথেষ্ট প্রমাণ হাজির না করে, বা না করতে পেরে, পরোক্ষে সম্ভাব্য অপরাধীদের মুক্তির পথ প্রশস্ত করেছে। আর শাসকপক্ষের এই কাজকে সহজ করে দিয়েছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি, যারা রাজনীতির ময়দানের ফায়দা তুলতে গিয়ে অরাজনৈতিক প্রতিবাদ আন্দোলনকারীদের গায়ে রাজনীতির রং মাখাবার চেষ্টা করেছে।
এখানেই অনেকেই বিস্মিত হন, একটি মহিলা শাসিত রাজ্যে ধর্ষণ ও হত্যার মতো ঘটনাকে এত ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে একটি কথা মনে রাখা দরকার, শাসকের কোনও লিঙ্গচিহ্ন হয় না। শাসকের একটিই চিহ্ন, একটিই রং, একটিই চরিত্র, সে শাসক। আবার শাসকের উল্টোদিকে যে থাকে, সে-ও কিন্তু হবু শাসক। ফলে এই শাসক-হবু শাসকের বৃত্ত থেকে যতক্ষণ না একটি প্রতিবাদ আন্দোলনকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে আসা যাচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত কিন্তু তার চূড়ান্ত সাফল্য সম্বন্ধে সন্দেহ থেকেই যায়। বর্তমান প্রতিবাদ আন্দোলনটির লড়াই তাই দ্বিপাক্ষিক। একদিকে সে লড়াই নির্মম হত্যাকাণ্ডটির বিরুদ্ধে, অন্যদিকে সে লড়াই এই শাসক-হবু শাসকের বৃত্ত থেকে আন্দোলনটিকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে আসার পক্ষে। এবং এখনও পর্যন্ত যা গতিপ্রকৃতি তাতে বর্তমান প্রতিবাদ আন্দোলনটি কিন্তু এই দুই লড়াইয়েই আংশিক হলেও সাফল্য লাভ করছে।
কীভাবে? প্রথম থেকে ঘটনাক্রম লক্ষ্য করুন। শাসকপক্ষ কিন্তু আগের মতই একই প্রচেষ্টায় অবিরত। প্রথমে ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হল, চেষ্টা করা হল অপরাধের চিহ্নগুলিকে মুছে ফেলার মাধ্যমে। তারপর আন্দোলনকে ভন্ডুল করার চেষ্টা করা হল রাত জাগা কর্মসূচির মধ্যে ঢুকে পড়ে তাণ্ডব চালিয়ে। তারপর আন্দোলনকে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হল যখন শাসক প্রধান নিজেই রাস্তায় নেমে বিচার চেয়ে বসলেন। কিন্তু আশ্চর্যের কথা, এত করেও এখনও পর্যন্ত আন্দোলনকে পথভ্রষ্ট করা যায়নি। বরং কি চমৎকারভাবেই না সে প্রতিটি ধাপে ধাপে নিজেকে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিচ্ছে, নেওয়ার ভাষা অর্জন করছে।
যে বদলের কথা আমরা প্রথমেই বলেছি সে বদল আন্দোলনের ভাষা ও চরিত্রের এই বদল। আন্দোলনের প্রকৃত সূত্রপাত ও বিস্তার কিন্তু রাতের দখল নেওয়ার কর্মসূচির মাধ্যমে। আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়েছিল কিন্তু স্রেফ সোশ্যাল মিডিয়ায়। এমনকি এইসব মিডিয়ায় অনেককে প্রশ্ন করতে দেখা গেছে, চৌদ্দোই আগস্ট বিকেলেও, সত্যিই কি এমন কোনও কর্মসূচি হতে চলেছে আজ রাতে? তারপর তো শুরু হল রাতের দখল নেওয়া। ততক্ষণে কিন্তু জড়তা কাটতে শুরু করেছে। নইলে সুদূর পুরুলিয়ার গ্রামেও কি করে বেরিয়ে যায় রাত জাগা মিছিল? এখানেই কি একটা বদলের লক্ষণ লুকিয়ে ছিল না? শাসকপক্ষ কিন্তু এই মিছিলকে আটকাবার চেষ্টা করেনি। চেষ্টা করেছিল কেবল একটি জায়গাতে, তার উদ্দেশ্য ছিল অন্য, মিছিলের আড়ালে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করার ভান করে আরও বেশি প্রমাণলোপের চেষ্টা।
তারপর যা হয়। যথারীতি বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি চেষ্টা শুরু করল এই স্বতঃস্ফূর্ত জনতার আন্দোলনকে নিজেদের কব্জায় আনতে। নির্বোধের মত তারা একটি প্রায় হিংসাশ্রয়ী আন্দোলন তৈরি করতে গেল অরাজনৈতিক ব্যানারে। ইতিপূর্বে বহুবার দেখা গেছে মানুষ এই মেকি আন্দোলনকে চিনতে ভুল করেছে, পা দিয়ে ফেলেছে ফাঁদে। কিন্তু এবার সে ভুল আর হল না। ঠিক তার পরের দিনই আন্দোলনকারীরা ঘোষণা করে দিলেন, আগের দিনের আন্দোলনের ভাষা তারা চেনেন না, সমর্থনও করেন না, তাদের ভাষা অন্য।
এই আন্দোলন কোনও হিংসা চায় না, এই আন্দোলন কোনও রাজনীতিকে অন্দরে ঢুকতে দেয় না। আর আন্দোলনের ভাষার এই পরিবর্তন আন্দোলনকারীদের অজ্ঞাতেই কোথাও যেন একটা দৃঢ়তার জায়গা তৈরি করে দিল মানুষের মধ্যে। এ এমন এক দৃঢ়তা, যা শাসকের রক্তচক্ষুকে মান্যতা দেওয়ার এতদিনের কু-অভ্যাসকে পর্যন্ত বিসর্জন দিতে শেখাচ্ছে। নিজের কর্তৃপক্ষের চোখরাঙ্গানিকে অমান্য করে, নিজের চাকরিকে সংশয়াছন্ন করে যখন একজন শিক্ষিকা তাঁর ছাত্রীদের ভয় জয় করে শিরদাঁড়া সোজা রাখার শিক্ষা দিতে এগিয়ে আসেন, তখন বোঝা যায় কোথাও একটা আড় ভাঙতে শুরু করেছে।
আড় ভাঙছে। কিন্তু সেই ভাঙ্গনে কোথাও উগ্রতা নেই, অশালীনতা নেই। ডাক্তাররা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে তাদের রুটিন কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন। কিন্তু তারাই আবার রাস্তায় বসে চিকিৎসা দিচ্ছেন, তারাই আবার চালু করছেন টেলিমেডিসিনের ব্যবস্থা, কোথাও আবার কোনও ডাক্তার কোন সরব প্রতিবাদ না করেই চিকিৎসা করতে করতে কেবল তার প্রেসক্রিপশনের গায়ে একটি লাল ছাপ মেরে জানিয়ে দিচ্ছেন তিনিও প্রতিবাদী, তিনিও চান সুবিচার, ন্যায়বিচার। আর আন্দোলনের ভাবের ও ভঙ্গির এই পরিবর্তনই শাসকশ্রেণীর মেরুদন্ডে শীতল স্রোত বয়ে আনতে শুরু করেছে।
পশ্চিমবঙ্গের মানুষ একটি চৌঁত্রিশ বছরের শাসন দেখেছে, সেই শাসনের বিদায়লগ্নে শাসকের ঔদ্ধত্য দেখেছে, সেই ঔদ্ধত্য, সেই অত্যাচার সহ্য না করতে পেরে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির হাতে তুলে দিয়েছে শাসন ক্ষমতা। কিন্তু তারপর সে বুঝেছে শাসকের চরিত্র সর্বত্রই প্রায় একই রকম। তাই বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি নয়, বরং দরকার যেটা সেটা হল শাসকের স্বৈরাচারী ছায়ার দর্শনমাত্র তৈরি করতে শুরু করা জনতার নিরন্তর সাঁড়াশি চাপ।
আজকের পশ্চিমবঙ্গে কোনও বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি নয়, শাসককে সঠিক রাস্তায় চলতে বাধ্য করতে পারে একমাত্র একটি সচেতন নাগরিক সমাজ। হয় তো এই আন্দোলন ব্যর্থ হবে, হয় তো শেষপর্যন্ত পাওয়া যাবে না কোনও ন্যায়বিচারও, কিন্তু এই আন্দোলন যে সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতার পাঠটি দিয়ে যাচ্ছে তা অমূল্য।