ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় এখন ইসরায়েলের ছোড়া গুলি ও বোমার চেয়ে দেশটির ইচ্ছাকৃতভাবে চাপিয়ে দেওয়া ক্ষুধায় বেশি মানুষ মারা যাচ্ছেন। গাজায় দুর্ভিক্ষজনিত ক্ষতির রেশ টানতে হবে ফিলিস্তিনিদের ভবিষ্যৎ কয়েক প্রজন্মকে।ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় খাদ্যের উৎপাদন ও সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিষক্রিয়ায় কৃষিজমি অনাবাদি করে ফেলা এবং খেতখামার, বন্দর ও মাছধরা নৌযানগুলো ধ্বংস করা। এতে গাজার পুরো জনগোষ্ঠী মানবিক ত্রাণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
গাজার সমগ্র জনগোষ্ঠী বা এর অংশবিশেষকে ধ্বংস করার অভিপ্রায়ে ইসরায়েল কীভাবে ক্ষুধাকে ব্যবহার করছে, তা নব্য গাজাকে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।যুদ্ধ–পরবর্তী ইতিহাসে কখনো কোনো জনগোষ্ঠীকে এত দ্রুত ক্ষুধার সম্মুখীন ও তীব্র ক্ষুধায় পতিত হতে দেখা যায়নি; যেমনটা ঘটেছে গাজায় বসবাসরত ২৩ লাখ মানুষের ক্ষেত্রে।’গত বছরের অক্টোবরে গাজায় ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু করার পর এ উপত্যকায় ৩৪ ফিলিস্তিনি না খেয়ে মারা গেছেন বলে এখন পর্যন্ত জানা গেছে। তাদের বেশির ভাগই শিশু।গাজাবাসীর এই নির্ভরশীলতা পুঁজি করে তাঁদের ক্ষতি করতে ও মেরে ফেলতে রাজনৈতিক ও সামরিক অস্ত্র হিসেবে মানবিক ত্রাণ ব্যবহার করেছে ইসরায়েল। এর মধ্য দিয়ে অবরুদ্ধ উপত্যকাটিতে মানবিক ত্রাণ প্রবেশে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করার বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।গাজাবাসীকে ক্ষুধায় মেরে ফেলার ইসরায়েলি কৌশলের শুরু ৭ অক্টোবরের অনেক আগে থেকেই। গাজায় খাদ্য প্রবেশে দেশটি বাধা দেওয়া শুরু করে সেই ১৯৯১ সালে আর ২০০০ সাল থেকে উপত্যকাটি পুরোপুরি অবরুদ্ধ করে রেখেছে তারা। এ অপতৎপরতা এখন শুধু গাজাতেই সীমাবদ্ধ নেই ।গত ৭০ বছরের বেশি সময় ধরেই ফিলিস্তিনিদের খাদ্যব্যবস্থা ধ্বংস করে আসছে ইসরায়েল। এ সময়ের মধ্যে দেশটি তাঁদের বাগান ও খামার ধ্বংস করেছে। এ ছাড়া হয়রানি বা হত্যা করেছে কৃষক, জেলে ও মেষপালকদের। নিজ বাড়িঘর ও এলাকা থেকে ফিলিস্তিনিদের উৎখাত করার লক্ষ্যে ইসরায়েলি চেষ্টার অংশ তাঁদের (ফিলিস্তিনি) ক্ষুধায় রাখার এ কৌশল।
গাজার দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতিকে নিখাদ মানবিক সমস্যার চেয়ে রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। ‘(ফিলিস্তিনবাসীকে) ক্ষুধায় রাখার বিষয়টি সব সময়ই ইচ্ছাকৃত, আন্তর্জাতিক, কাঠামোগত ও দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা।’এ সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় ইসরায়েলের ওপর বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবরোধ আরোপ করা।
জাতিসংঘ দীর্ঘদিন ধরে সতর্ক করে আসছে যে গাজা দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত বিশ্ব সংস্থা এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা দেয়নি।
গত জুলাই মাসে জাতিসংঘের শীর্ষস্থানীয় ১০ জন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ইসরায়েল ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে ‘আন্তর্জাতিকভাবে ও নিশানা করে ক্ষুধার প্রচারণায় যুক্ত রয়েছে।’
এই বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছিলেন, গাজার খান ইউনিস ও দেইর আল–বালাহ শহরে গত মে মাসের শেষ দিক থেকে ১৩ বছর, ৯ ও ৬ মাসের তিন শিশু অপুষ্টিতে মারা গেছে। এ ঘটনা এটিই বলছে, গাজা দুর্ভিক্ষে পড়ার মুখে রয়েছে।
উত্তর গাজার পর দক্ষিণ গাজায়ও বড় ধরনের স্থল অভিযান শুরু করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। এতে উত্তরাঞ্চল থেকে সরে আসা ফিলিস্তিনিরা আরেক দফা বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন। বিরামহীন হামলার কারণে ত্রাণসহায়তাও পৌঁছানো যাচ্ছে না। এতে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে বলে বারবার সতর্ক করেছে জাতিসংঘ। ইতিমধ্যে ইসরায়েলি হামলায় নিহতের সংখ্যা ১৬ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। নিহত ফিলিস্তিনিদের ৭০ শতাংশই নারী ও শিশু।
গাজায় ইসরায়েলি হামলা তীব্রতর হওয়ায় মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। সেখানে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ১৯ লাখে দাঁড়িয়েছে। তাঁদের বড় একটি অংশই শিশু।ইসরায়েলের বিরামহীন হামলার কারণে বাস্তুচ্যুত এসব মানুষের কাছে ত্রাণসহায়তা পৌঁছানো না গেলে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে বলে সতর্ক করেছে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা।বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) বলেছে, ‘নতুন করে লড়াই শুরু হওয়ার ফলে ত্রাণ বিতরণ করা যাচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে ত্রাণকর্মীদের জীবন বিপন্ন হতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, এর ফলে বেসামরিক সাধারণ মানুষ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন। গাজায় ২০ লাখ মানুষের বেঁচে থাকার সম্বল হলো এই ত্রাণের খাদ্যশস্য।’
ডব্লিউএফপি বলেছে, ‘আমাদের কর্মীদের জন্য গাজা ভূখণ্ডে নিরাপদ, বাধাহীন ও দীর্ঘকালীন যাতায়াতের ব্যবস্থা চাই। তাহলেই তারা মানুষের কাছে বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য ত্রাণ পৌঁছে দিতে পারবে। একমাত্র দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা হলেই এ মানবিক বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব।’
জাতিসংঘের সংস্থাগুলো বলছে, গাজার বর্তমান পরিস্থিতি বিপর্যয়কর। বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত খাদ্যপণ্য নেই। পান করার মতো সুপেয় জলটুকুও বাসিন্দারা পাচ্ছেন না।
পাঁচ সন্তানের মা নেভেন হাসান বলেন, ‘আমরা দিনে এক বেলা খাই। বেশির ভাগ সময়ই ছোট এক টুকরা রুটি আর টিনের কৌটায় প্রক্রিয়াজাত করা মটরশুঁটি খেয়ে কাটে।’
এই মা আরও বলেন, ‘আমার ছয় মাসের বাচ্চার জন্য দুধ কিনতে পারছি না। আমার ছেলেমেয়েদের সবাই অসুস্থ। তাদের দূষিত জলপান করতে হচ্ছে। শীত কাটানোর মতো কোনো কম্বলও আমরা পাইনি।