পঙ্কজ কুমার চট্টোপাধ্যায়
প্যালেস্তাইনিদের নিজের দেশ এখন ইহুদিদের দেশ। আসল প্যালেস্তাইনে প্যালেস্তাইনিরা এখন সংখ্যালঘু। বেশির ভাগ প্যালেস্তাইনি বাস করছে অধিকৃত ওয়েস্ট ব্যাংক এবং গাজাতে, যে অঞ্চলগুলির উপর ইজরায়েল এখনও সরকারি ভাবে সার্বভৌমত্ব দাবি করেনি। মাথায় রয়েছে “বৃহত্তর ইজরায়েল”-এর ভাবনা। গাজা যেখানে মুক্ত কারাগার, ওয়েস্ট ব্যাংক সেখানে ক্রমশঃ বসতি-স্থাপনকারী ইজরায়েলিদের অধিকারে চলে যাচ্ছে ইজরায়েলি বাহিনির চোখের সামনে। এমত অবস্থায় ৭ অক্টোবর ২০২৩ এর হামাসের হামলার বদলা নিতে এবং তথাকথিত হামাস সন্ত্রাসবাদীদের নিশ্চিহ্ন করতে বিগত ৯ মাসের উপর গাজাবাসীর উপর নিরন্তর একতরফা ইজরায়েলি সামরিক অভিযান চলছে। ফলে ইতিমধ্যেই প্রায় ৪০,০০০ গাজাবাসী মারা গেছে। যুদ্ধবিরতির কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এখন যা অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাতে ইজরায়েলকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছে একমাত্র আমেরিকা। এই সমর্থন কি চিরন্তনভাবে চলবে?
ইজরায়েলের আভ্যন্তরীণ সমস্যা অনেক। বর্তমান ইজরায়েলে প্যালেস্তাইনিরা দক্ষিণ আফ্রিকার মতো বর্ণ-বৈষম্যের শিকার। অন্যদিকে আভ্যন্তরীণ ভাবে ইজরায়েল অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ভাবে মেরুকৃত। ইহুদিরা নিজেদের সবচেয়ে উন্নত জাতি হিসেবে দাবি করে। সেখানে দাঁড়িয়ে জায়নবাদকে নিজের জাতির গরব এবং প্রান্তীকৃত মানুষকে বোঝাতে হবে তাদের দুরাবস্থার কারণ। কেন তারা এখনো অনুন্নত শহরগুলিতে বাস করছে? কেন তাদের সংস্কৃতি ইউরোপীয়- প্রধান সংস্কৃতিতে প্রতিনিধিত্ব করতে পারছে না। এই জায়গায় ইজরায়েলি কৌশলবিদরা বেছে নিয়েছেন এক সাধারণ শত্রুকে, নিরাপত্তার সমস্যা এবং ইসলামের উপর যুদ্ধ। কিন্তু, আভ্যন্তরীণ সমস্যা তাতে কিছুই কমেনি। ২০০৮ সালের পর থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ নিম্নমধ্যবিত্তে পরিণত হয়ে চলেছে। সেই মানুষগুলোর সমস্যা গাজার যুদ্ধের মাধ্যমে সমাধান হবে না।
অতীতে এবং বর্তমান সময় পর্যন্ত ইজরায়েল সরকার সাধারণ মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে আমেরিকা তাদের সাহায্য করবে, কিন্তু কতদিন সেই সাহায্য চলতে থাকবে? বিদেশী রাষ্ট্রকে দেওয়া মার্কিণ সাহায্যের বিরোধিতা আমেরিকার মধ্য থেকেই ভীষণ ভাবে আসছে, সে বিরোধিতা একমাত্র প্যালেস্তাইন-সমর্থকরাই করছেন না। আমেরিকাকে ভাবতেই হবে ইজরায়েল রাষ্ট্র একটি কৌশলগত সম্পদ না আর্থিক দায়। সুতরাং জায়নবাদী রাষ্ট্র এক সময়ে দুর্বল হতে বাধ্য। কিন্তু, আশু বিপদের সম্ভাবনা আছে কি?
প্রবীণ আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতাদের কাছ থেকে জানা গেছে যে বর্ণবিরোধী সরকারের অত্যাচার শেষের দিনগুলিতে ভীষণভাবে ভয়ানক হয়ে উঠেছিল। ইজরায়েলে আমরা কী দেখছি? ২০০৫ সালের পর গাজার উপর বারে বারে নৃশংস হামলা চালিয়েছে ইজরায়েল। ২০০৮ সালে অপারেশন কাস্ট লিড-এ ১,৩০০ এর বেশি প্যালেস্তাইনি মারা যায়। এর পরে ২০১৪ সালের ৮ জুলাই থেকে ২৬ আগষ্ট চলে অপারেশন প্রোটেক্টিভ এজ এবং সেই হামলায় ২,৩০০ এর বেশি প্যালেস্তাইনি মারা যায়। পরবর্তি আক্রমণ ২০২১ সালের মে মাসে, যা গাজা থেকে ইজরায়েলের উপর রকেট হানার পালটা হিসেবে বলে ইজরায়েল দাবি করে। এই হানায় গাজাতে কম পক্ষে শেষ হামলা ২০২২ সালের আগষ্ট মাসে এবং ত্রিশ জনের বেশি ২৬০ জন মারা যায়। প্যালেস্তাইনি মারা যায়। কিন্তু, এর মধ্যে সবচেয়ে জঘন্য হামলা হলো ৫০ দিন ব্যাপি ২০১৪ সালের অপারেশন প্রোটেকটিভ এজ।
২০১৪ সালের যুদ্ধ শেষ হবার আগেই, কিছু ব্যক্তি প্রকাশ্যে ইজরায়লিদের আশ্বস্ত করতে থাকেন যে এটা শেষ যুদ্ধ নয়। এই যুদ্ধ পরবর্তী আরো ভয়ানক যুদ্ধের আগাম সতর্কতা মাত্র। ইজরায়েলি ঐতিহাসিক বেনি মরিস লেখেন—
পরের বার আমরা কি করবো? উত্তর পরিষ্কার এবং সর্বজনবিদিত। শুধু প্রয়োজন এই পথে এগোবার সাহস এবং কাজ হাসিল করার অটল মানসিকতা। এটা সহজে এবং দ্রুত হবে না। আমরা বলছি গাজাভূমি পুনরায় অধিকার এবং সামরিক শক্তি হিসেবে হামাসকে নির্মূল করার এবং হয়তো এক রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের কথা।
মাসের পর মাস লড়াই করে আমরা মহল্লার পর মহল্লা হামাস এবং ইসলামিক জিহাদিদের হাত থেকে মুক্ত করবো। এর ফলশ্রুতি হিসেবে গুরুতর মূল্য দিতে হবে। ইজরায়েলি সামরিক বাহিনি এবং অসামরিক প্যালেস্তাইনি মারা যাবে বা আহত হবে। আমাদের মতো দেশ, চারিদিকে প্রতিকূল প্রতিবেশি দ্বারা বেষ্টিত, তাকে এই মূল্য দিতেই হবে নিজেদের অস্তিত্বের জন্য।
এই সব ঘটনা কি দক্ষিণ আফ্রিকার শেষের দিনগুলিকে মনে করায় না? কিন্তু, একটা ঘটনা ইজরায়েলি সরকার বুঝছে না, যে যত আক্রমণ হবে, যত গাজাবাসীর উপর অত্যাচার চলবে, ততই হামাসে দলে দলে নাম লেখাবে যুবকেরা। গাজার অধিবাসীদের মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশের বয়স ১৮ বা তার নীচে। এদের কাছে যখন কোন সুনির্দিষ্ট শান্তিকামী ভবিষ্যতের পথ খোলা থাকবে না তখন এরা হামাসের দলে নাম লেখাতে বাধ্য হবে। গাজা যুদ্ধের আগেই বিশ্ব দেখেছে যে ইজরায়েলি জাতি সক্রিয়ভাবে দুই শিবিরে বিভক্ত। একদিকে দক্ষিণপন্থী সরকারের সমর্থক নাগরিক। অন্যদিকে সরকার বিরোধী শিবির যারা সরকারের প্রস্তাবিত ‘বিচারব্যবস্থার সংস্কার’- এর তীব্র বিরোধি। কারণ, এই সংস্কারের মাধ্যমে বিচারবিভাগের উপরে রাজনীতিকদের বেশি অধিকার দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। ১০ মাস ব্যপি এক অচলাবস্থার পরেই যখন গত বছরের ৭ অক্টোবরে হামাসের হামলা ঘটলো এবং ইজরায়েল গাজার উপর যুদ্ধ ঘোষণা করলো, তখন সব দেশবাসী এক হয়ে গেল।
দক্ষিণ আফ্রিকার সমস্যা সমাধানে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল কিউবা। ইজরায়েলের ক্ষেত্রে সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে ইরান। তিন জঙ্গীবাদি সংস্থা হামাস, হিববুল্লা এবং হুথিকে সমর্থন করছে সক্রিয় ভাবে। ইজরায়েলকে এদেরও মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
নোয়াম চমস্কির মতে ইজরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ভুল হল- ১৯৭১ সালে সবচেয়ে সামরিক শক্তিশালী আরব দেশ ইজিপ্টের পূর্ণ শান্তি চুক্তির প্রস্তাব গ্রাহ্য না করা। বেন মরিসের কথা মাথায় রাখলে চারিদিকে আরব পরিবৃত পরিবেশে অবস্থান করেও নিরাপত্তার এক সুবর্ণ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারতো ইজরায়েল।
একদিকে দেশের আভ্যন্তরীণ সমস্যা এবং দিনের পর দিন যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি জিইয়ে রাখা এবং অন্যদিকে আন্তর্জাতিক আদালত, রাষ্ট্রসঙ্ঘ বা বিশ্বের সব দেশের মতকে উপেক্ষা করে জায়নিজমের রথের ঘোড়াকে চাবুক মেরে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া (ইজরায়েলে ‘ইজয়ারেলি’ নাগরিকত্ব বলে কিছু নেই, আছে ‘ইহুদি’ নাগরিকত্ব) – এইভাবে একদিন ইজরায়েল এক জাতিচ্যুত পারিয়া) রাষ্ট্রে পরিণত হবে (ঐতিহাসিক ইলান পাপে-এর ধারণা) এবং অক্সিজেনের নল আমেরিকা) ছিন্ন হয়ে যাবে (চমস্কি এবং পাপে-এর উভয়ের ধারণা)। এখন ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকা।