(১২ আগস্ট ১৯৫২ — ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪)
দু’বার রাজ্যসভার সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন সীতারাম ইয়েচুরি। আর দু’বারই পশ্চিমবঙ্গ থেকেই। বাংলার বাম নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগাযোগ ছিল। বার বার তিনি ছুটে আসতেন বাংলায়। তাঁর মৃত্যুতে নেতৃত্বে তৈরি হল এক গভীর শূন্যতা। বিজেপি ছাড়া আর সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই তাঁর ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। তাঁদের কাছেও ছিল সীতারামের গ্রহণযোগ্যতা। তাঁকে বলা হতো সিপিআইএম-এর হরকিষেণ সিং সুরজিৎ ঘরানার শেষ নেতা। জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে দলের মধ্যে সেই ভূমিকা পালন করার মতো আর কোনও নেতা রইলেন কিনা, এবার এই প্রশ্ন উঠবেই। জাতীয় রাজনীতিতে সিপিআইএম যখন যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়েছে, তখন সীতারাম ইয়েচুরির প্রয়াণ দলের পক্ষে এক অপূরণীয় ক্ষতি।
সীতারাম ১৯৫২ সালের ১২ আগস্ট মাদ্রাজের একটি তেলেগুভাষী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা সর্বেশ্বর সোমায়াজুলা ইয়েচুরি এবং মা কল্পকম ইয়েচুরি অন্ধ্রপ্রদেশের কাঁকিনাড়ার বাসিন্দা ছিলেন। বাবা সর্বেশ্বর অন্ধ্রপ্রদেশের রাজ্য সড়ক পরিবহন কর্পোরেশনের একজন ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। তাঁর মা একজন সরকারি আধিকারিক ছিলেন। তাঁর পরিবার এখনও এই কাঁকিনাড়াতেই বসবাস করে। ইয়েচুরি বড় হয়েছেন হায়দরাবাদ শহরে। তিনি এখানকার অল সেন্ট হাইস্কুলে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। সীতারাম একজন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ১৯৬৯ সালে তেলেঙ্গানা আন্দোলনের সময় তাঁকে দিল্লিতে আনা হয়। সেখানে তিনি নিউ দিল্লির প্রেসিডেন্ট এস্টেট স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন। ইয়েচুরি সিবিএসই-র উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় সর্ব ভারতীয় স্তরে প্রথম স্থান অধিকার করেন। তিনি দিল্লির সেন্ট স্টিফেন কলেজে অর্থনীতিতে সাম্মানিক স্নাতক নিয়ে বি এ পাশ করেন। এরপর জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করেন। সীতারাম স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দুটোতেই প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। এরপর জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অর্থনীতিতে পিএইচ ডি নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। কিন্তু মাঝপথেই তাঁর শিক্ষা জীবনে ঘটে আকস্মিক ছন্দপতন। ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার সময়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
১৯৭৪ সালে সীতারাম স্টুডেন্টস ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া (এসএফআই)-তে যোগ দেন। এরপর সিপিআইএম-এ। ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থার সময়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি তখন জেএনইউ-এর ছাত্র ছিলেন। গ্রেপ্তারের আগে তিনি কিছু সময়ের জন্য আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যান। জরুরী অবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এরপর ইয়েচুরি এবং প্রকাশ কারাত মিলে জেএনইউ-তে একটি দুর্ভেদ্য বামপন্থী ঘাঁটি গড়ে তোলেন। জরুরি অবস্থার পর ১৯৭৭-৭৮ সালে তিনি জেএনইউ-এর ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৮ সালে ইয়েচুরি এস এফ আই-এর যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপর তিনি সিপিআইএম-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৫ সালে দলের সংবিধান সংশোধন করা হয়। এবং পাঁচজন সম্পাদক নির্বাচন করা হয়। এই পাঁচজনের মধ্যে তিনি ছাড়াও ছিলেন প্রকাশ কারাত, সুনীল মৈত্র, পি রামচন্দ্রন এবং এস রামচন্দ্রন পিল্লাই। তাঁরা পলিটব্যুরোর নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণ মেনে কাজ শুরু করেন। তিনি ১৯৮৬ সালে এসএফআই-এর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি পলিটব্যুরোর কাজে মনোনিবেশ করেন। ১৯৯২ সালে তিনি পলিটব্যুরোর চতুর্দশতম কংগ্রেসে সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৫ সালের ১৯ এপ্রিল বিশাখাপত্তনমে দলের ২১তম কংগ্রেসে তিনি সিপিআইএম-এর পঞ্চম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি এবং পলিটব্যুরো সদস্য এস. রামচন্দ্রন পিল্লাই এই পদের সর্বাধিক যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু পিল্লাই সেই পদ প্রত্যাখ্যান করার পরে সর্ব সম্মতিক্রমে প্রাক্তন সীতারামকেই এই পদে ফের নির্বাচিত করা হয়। এই নিয়ে তিনি ২০০৫, ২০১০ ও ২০১৫ সালে টানা তিনবার এই স্থলাভিষিক্ত হন। এরপর ২০১৮ সালের এপ্রিলে হায়দরাবাদে অনুষ্ঠিত ২২তম পার্টি কংগ্রেসে তিনি ফের সিপিআই(এম) এর সর্ব ভারতীয় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপর ২০২২ সালের এপ্রিলে কেরালার কান্নুরে দলের ২৩তম পার্টি কংগ্রেসেও ফের সিপিআই(এম) এর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি হরকিষেন সিং সুরজিতের ঘনিষ্ঠ অনুগামী ছিলেন।
ইয়েচুরি সংসদে ২০১৭ সালে সংসদে সেরা সাংসদ নির্বাচিত হন। তিনি ২০০৫ সালের জুলাই মাসে প্রথম রাজ্যসভার সাংসদ নির্বাচিত হন। সাংসদ হিসেবে সংসদে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সংসদে আলোচনা উত্থাপন করান। বিভিন্ন প্রশ্নোত্তর পর্বে সীতারাম দেশের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক সমস্যার কথা তুলে ধরেন।
তাঁর মাতৃভাষা তেলেগু হলেও সীতারাম অনেকগুলি ভাষা জানতেন। হিন্দি, ইংরেজি ছাড়াও তামিল, মালয়ালম এবং বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারতেন। সীতারাম ছিলেন দলের কিছুটা নরমপন্থী নেতা। প্রকাশ কারাতদের তুলনায় কিছুটা বিপ্রতীপে ছিল তাঁর অবস্থান। কংগ্রেসের সঙ্গে সমন্বয় রেখে চলতেন। এবং দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের পক্ষপাতী ছিলেন না তিনি, যা ছিল প্রকাশ কারাতের সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থান। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে দল থেকে বহিষ্কার করারও বিরুদ্ধে ছিলেন তিনি। সীতারাম বরাবরই বাংলা লাইন মেনে চলা নেতা। ১৯৯৬ সালে জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রী হন সেটাও তিনি চেয়েছিলেন। কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রক এবং বিদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বামপন্থী ও সমাজতান্ত্রিক দলগুলির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘদিন। তাঁর মৃত্যুতে সেই কাজও ক্ষতিগ্রস্ত হল নিঃসন্দেহে। সীতারামের পরে সাধারণ সম্পাদক কে হবেন এই নিয়ে আলোচনা চলছিল, প্রকাশ কারাতও তাতে রাজি ছিলেন। সাধারণত দু’বার সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর তৃতীয়বারের জন্য এই পদে থাকার প্রথা দলে ছিল না। এখন সেসবের ঊর্ধ্বে চলে গেলেন সীতারাম।