স্বপনকুমার মণ্ডল
বাঙালির মূল্যবোধে নারীর অস্তিত্ব মূলত দেবী আর দাসীত্বে আবর্তিত। শ্রেষ্ঠত্ববোধে নারীর পরিচয় দেবীর মধ্যে ব্রাহ্মণ্য আভিজাত্যও বর্তমান। অব্রাহ্মণ হলেই দেবী দাসী হয়ে ওঠে। অন্যদিকে দাসীর দীনহীন প্রকৃতি হলেও তার মধ্যে মানবিক অস্তিত্বই স্বাভাবিকতা লাভ করে। সেক্ষেত্রে দেবীত্বের অসাধারণত্ব শুধু সম্ভ্রম জাগায় না,বরং দূরত্বও তৈরি করে। বাস্তবের রক্তমাংসের মানুষের পরিচয় সেখানে অপ্রত্যাশিত। দেবীত্বের মুখোশে তার মানবীজীবনই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সেখানে রাধার পরকীয়া তত্ত্ব যাও-বা সাধারণ্যে প্রচার লাভ করেছে,স্বকীয়ায় তা মেলেনি। বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে রসের সেরা মধুর। সেখানে বাৎসল্য রসের আবেদন মুখর হয়ে ওঠে না। ননীচোরা বালগোপালের পরিচয় জন্মাষ্টমীর মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে পড়ে। অন্যদিকে শাক্ত পদাবলিতে বাৎসল্য রসই রসিক বাঙালিকে আপন করে নেয়। বৈষ্ণব ধর্মের প্রচার অচিরেই থেমে যায়,শাক্ত ধর্মও সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। অথচ উমাকে নিয়ে বাঙালি উন্মাদনা আজও সচল। শারদীয় দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র আবর্তিত বাঙালি জীবনে দুর্গার মধ্যে উমা রূপের পরিচয় সমুজ্জ্বল। এই উমা বাঙালির ঘরের মেয়ে। বাংলা সাহিত্যেও আমরা অন্য এক উমাকে পাই,সেও এক দুর্গা,বাঙালির রক্তমাংসের মানবী মূর্তি। সে প্রতিমা হয়ে ওঠেনি,তাকে মানুষ করেই গড়ে তোলা হয়েছে।
সেই অন্য দুর্গা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’র অপুর দিদি,আমাদের শৈশবের চিরকেলে সাথী। বাংলা সাহিত্যে নারীর নানারূপের কথা নানাভাবে উঠে এসেছে। বিশেষত পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতিজাত নবচেতনায় নারী জীবনের পরিচয়ে প্রগতিশীল মানসিকতা আন্তরিক হয়ে ওঠে । সেই নবচেতনায় প্রথম আলোকিত ব্যক্তিত্ব মাইকেল মধুসূদন দত্তই নারীর ছকবন্দি জীবন থেকে বেরিয়ে আসার পরিচয়কে নিবিড় করে তোলেন। ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এর প্রমীলা বা মন্দোদরী থেকে ‘বীরাঙ্গনা’র বীরাঙ্গনা সবেতেই তার পরিচয় মুখর। অথচ সেখানে নারীর শৈশবই উপেক্ষিত। আবার বাংলা গীতিকবিতার ধারায় নারীর প্রেয়সী ও শ্রেয়সী রূপের পরিচয়েও তা অপ্রাসঙ্গিক। সেখানে নারীকে নিয়েই ‘মহিলা কাব্য’ রচিত হয়েছে। নারীর কন্যা-বধূ-মাতাকে নিয়ে কাব্যচর্চা হলেও শৈশবে বেড়ে ওঠা জীবনের কথা গুরুত্ব লাভ করেনি। সেদিক থেকে বিদ্যাসাগরের ‘প্রভাবতী সম্ভাষণ’-এ প্রভাবতীর মৃত্যুশোকেও শৈশব জেগে ওঠে না। রবীন্দ্রনাথের গল্পেও নারীজীবনের দুঃখ কষ্ট উঠে এলেও তাতে শৈশব পুরুষের ছায়াতেই কায়া বিস্তার করে। শরৎচন্দ্রের মধ্যেও নারীর দ্বৈত সত্তা। একটি মাতৃরূপা,অন্যটি নারীরূপা। রবীন্দ্রনাথের নারীত্বে প্রেরণাস্বরূপ মাধুর্য ও পুরুষের লীলা সঙ্গিনীরূপ লালিত্য গুণ বর্তমান। সেখানে ‘কাবুলিওয়ালা’র মিনি ছাড়া কারও শৈশব বাঙালিমানসে নিবিড় নয়। আর সেখানেই বিভূতিভূষণের দুর্গা শুধু অভিনব নয়,নারীর আকাঁড়া শৈশবের মানসপ্রতিভূ।
আসলে বিভূতিভূষণ বাংলা সাহিত্যে অজান্তেই অভিনব সংযোজন করেছেন। দুর্গা তাঁর অভিনব সৃষ্টি। ইতিপূর্বে বাংলা সাহিত্যে এই দুর্গা ছিল না। যা ছিল,তাও তাঁর সৃষ্টি। তাঁর ‘পুইমাচা’ গল্পের ক্ষেন্তিতে দুর্গার শুভ সূচনা। অন্যদিকে ”পথের পাঁচালী’র প্রথম পাণ্ডুলিপিতে দুর্গা চরিত্রটিই ছিল না। বিভূতিভূষণ পরে বিহারের এক দেহাতি কিশোরীকে দেখে দুর্গা চরিত্রটি গড়ে তোলেন। বাংলার ধুলোমাটিতে গড়ে তোলা দুর্গা অপুর বৈপরীত্যে সজীব হয়ে উঠলেও তার অনন্যতা স্বকীয় বিশেষত্বে প্রতীয়মান। এজন্য অপুর দিদির সম্পর্কেই চরিত্রটি নিঃস্ব হয়ে যায়নি,একাকীই বাঙালি নারীর শৈশবের বাতিঘরটি সে জ্বেলে দিয়েছে। শুধু তাই নয়,তার মধ্যে কল্পনাপিয়াসী ভাইয়ের জীবন রক্ষা করার সহজাত মাতৃত্ববোধের পরিচয়ও বর্তমান। বিস্ময়মুগ্ধ বালক অপুকে বাস্তব জগতের সঙ্গে পরিচয় করেই তার ভূমিকা শেষ হয়ে যায়নি, প্রকৃতির অবারিত খাদ্যের আস্বাদনে ভরপুর জীবনের হাতছানিতের তার শৈশবেই অপু প্রকৃতির রূপসুধার পাঠ পেয়েছিল। অবজ্ঞা অবহেলায় দুর্গা চরিত্রটিই সেখানে সজীব হয়ে ওঠে। অপুর কল্পনাপিয়াসী বিস্ময়মুগ্ধতা তাকে যেমন সাধারণে অসাধারণ করে তোলে, তেমনই দুর্গার অতি সাধারণ প্রকৃতিকেই একান্ত আপন মনে হয়। বিভূতিভূষণ কোনো ভাবেই দুর্গাকে অসাধারণ করে তোলেননি। তার পেটের ক্ষুধা,মনের অতৃপ্তি,চোখের লোভী চাউনি কোনো কিছুই বাদ পড়েনি। অশিক্ষায় কুসংস্কারে আচ্ছন্ন মনের চলনে তার ঘরের অবজ্ঞা তাকে পর করে তুললেও বনে বাদাড়ে সে নিজেকে খুঁজে নেয়। বনজঙ্গলের ফলমূলে সে তার রসনাতৃপ্তি করে,অভাববোধে চুরি করেও অস্বীকারে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। অথচ ভাইটির প্রতি তার গভীর টান,অনন্ত প্রত্যাশা। এভাবে নির্বিরোধী মনোভাবে চিরকেলে ভাইবোনের শৈশবের পরিচয় আমাদের আবেগঘন করে তোলে। বিভূতিভূষণের দুর্গা দুর্গতিনাশিনী নয়, উমাও নয়,একান্তই ‘পথের পাঁচালী’র দুর্গা। জীবনের পাঁচালিতে তার সজীব প্রকৃতির অভাব দীর্ঘ দিনের। পল্লিবাংলার ঘরের মেয়েদের শৈশবের পরিচয় মিটিয়ে বিভূতিভূষণ প্রকৃত অর্থেই শারদ সাহিত্য উপহার দিয়েছেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য,১৯২৯-এর মহালয়ার দিনেই ‘পথের পাঁচালী’ বই আকারে প্রকাশিত হয়। তাঁর মৃন্ময়ী নয়,চিন্ময়ীও নয়,একেবারেই বাংলার ঘরের মেয়ে এই দুর্গা। বিভূতিভূষণের দুর্গা অপুর কাছে শুধু রেলগাড়ি দেখতে চেয়েছিল। সত্যজিৎ রায় তাঁর সিনেমায় রেল দেখার জন্য কাশবনের মধ্যে দিয়ে ছুটে চলা অপুদুর্গাকে দেখিয়েছেন। বিভূতিভূষণের দুর্গার মধ্যে সুপ্ত বাসনাকেই সত্যজিৎ মূর্ত করে তুলেছেন। সেই শরতের কাশফুলেই দেবী দুর্গা জেগে ওঠে,অন্য দুর্গাও হাতছানি দেয়। সে দুর্গা মানুষ ও প্রকৃতির মেলবন্ধনে গড়ে তোলা অপূর্ব মানসী স্বরূপা। তার শরীরে মাটির গন্ধ, মুখে বাংলার আকাঁড়া রূপ,মনে জীবনের সতেজতার পরম পরশ। আর হৃদয়ে বেঁচে থাকার সকরুণ আর্তি। বিভূতিভূষণ সর্বজয়ার আত্মজা করেই দুর্গাকে সৃষ্টি করেছিলেন। বেঁচেবর্তে থাকার জীবন সংগ্রামেই আত্মতৃপ্ত বাঙালি নারীর সত্তায় আমৃত্যু সংগ্রামী। তাদের শৈশব থেকেই ধনে-মনের দারিদ্রের অসুরের সঙ্গে লড়াই করেই মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে হয়। দুর্গা সেই লড়াইয়ে অপরাজিতা। তার মৃত্যু হলেও জীবনীশক্তিতে সে দারিদ্রপীড়িত বাঙালির চিরকালীন শিশুসাথী।