পুলক মিত্র
আর জি কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসককে খুন ও ধর্ষণের ঘটনায় উত্তাল গোটা রাজ্য। প্রতিবাদের আগুন বাংলা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে দেশের রাজ্যে রাজ্যে। এমনকি বিদেশেও। ঘটনার পর ৩ সপ্তাহ কেটে গেলেও, বিক্ষোভ থামেনি। প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও প্রতিবাদে সামিল হচ্ছে মানুষ। প্রধান বিরোধী দল হিসেবে ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে জোরকদমে ময়দানে নেমে পড়েছে বিজেপি। পিছিয়ে নেই সিপিএম-ও। ‘দফা এক, দাবি এক, মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ’ – বিজেপির এই স্লোগানে গলা মিলিয়েছে সিপিএম। বিজেপির মতো তারাও আর জি করের ঘটনার রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
খাতায় কলমে বিরোধী দল হলেও, বাংলায় আজ সিপিএম কার্যত অস্তিত্বহীন। একবার মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিলে, কী দুর্দশা হতে পারে, তার জ্বলন্ত উদাহরণ হল সিপিএম। এই দলটির নেতারা যতই আস্ফালন করুন না কেন, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এখনও সিপিএমকে বিশ্বাস করেন না। কারণ, ৩৪ বছরের বাম জমানার একের পর এক কলঙ্কিত অধ্যায়।
এবারের লোকসভার নির্বাচনের ফলাফলে রাজ্যে সিপিএমের দুরবস্থার আরও একবার প্রমাণ মিলল। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনেই বাংলায় শূন্য হয়ে গিয়েছিল সিপিএম। এরপর ২০২১-এর বিধানসভা, ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনেও সেই শূন্যের গেরো থেকে মুক্তি মেলেনি। একগুচ্ছ তরুণ মুখকে ভোটের ময়দানে নামিয়েও কার্যসিদ্ধিতে ব্যর্থ রাজ্যের এক সময়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপ এই বামদল।
এবারের লোকসভা নির্বাচনে সিপিএম প্রার্থী দিয়েছিল ২৩টি আসনে। তার মধ্যে করে ২১টিতেই জামানত জব্দ হয়েছে। মাত্র একটি আসনে দ্বিতীয় স্থানে পেয়েছে। সেটি হল, মুর্শিদাবাদ আসন, যেখানে প্রার্থী হয়েছিলেন দলের রাজ্য সম্পাদক তথা পলিটব্যুরোর সদস্য মহম্মদ সেলিম।
এক একটা করে ভোট হয়, আর সেই ভোটে শোচনীয়ভাবে হারের পর দলের নেতারা কারণ বিশ্লেষণে নেমে পড়েন। কিন্তু ভাগ্য বদলায় না।
সিপিএমের ৩৪ বছরের শাসনকালে রাজ্যবাসীকে প্রতিনিয়ত যে চরম নৈরাজ্যের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে, তা এখনও দগদগে ঘা-এর মতো রয়েছে। গত ১৩ বছর পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় নেই সিপিএম। ত্রিপুরা থেকেও বিদায় নিয়েছে। এখন একমাত্র শিবরাত্রির সলতের মতো টিমটিম টিকে রয়েছে কেরলে। তবুও দলের ঔদ্ধত্য, অহঙ্কার এখনও সেই আগের মতোই। আর দলের নেতাকর্মীদের এই ঔদ্ধত্যই দলটিকে খাদের কিনারে নিয়ে এসেছে।
শুধু তাই নয়, সিপিএমের হাত ধরে এই রাজ্যে ডুবতে হয়েছে কংগ্রেসকেও। আসলে সিপিএমের রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা এখন তলানিতে। এক সময়ের চরম শত্রু কংগ্রেস এখন সিপিএমের পরম বন্ধু। আবার সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অভিযোগ তুলে যে বিজেপিকে এখন সিপিএম নেতারা তুলোধোনা করেন, এক সময় সেই বিজেপির সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে রাজীব গান্ধীকে ক্ষমতাচ্যুত করতে আদাজল খেয়ে দেশজুড়ে আন্দোলনে নেমেছিলেন তাঁরা।
সিপিএমের রাজনৈতিক দ্বিচারিতা আর ভণ্ডামি এখন মানুষের কাছে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। দ্বিচারিতার রাজনীতির মধ্যে দিয়েই এই দলটির জন্ম। স্বাধীনতার পর জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এবং কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তোলে ভারত।
কিন্তু সিপিআই-এর নেতাদের একাংশ এই সম্পর্ককে সুনজরে দেখেননি। দল ভাগের পর তাঁরাই সিপিএমে যোগ দেন। ১৯৬৪ সালের ৭ নভেম্বর সিপিআই ভেঙে তৈরি হয় সিপিআই (এম)। যে চিন বারবার ভারতীয় ভূখণ্ডে আঘাত হেনেছে, ভারত দখলের চেষ্টা চালিয়েছে, সেই চিনের সঙ্গেই সখ্যতা গড়ে তোলে সিপিএম।
এবারের লোকসভা নির্বাচনে প্রবল শক্তিধর বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলি ‘ইন্ডিয়া’ জোট তৈরি করেছিল। সেই জোটে সিপিএম যেমন ছিল, তেমনই ছিল তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্তু সিপিএম নেতারা এই রাজ্যে তৃণমূলের বিরুদ্ধে লাগাতার আক্রমণ শানিয়ে গেছেন। মমতা ব্যানার্জিকে বারবার নিশানা করেছেন।
বিজেপিকে মূল শত্রু চিহ্নিত করে বিরোধী নেতারা এবারের নির্বাচনে একজোট হয়ে লড়াইয়ে নেমেছিলেন। আর ভোট প্রচারে সিপিএম নেতাদের ভাষণ শুনে মনে হয়েছে, বিজেপি নয়, তৃণমূলই যেন প্রধান শত্রু। মমতার জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলিকে জনমানসে খাটো করার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন তাঁরা। যে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা পেয়ে বাংলার লক্ষ লক্ষ দুঃস্থ পরিবার উপকৃত হচ্ছেন, সেই লক্ষ্মীর ভাণ্ডারকে উপহাস করে চলেছেন সিপিএম নেতারা। ভারতের মতো জনকল্যাণকর এ ধরনের প্রকল্পের প্রয়োজন রয়েছে, ৩৪ বছরের জমানায় তা একবারও এই দলের নেতাদের মাথায় আসেনি।
মমতা ব্যানার্জির সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক প্রকল্প হল ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’। মমতাকে অনুসরণ করে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মতো প্রকল্প চালু করা হচ্ছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা কন্যাশ্রী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মতো প্রকল্পের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ব্যতিক্রম শুধু সিপিএম। দলের নেতাদের মুখে বারবার লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পকে ‘উৎকোচ’ বলে কটাক্ষ করতে শুনেছি।
লোকসভা নির্বাচনে শোচনীয় ফল নিয়ে দলের অন্দরে এখনও কাটাছেঁড়া চলছে। লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মতো প্রকল্পের সমালোচনা যে সঠিক ছিল না, সম্প্রতি দলের এক চিঠিতে তা স্বীকার করা হয়েছে। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, “জনগণের মধ্যে, বিশেষ করে মহিলাদের মধ্যে তৃণমূলের প্রতি সমর্থনের অন্যতম উপাদান হল লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মতো কিছু প্রকল্প ও জনকল্যাণমূলক ব্যবস্থা। কিছু পার্টি ইউনিট বা কর্মীদের ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই সব প্রকল্পকে উৎকোচ বা ‘ডোল’ বলে চিহ্নিত করার প্রবণতা রয়েছে, যা গরিব মানুষকে আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে।”
ইন্ডিয়া জোটে সামিল হয়েও, জোট রাজনীতির ধর্ম মানেনি সিপিএম। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে সিপিএম। অথচ তৃণমূলও ইন্ডিয়া জোটের শরিক। অন্যদিকে, কেরলে সেই কংগ্রেসের বিরুদ্ধেই সরাসরি নির্বাচনী যুদ্ধে শামিল হয়েছিল এই দল। এমনকি ওয়েনাড়ে রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধেও প্রার্থী দেওয়া হয়েছিল। তাতেও অবশ্য সিপিএমের কার্যসিদ্ধি হয়নি। কেরলে সিপিএম শাসন ক্ষমতায় থাকলেও, লোকসভায় ভরাডুবি এড়াতে পারেনি।
ওই রাজ্যের লোকসভার ২০টি আসনের মধ্যে ১৪টিতেই জয় পেয়েছে কংগ্রেস। অন্যদিকে, সিপিএম জিতেছে মাত্র একটি কেন্দ্রে।
অতীতে ইউপিএ সরকারকে সমর্থন দিয়েও, বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল সিপিএম। ২০০৮ সালে আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তি ইস্যুতে মনমোহন সিং সরকারের ওপর থেকে সমর্থন তুলে নিয়ে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ওই সরকারকে সঙ্কটে ফেলার চেষ্টা করেছিল সিপিএম। তবে শেষ পর্যন্ত অবশ্য তাদের কার্যসিদ্ধি হয়নি।
তৃণমূলের বিরুদ্ধে আন্দোলন বা মমতা ব্যানার্জির পদত্যাগ সিপিএম চাইতেই পারে। কিন্তু তার আগে নিজেদের রাজনৈতিক অতীতটাও দেখা উচিত সিপিএম নেতাদের। যাবতীয় গণতান্ত্রিক রীতিনীতি, মূল্যবোধকে সিপিএম কীভাবে কলঙ্কিত করেছে, তা রাজ্যের মানুষের স্মৃতিতে দগদগে ঘা-এর মতো রয়ে গিয়েছে।
তাই আরজি করের মতো নারকীয় ঘটনার নিন্দা বা প্রতিবাদ, যাই করুন না কেন, আগামী এক, দেড় দশকের মধ্যে সিপিএমের ক্ষমতায় ফেরা কঠিন। এই বাস্তব সত্য সিপিএম নেতারা বুঝতে পেরেছেন। তাই নানাভাবে বিজেপির আন্দোলনে ইন্ধন দিচ্ছেন তাঁরা, যা বাংলার রাজনীতি সচেতন মানুষের না বোঝার কথা নয়। তাই বলছিলাম, অন্যের দিকে তির ছোঁড়ার আগে, আয়নায় নিজেদের মুখ দেখুক সিপিএম।