• facebook
  • twitter
Thursday, 19 September, 2024

ছাত্রদের জন্য পত্রিকা-প্রকাশ করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন মাস্টারমশায়

ছোটদের জন্য শুধু পত্রিকা-প্রকাশ করেই থেমে থাকেননি, ছোটদের কথা ভেবে প্রমদাচরণই প্রথম উপন্যাস-রচনায় প্রয়াসী হয়েছিলেন।

পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়

বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম ছোটদের পত্রিকা কী, এ কথার উত্তরে নির্দ্বিধায় ‘সখা’র কথা বলতে হয়। ভাবতে ভালো লাগে, এই পত্রিকাটির যিনি সম্পাদনা করতেন, তিনি ছিলেন একজন মাস্টারমশায়। মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষকতা করতেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে‌ অবস্থিত সিটি কলেজিয়েট স্কুলে। এই স্কুলে বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকজন খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব শিক্ষকতা করেছন। ছোটদের প্রিয় লেখক ‘হাসিখুশি’- প্রণেতা যোগীন্দ্রনাথ সরকারও এই স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। পরবর্তীকালে যোগীন্দ্রনাথ ‘মুকুল’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হয়েছিলেন। ‘মুকুল’ যিনি সম্পাদনা করতেন, তিনিও ছিলেন মাস্টারমশায়। হেয়ার স্কুলের হেড মাস্টারমশায় শিবনাথ শাস্ত্রী ।
প্রমদাচরণের ‘সখা’ ছিল যথার্থঅর্থেই সর্বাঙ্গীণ ছোটোদের পত্রিকা।

‘সখা'(১৮৮৩) প্রকাশের আগে ছোটোদের পত্রিকার আভাস লক্ষ করা গেলেও সত্যিকারের ছোটোদের পত্রিকার সন্ধান পাওয়া যায়নি। দু-একটি ক্ষেত্রে শিশু-পত্রিকার আভাস থাকলেও সর্বাঙ্গীণ ছোটোদের পত্রিকা হয়ে ওঠেনি। পত্রিকায় স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি ছোটদের মনের খবর। তাদের মনের খবর প্রথম প্রমদাচরণই জানতে পেরেছিলেন। স্কুলে শিক্ষকতা করার ফলে তাঁর সঙ্গে ছোটদের দৈনন্দিন যোগাযোগ ছিল। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন ছোটরা কী চায়, ঠিক ছোটদের মনের মতো করে সাজিয়েছিলেন ‘সখা’র প্রতিটি সংখ্যা। প্রথমে প্রমদাচরণের সামনে অবশ্য বৃহত্তর ছোটরা ছিল না। ছিল তাঁর মুষ্টিমেয় ছাত্র। এই ছাত্রদের মধ্য দিয়েই তিনি অনুভব করেছিলেন বৃহত্তর ছোটদের।

অনেক অসহায়তা, অনেক বিড়ম্বনা অতিক্রম করে ‘সখা’ প্রকাশ করতে গিয়ে ঘটেছিল কত না বিপত্তি! তিলে তিলে প্রাণ দিতে হয়েছিল তাঁকে। প্রমদাচরণ শিক্ষকতা করতেন সিটি কলেজিয়েট স্কুলে। সিটি কলেজিয়েটের আগে পড়াতেন চব্বিশ পরগনার বাঁকিপুরে। সে-স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন তিনি।সিটি কলেজিয়েট থেকে মাইন পেতেন মাসে ছাব্বিশ টাকা। একা মানুষ, বিয়েশাদি করেন নি,মাইনের টাকায় সচ্ছলতায় দিন কেটে যাওয়াই স্বাভাবিক ছিল। বাস্তবে অবশ্য তেমন হয়নি। বাড়ি থেকে বিতারিত তিনি। বাবা ছিলেন রাশভারী মানুষ। পেশাগত কাঠিন্য তাঁর দৈনন্দিন জীবনকেও স্পর্শ করেছিল। তিনি ছিলেন এণ্টালি থানার দারোগা। ব্রাক্ষ্মধর্মের প্রতি প্রমদাচরণের দুর্বলতা ছিল, ব্রাক্ষ্মধর্ম গ্রহণও করেছিলেন। রাগে ক্ষোভে পুত্র প্রমদাচরণকে পিতৃদেব ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন। ফলে একা থাকতেন তিনি। ছাত্র নিয়েই তাঁর দিন কাটত। ছাত্ররাই ছিল ধ্যান-জ্ঞান।‌ মাইনের টাকার অনেকটাই ব্যয় করতেন ছাত্রকল্যাণে। তাদের প্রয়োজন মেটাতেন। অবশিষ্ট টাকায় নিজের জীবন-নির্বাহ। সেই জীবন-নির্বাহে, প্রতিদিনের স্বাভাবিক খাদ্যগ্ৰহণে শেষে নিরুপায় হয়েই কাটছাঁট করেছেন। চরম ক্লিষ্টসাধন, পত্রিকা-প্রকাশের জন্য অর্থ-সঞ্চয় করতে গিয়ে চলেছে নিজের উপর অত্যাচার-অবহেলা। দু’ বেলা দু’মুঠো ডাল-ভাত খেয়ে দিন কেটেছে, সকালে বিকেলে একটুও জলখাবার খাননি।
সিটি কলেজিয়েট স্কুলে প্রমদাচরণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘নীতি-বিদ্যালয়’। এই নীতি বিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ে গিয়েছিলেন বরানগরে, আনন্দ-ভ্রমণে। বিপিনচন্দ্র পাল ছিলেন প্রমদাচরণের প্রিয় বন্ধু। অকাল প্রয়াত বন্ধুর একটি জীবনী রচনা করেছিলেন তিনি।ওই বইতে আছে পত্রিকা-প্রকাশ করতে গিয়ে কী কষ্টই না তিনি হাসি-মুখে সহ্য করেছিলেন।

শিবনাথ শাস্ত্রীর লেখাতেও রয়েছে সে কথা। শিবনাথ ছিলেন প্রমদাচরণের মাস্টারমশায়। প্রমদাচরণ যখন হেয়ার স্কুলের ছাত্র ছিলেন, তখন তিনি ছিলেন হেড মাস্টারমশায়। প্রমদাচরণের মৃত্যুর পর ‘সখা’র পাতাতে প্রিয় ছাত্রের কথা লিখেছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রী। জানিয়েছিলেন, ছোটদের প্রতি তাঁর ছাত্রটির কী গভীর ভালোবাসা ছিল।

বরানগরের বাগানবাড়িতে গিয়ে ভ্রমণ-আনন্দের মধ্যেই ছাত্ররা জানতে পেরেছিল, তাদের জন্য‌ প্রিয় মাস্টারমশায় প্রমদাচরণ সেন পত্রিকা প্রকাশের কথা ভাবছেন। জেনে খুবই আহ্লাদিত হয় তারা। প্রমদাচরণ কথা তো দিলেন, কিন্তু পত্রিকা-প্রকাশের টাকা কোথায় পাবেন! বন্ধুবান্ধবদের কাছে টাকা ধার চেয়ে নিরাশ হতে হল তাঁকে। হেরে যাবেন তিনি, পত্রিকা-প্রকাশের যে স্বপ্ন দেখেছেন, তা বিফলে যাবে, তা তো হতে পারে না!

শুরু হল পত্রিকা প্রকাশের জন্য ভিন্নতর উপায়ে অর্থ-সঞ্চয়। দুধ খাওয়া বন্ধ করে, জলখাবার খাওয়া বন্ধ করে দু’বেলা দু’মুঠো ডাল-ভাত খেয়ে টাকা জমাতে শুরু করলেন তিনি। সেই টাকায় ১৮৮৩ সালের জানুয়ারিতে ‘সখা’ প্রকাশিত হয়। ‘সখা’ হাতে নিয়ে, পড়ে অভিভূত হয়েছিলেন স্বয়ং সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র।

এইভাবে শরীরকে কষ্ট দিয়ে কত দিনই বা সুস্থ থাকা যায়! পত্রিকা-প্রকাশ করতে গিয়ে মাস্টারমশায় প্রমদাচরণ নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। বলা যায়, ছাত্রদের দেওয়া কথা রাখতে অকালে অসময় বেঘোরে তিনি মৃত্যুকে বরণ করেছিলেন।

ছোটদের জন্য শুধু পত্রিকা-প্রকাশ নয়, ছোটদের কথা ভেবে প্রমদাচরণই প্রথম উপন্যাস-রচনায় প্রয়াসী হয়েছিলেন। বাংলা সাহিত্যে সাবালকপাঠ্য প্রথম সার্থক উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’ (১৮৬৫)। ‘দুর্গেশনন্দিনী’ প্রকাশের প্রায় আঠারো বছর পর প্রকাশিত হয় ছোটদের জন্য লেখা প্রথম সার্থক উপন্যাস প্রমদাচরণ সেনের ‘ভীমের কপাল’ (১৮৮৩)। ‘ভীমের কপাল’ ‘সখা’তেই ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয়েছিল। প্রথম সংখ্যা থেকে পর পর দশ সংখ্যা,জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় জীবনরসে ভরপুর এই উপন্যাসটি।

‘সখা’-র পাতায় প্রমদাচরণের ছড়াও ছাপা হয়েছে। মৌলিক ছড়াচর্চার সেই তো শুরু।‌‌সম্পাদক প্রমদাচরণ ছিলেন পাকা জহুরি, জহর চিনতে তাঁর ভুল হয়নি। বলা যায়, তিনিই উপেন্দ্রকিশোরের আবিষ্কারক। উপেন্দ্রকিশোরের প্রথম লেখা ‘সখা’তেই ছাপা হয়েছিল। দ্বিতীয় সংখ্যায় তিনি লিখেছিলেন ‘মাছি’ নামে একটি গদ্যরচনা। এরপর আরও আরও অনেক লেখা। তাঁর সম্পাদনার পাঠ তো প্রমদাচরণ সেনের কাছে। সেই পাঠের সার্থক রূপায়ণ ঘটে ‘সন্দেশ’-র কালে। পত্রিকার জন্য প্রমদাচরণ যে ত্যাগ ও তিতিক্ষা স্বীকার করেছিলেন, তার কোনো তুলনা হয় না। নিজেকে কষ্ট দিয়ে অর্থ সঞ্চয় করে’ সেই অর্থে পত্রিকা প্রকাশে তৎপর হয়েছিলেন, আমি দৃষ্টান্ত আর দ্বিতীয়টি নেই। সীমাহীন অত্যাচার শরীর সইবে কেন! পত্রিকা প্রকাশের পরই শরীর প্রতিশোধ নিয়েছে। অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তিনি। মুখ দিয়ে রক্ত পড়েছে। বুকে মারণরোগের কীটরা বাসা বেঁধেছে। এই অবস্থাতেওই চলেছে তাঁর পত্রিকার সম্পাদনা কাজ। ছোটোদের তিনি কথা দিয়েছিলেন, তাদের জন্য পত্রিকা প্রকাশ করবেন। সে কথা যে তাঁকে রাখতেই হবে। কোনোভাবে থেমে পড়লে চলবে না।

কথা শুধু রাখেননি, প্রমদাচরণের নিরন্তর চেষ্টায় ‘সখা’ হয়ে উঠেছিল ছোটোদের এক আদর্শস্থানীয় পত্রিকা। পত্রিকাটির পাতায় পাতায় ছিল গভীর চিন্তাভাবনার ছাপ। বলা যায়,প্রমদাচরণ ছোটোদের পত্রিকার একটি ‘মডেল’ তৈরি করেছিলেন,ছোটোরা কী চায়, কী তাদের আকৃষ্ট করতে পারে, সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা ছিল ছোটোদের সান্নিধ্যে থাকা মাষ্টারমশায় প্রমদাচরণের।

প্রমদাচরণ বেঘোরে মাত্র সাতাশ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছিলেন। তাঁর প্রয়াণের পর পত্রিকা-সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন তাঁরই মাস্টারমশায় শিবনাথ শাস্ত্রী।
প্রমদাচরণের মতো শিক্ষকরা গেলেন কোথায়!