• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

রাজ্যসভার সাংসদ পদ ছাড়ার কথা ঘোষণা জহর সরকারের, মমতার অনুরোধের পরেও সিদ্ধান্তে অনড়

একজন ছেড়েছেন, আরেকজনও ছাড়ুন। স্রোতের অনুকূলে তো কচুরিপানাও ভাসে, যদি উলটো দিকে সাঁতার কাটতে না-ই পারলেন তাহলে মানুষ জন্ম বৃথা ! যুদ্ধের সময় যারা পালায় কিংবা গা বাঁচিয়ে চলে, ইতিহাস তাদের লজ্জার নজরে দেখে।

আরজি কর কাণ্ডের জেরে রাজ্যসভার সাংসদ পদ ছাড়ার কথা ঘোষণা করলেন তৃণমূলের সদস্য জহর সরকার। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি পাঠিয়ে এ কথা জানিয়েছেন জহরবাবু। এরপর রবিবার বিকেলেই জহর সরকারকে ফোন করে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু তৃণমূল সুপ্রিমোর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছেন তিনি। সূত্রের খবর, ১১ সেপ্টেম্বর জহর সরকার দিল্লিতে যেতে পারেন। ১২ সেপ্টেম্বর তাঁর পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার কথা আছে। এদিন সাংসদ পদ ছাড়ার কথা জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে দু-পাতার চিঠি লিখেছিলেন জহর সরকার। তিনি জানিয়েছিলেন, তিনি রাজ্যসভা সাংসদ পদ ছাড়ার পাশাপাশি রাজনীতিও ছাড়তে চলেছেন। এই খবর প্রকাশ্যে আসতেই জহরকে কটাক্ষ করেছেন তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় এবং তৃণমূল নেতা দেবাংশু ভট্টাচার্য। অপরদিকে জহরের সিদ্ধান্তকে ‘ব্যক্তিগত’ বলেই মনে করেন তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ।
চিঠিতে জহর সরকার লিখেছিলেন, ‘আমি আমার দায়িত্ব পালন করলাম, কিন্তু আমার রাজ্যে দুর্নীতি আর দলের একাংশের নেতাদের অন্যায় দাপট দেখে আমি হতাশাগ্রস্ত হলাম। দেখলাম সরকার সামলাতে পারছে না।…এই মুহূর্তে রাজ্যের সাধারণ মানুষের যে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন ও রাগের বহিঃপ্রকাশ আমরা সবাই দেখিছি, এর মূল কারণ কয়েকজন কতিপয় পছন্দের আমলা ও দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পেশিশক্তির আস্ফালন। আমার এত বছরের জীবনে এমন ক্ষোভ এবং সরকারের প্রতি সম্পূর্ণ অনাস্থা আগে কখনও দেখিনি।’
চিঠিতে জহরবাবু আন্দোলনকে সমর্থনও জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘আমার বিশ্বাস, এই আন্দোলনে পথে নামা মানুষেরা অরাজনৈতিক এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিবাদ করছেন। অতএব রাজনৈতিক তকমা লাগিয়ে এই আন্দোলনকে প্রতিরোধ করা সমীচীন হবে না। এঁরা কেউ রাজনীতি পছন্দ করেন না। শুধু একবাক্যে বিচার ও শাস্তির দাবি তুলেছেন।’
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জহরবাবুর বার্তা, ‘আমি গত এক মাস ধৈর্য ধরে আরজি কর হাসপাতালের ঘৃণ্য ঘটনার বিরুদ্ধে সবার প্রতিক্রিয়া দেখেছি আর ভেবেছি, আপনি কেন সেই পুরনো মমতা ব্যানার্জির মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে সরাসরি জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলছেন না। এখন সরকার যে সব শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে, তা এককথায় অতি অল্প এবং অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।’
এদিন বিকেলে জহর সরকারকে ফোন করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । তৃণমূল সূত্রে জানা গিয়েছে, বেশ কিছুক্ষণ তাঁদের মধ্যে কথা হয়েছে। এদিন ফোনে জহরকে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার অনুরোধ জানান মমতা। কিন্তু তিনি সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন।  সূত্রের খবর, তিনি মমতাকে বলেছেন, ‘মানুষকে কথা দিয়েছি, আর ফেরা সম্ভব নয়।’ যদিও ফোনে কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে তা প্রকাশ্যে বলতে নারাজ জহর সরকার।
জহর সরকারের সাংসদ পদ ছাড়ার সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য দৈনিক স্টেটসম্যানকে বলেন, ‘জহর সরকারের মত একজন ব্যক্তিত্ব, যিনি নরেন্দ্র মোদীর কট্টর সমালোচক হিসেবে পরিচিত ছিলেন, সেই কারণেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে রাজনীতিতে ল্যাটারাল এন্ট্রি করান। রাজ্যসভার সাংসদ করেন। জহর সরকারের মতো একজন ব্যক্তি, সংসদে থাকলে সংসদেরই গরিমা বৃদ্ধি পেত। তাঁর এই পদত্যাগ সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বার্তা দিল, চলে যাও।’  অপরদিকে তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় জহর সরকারকে ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিক’ বলে কটাক্ষ করেন। তিনি বলেন, ‘দলের প্রতি কোনও কমিটমেন্ট নেই। পাবলিকের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই। ভালো কাজ করবেন ভেবে অন্য ক্ষেত্রের অনেককেই নিয়ে আসেন আমাদের নেত্রী। কিন্তু এঁদের কেউ কেউ ব্যক্তিকেন্দ্রিক। শুধু নিজেরটা ভাবেন। কোনও বিরুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হলেই পালাতে চান আর দলকে অস্বস্তিতে ফেলেন।’
আরজি কর ইস্যুতে প্রথম থেকেই দলের অস্বস্তি বাড়িয়েছেন তৃণমূলের রাজ্যসভার আর এক সাংসদ সুখেন্দুশেখর রায়। জহরের ইস্তফার পর এখন লাইমলাইট তাঁর উপর। এপ্রসঙ্গে সুখেন্দু বলেন, ‘জহর সরকারের খবর পেয়েছি। কিন্তু আমি সে বিষয়ে কোনও মন্তব্য করব না। আমি এর বিরোধিতাও করছি না। সমর্থনও নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি কখনও কোনও সিদ্ধান্ত নিলে সকলেই জানতে পারবেন। যেমন প্রতিবাদ করেছিলাম বিবেকের ডাকে। আমি নাগরিক আন্দোলনের সঙ্গে আছি। আমি নিজের ঢাক কখনও পেটাইনি। পেটাই না।’ যদিও জহর সরকারের ইস্তফার পরেই সুখেন্দুশেখর রায়কে নিয়ে কটাক্ষ করেছেন তৃণমূল নেতা দেবাংশু ভট্টাচার্য। তিনি লিখেছেন, ‘একজন ছেড়েছেন, আরেকজনও ছাড়ুন। স্রোতের অনুকূলে তো কচুরিপানাও ভাসে, যদি উলটো দিকে সাঁতার কাটতে না-ই পারলেন তাহলে মানুষ জন্ম বৃথা ! যুদ্ধের সময় যারা পালায় কিংবা গা বাঁচিয়ে চলে, ইতিহাস তাদের লজ্জার নজরে দেখে।’
জহর সরকারের এই পদক্ষেপ প্রসঙ্গে তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ বলেন, ‘জহর সরকার যা চাইছেন, সাধারণ মানুষও তা চাইছেন। এমন কিছু পয়েন্ট রয়েছে সেটা আমরাও চাইছি। আমরা সেটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে দলের মধ্যে থেকে চাইছি। আমরা চাই দল এমন কোনও পদক্ষেপ নিক যাতে সাধারণ মানুষের কিছু প্রশ্ন ও বিরক্তি প্রশমন করা যায়। এর সুযোগ নিয়ে কিছু বিরোধী দল কুৎসা করছে। যার জবাব আমরা রাজনৈতিকভাবে দেব…এর মানে এই নয় যে জহর সরকারের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের কোনও সমালোচনা করছি’।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হন, সেই সময় জহর সরকার দিল্লিতে সংস্কৃতি মন্ত্রকের সচিব ছিলেন। ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রসার ভারতীর সিইও পদেও ছিলেন প্রাক্তন আইএএস জহর সরকার। ২০২১ সালে ২ আগস্ট তৃণমূলের টিকিটে রাজ্যসভার সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত হন জহরবাবু।
জহরের এই সিদ্ধান্তকে একান্ত ব্যক্তিগত বলে মনে করছেন আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তাররা।  আরজি করের আন্দোলনরত ডাক্তার কিঞ্জল নন্দ জানান, তাঁরা যে উদ্দেশ্য নিয়ে আন্দোলন করছেন, সেটা যদি ঠিক মনে হয় তাহলে দলের বা প্রশাসনের ভিতরে থেকেই প্রতিবাদ করতে পারতেন।মমতার সঙ্গে জহরবাবুর পরিচয় অনেকদিনের। সরকারি চাকরিতে থাকার সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে নাম ধরে ডাকতেন এবং তুই বলে সম্বােধন করতেন। আর আজ, রবিবার সেই মমতাকে চিঠি লিখেই রাজ্যসভার সাংসদ পদ ছাড়ার কথা ঘোষণা করলেন প্রাক্তন এই আমলা। ২০২১ সালে সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর জহর সরকার বলেছিলেন, ‘মােদী সরকারের মুখােশ খুলে দেওয়াটাই প্রধান লক্ষ্য। দেশ সেভাবে চলছে না, যেভাবে চলা উচিত। দেশের সংসদে গিয়ে আমি সেই কথাটাই বলতে চাই।’