• facebook
  • twitter
Monday, 23 December, 2024

গোয়ার মুক্তিসংগ্রামে রামমনোহর লোহিয়ার ভূমিকা

ড. বিমলকুমার শীট ভারত কেবল ব্রিটেনের উপনিবেশ ছিল না। সেই সঙ্গে ফ্রান্স ও পর্তুগিজেরও উপনিবেশ এর মধ্যে ছিল। পণ্ডিচেরি, মাহে, কারিকল ও চন্দননগর ছিল ফরাসিদের। আর গোয়া ছিল পর্তুগিজদের। ১৯৫৪ সালে ভারতে ফরাসিদের উপনিবেশ ইতি ঘটলেও পর্তুগিজদের উপনিবেশ গোয়া হাত ছাড়া হয় ১৯৬১ সালে। কিন্তু গোয়ার মুক্তির জন্য পথ প্রদর্শক ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম

ড. বিমলকুমার শীট

ভারত কেবল ব্রিটেনের উপনিবেশ ছিল না। সেই সঙ্গে ফ্রান্স ও পর্তুগিজেরও উপনিবেশ এর মধ্যে ছিল। পণ্ডিচেরি, মাহে, কারিকল ও চন্দননগর ছিল ফরাসিদের। আর গোয়া ছিল পর্তুগিজদের। ১৯৫৪ সালে ভারতে ফরাসিদের উপনিবেশ ইতি ঘটলেও পর্তুগিজদের উপনিবেশ গোয়া হাত ছাড়া হয় ১৯৬১ সালে। কিন্তু গোয়ার মুক্তির জন্য পথ প্রদর্শক ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম কর্মী এবং একজন সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক নেতা রামমনোহর লোহিয়া (১৯১০-১৯৬৭)। তিনি ভারত স্বাধীনতা লাভের ১ বছর আগেই ১৯৪৬ সালে গোয়ার মুক্তি আন্দোলনের সূচনা করেন । তাঁর জীবদশায়ই তিনি এর ভারতভূক্তি দেখে যান।

রামমনোহর লোহিয়া উত্তরপ্রদেশের আকবরপুরে জন্মালেও বোম্বাইয়ের মারওয়াড়ী বিদ্যালয়ে পড়া শুরু করেন। এই সময় লোকমান্য তিলকের মৃত্যু হলে রামমনোহর লোহিয়া ছাত্রদের হরতাল করতে বলেন। তারপর ছাত্ররা বেরিয়ে পড়ে তিলকের গৃহের উদ্দেশ্যে। এখান থেকে শুরু হল রামমনোহরের জীবনে সংঘর্ষের অধ্যায়। গান্ধীজির ডাকে সাড়া দিয়ে দশ বছরের বালক বিদ্যালয় ছেড়ে দিলেন। কাশী বিশ্ববিদ্যালয় আই এ পাশ করেন। ১৬ বছর বয়সে পিতা হীরালালের সঙ্গে গৌহাটি কংগ্রেসে যোগ দিতে ও বেড়াতে গেলেন। পিতা ব্যবসা সূত্রে কলকাতায় বসবাস তুলে আনলে পুত্র রামমনোহরও কলকাতায় আসেন। ভর্তি হন বিদ্যাসাগর কলেজে। রাজনীতিতে প্রবেশের সেইটিই ছিল মহেন্দ্রক্ষণ। ১৯২৮ সালে কলকাতা কংগ্রেস অধিবেশনের ব্যবস্থাপনায় রামমনোহর প্রচুর খাটলেন। ঐ বৎসর সাইমন কমিশন ভারতে এলে আসমুদ্র হিমাচল রব উঠল “সাইমন ফেরৎ যাও”। কলকাতায় ছাত্রসমাজকে এই অসহযোগিতার জন্য প্রস্তুত করলেন এবং স্বয়ং তাঁর অগ্রভাগে রইলেন রামমনোহর। ১৯২৮ সালের শেষ দিকে কলকাতায় জওহরলাল নেহরুর অধ্যক্ষতায় যে যুব-সম্মেলন হয় তাতে বিষয় নির্বাচন বিভাগের সদস্য ছিলেন রামমনোহর। এই যুব-সম্মেলনে জওহরলাল ও রামমনোহর উভয়ই উভয়ের প্রতি আকৃষ্ট হলেন। রামমনোহরের মেধা, বাগ্মীতা, জ্বলন্ত দেশপ্রেম ও ধৈর্যনিষ্ঠা জওহরলালের মনে গভীর দাগ কেটেছিল। এর পর রামমনোহর বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে “লবণ সত্যাগ্রহ” বিষয়ক গবেষণা প্রবন্ধ সম্পূর্ণ করে ডক্টরেট উপাধি লাভ করে দেশে ফেরেন। ১৯৩৪ সালে কংগ্রেস Socialist Party গঠিত হলে রামমনোহর এই দলের মুখপত্র সাপ্তাহিক “কংগ্রেস সোশিয়ালিষ্ট” এর সম্পাদক নিযুক্ত হন।

১৯৩৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তারিখে এলাহাবাদে Congress Socialist Party-র একটি জনসভা হয়। সেই সভায় লোহিয়া তৎকালীন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে স্পষ্টই বলেছিলেন যে “পৃথিবীর সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি নিজ নিজ স্বার্থরক্ষার জন্য এই মহাযুদ্ধের ভূমিকা প্রস্তুত করেছে। ভারতীয় জনতা কিন্তু এ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করবে না। আর অগত্যা যদি যুদ্ধ লেগেই যায় তাহলে ভারতীয় জনতা নিজেদের স্বাধীনতার সংগ্রামের গতি তীব্র করার জন্য একে ব্যবহার করবে”। ভারত ছাড় আন্দোলন গোপনে থেকে পরিচালনা করলেন রামমনোহর লোহিয়া। ১৯৪৪ সালে ২২মে তিনি ধরা পড়লেন। ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা অতি বিচিত্র রূপ ধারণা করল। ১৯৪৪এর শেষের দিকে গান্ধি কারামুক্ত হলেন। ১৯৪৫ এর মাঝামাঝি কংগ্রেসের কার্যসমিতির সদস্যরাও মুক্তি পেলেন। লোহিয়া ও জয়প্রকাশের মুক্তি না হওয়ায় গান্ধী খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন এবং তাঁর জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেছিলেন। অবশেষে লোহিয়া ও জয়প্রকাশকে সরকার মুক্তি দিতে বাধ্য হলেন।

১৯৪৬ সালের ১০জুন জেল থেকে বেরিয়ে তখন দু-মাসও হয়নি। রামমনোহর গোয়া গিয়েছিলেন। বিশ্রাম নেবার। স্বাস্থ্য লাভ করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু সেখানে তখন এক বিরাট গোলমাল সৃষ্টি হয়েছিল। যদিও গোয়া ভারতেরই একটি অংশ। কিন্তু গত দুশ বছর সে পর্তুগালের শাসনাধীন। সেখানকার জনসাধারণের দুর্গতির আর শেষ ছিল না। বন্ধুর বাড়িতে লোহিয়া গিয়ে পৌঁছান মাত্র সারা গ্রামে হৈ হৈ পড়ে গেল। ৪২এর নায়ক এসেছেন। অধ্যাপক, বিদ্যার্থী, ব্যবসায়ী, পুলিশের কর্মচারী, কেরানী সব রকমের লোকই আসত লোহিয়ার কাছে, আর তাঁর সঙ্গে কথা বলে উদ্বুদ্ধ হত। এদের কাছেই গোয়ার সঠিক অবস্থা জানার সুযোগ পেলেন লোহিয়া। গোয়ায় কারও বাড়িতে বিয়ে হবার কথা হলে, বিবাহের নিমন্ত্রন-পত্র ছাপাতে দেবার আগে সরকারি অনুমোদন নিতে হত। লোহিয়া এই ঘটনা শুনে অবাক হলেন। তিনি স্থির করলেন- এ অন্যায়ের বিরোধিতা করতে হবে – যুদ্ধে নামতে হবে।

গোয়ার বিভিন্ন রচনাত্মক কর্মপন্থার নায়ক শ্রীপুরুষোত্তম কাকোড়কর কয়েকটি ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে লোহিয়ার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। ১৫ জুন পাঞ্জিমের সভায় লোহিয়া দু-ঘণ্টা বক্তৃতা দিলেন। সারা গোয়াতে দুশো স্বাধীনতা প্রেমিকের কাছে পোস্টকার্ড ছাপিয়ে খবর পাঠান হল। খুব সফল সভা হল। সভার খবর পেয়ে গোয়ার গভর্নর চিন্তায় পড়লেন। সভা চলাকালে তিনবার সভার আসে পাশে ঘুরে গেলেন। ১৭ জুন মণ্ডগাঁওয়ে দামোদর বিদ্যাভবনে কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি একত্রিত হলেন। সেখানে লোহিয়াকে কেউ কেউ বললেন, “আপনি মাস ছয়েক অপেক্ষা করুন। আমাদের প্রস্তুত হতে ছয় মাস সময় দিন। তারপর ফিরে এসে আপনিই আন্দোলন আরম্ভ করবেন”। এই কথায় লোহিয়া বিরক্ত হলেন।

১৮ জুন মণ্ডগাঁওএ সভা হল। শতাব্দীর পর শতাব্দীর দাসত্বে জর্জরিত ও পীড়িত জনতাও জেগে উঠল। উৎসাহ ও উদ্দীপনায় লক্ষ লক্ষ মানুষ পথে জড়ো হতে লাগল। মণ্ডগাঁওয়ের ট্রেনগুলিতে প্রতি স্টেশন থেকে হাজার হাজার যাত্রী উঠতে লাগল। সকলের মুখেই এক স্লোগান “লোহিয়া জিন্দাবাদ” “মহাত্মা গান্ধির জয়”! বন্ধুবর ডা. মেনেজিসের সঙ্গে লোহিয়া সভা ভবনের দিকে এলেন ঘোড়াগাড়ি চেপে। পুলিশ কমিশনার এসে দুজনকে গ্রেপ্তার করলেন। পরিস্থিতি অনুমান করে লোহিয়া তাঁর ভাষণটি আগেভাগেই ছাপিয়ে রেখেছিলেন। তাঁকে গ্রেপ্তার করা হতে তখন তাঁর ছাপান বক্তৃতা উপস্থিতি জনমণ্ডলীর মধ্যে বিতরণ করা হলো। বক্তৃতায় লোহিয়া বলেছিলেন, “গোয়ার জনগণের জীবন অত্যন্ত দুঃখে পরিপূর্ণ। তারা উদগ্রীব হয়ে ভারতের দিকে তাকিয়ে আছে। গোয়াবাসীরা তাঁদের সরকারের ওপর বিরক্ত কিন্তু বিরক্তি প্রকাশ করার রীতি তারা জানে না। পর্তুগালীয় সরকারের শক্তিকে আমি ভয় পাই না, কেননা, এদের থেকেও শক্তিমান যে ইংরেজ আজ তাঁর শক্তিও নিঃশেষিত হতে চলেছে।… গোমন্তবাসীরা যদি আমার কাছে নাও আসত। তাহলেও আমি চুপ করে বসে থাকতাম না। গোয়া ভারতের অংশ আর আমি ভারতবাসী। প্রত্যেক ভারতীয়র কর্তব্য গোমন্তবাসীকে সাহায্য করা”। বক্তৃতাটি ভারতীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত হল এবং গোয়ার সমস্যা এরপর থেকে প্রত্যেক ভারতবাসীর নিজস্ব চিন্তা ও সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
গোয়ার প্রতিটি শহরে হরতাল। শান্ত গোমন্তক ভূমি যুদ্ধভূমিতে পরিণত হল। গোয়াবাসি মিউনিসিপ্যাল ভবনের কাছের চকের নাম বদলে রাখল, ‘লোহিয়াচক’ আর রোজ সেখানেই সভা হতে লাগল। এর মধ্যে হঠাৎ লোহিয়া ও ডা. মেনেজিসকে ছেড়ে দেওয়া হল। সরকার হার স্বীকার করল। এতকাল পরে সরকারি আদেশপত্র বেরুল, তার দ্বারা জানানো হল যে, সভা করতে বা বক্তৃতা দিতে সরকারি মঞ্জুরির প্রয়োজন নেই। গোয়ার সীমান্ত পথে লোহিয়াকে বোম্বের পথে ছেড়ে দেওয়া হল।

কিন্তু ভারতের স্বাধীনতার প্রাক্কালে গোয়ার মুক্তি নিয়ে জাতীয় নেতাদের মধ্যে তীব্র মনান্তর হল। জওহরলাল নেহরু বোম্বেতে বললেন, “ছোট ছোট লড়াইয়ের পরম সুন্দর অবয়বের উপর গোয়া এক বিষফোড়া। ভারত স্বাধীন হবার পর ওটিকে আঙ্গুলের চাপে গেলে ফেলতে সময় লাগবে না”। নেহরুর বিবৃতির উত্তরে ১২ জুলাই লোহিয়া পাল্টা বিবৃতি দিলেন। বললেন, “মানছি কাশ্মীর নামক ফোড়ার তুলনায় এই প্রথম ফোড়াটি ভারতের মুখাবয়বকে কমই হতশ্রী করছে। কিন্তু ভারতের যে কোনও প্রান্তের তুলনায়, গোমন্তবাসী আরও অনেক বেশী বিধিনিষেধের বন্ধনে বন্দী। গোয়ার চিন্তাশীল জনসমূহ অত্যাচারী আইনের বিরুদ্ধে সাহসিকতার সহিত রুখে দাঁড়িয়েছে। ভারতীয় জনমানসের সহানুভূতিও ওদের প্রতি যথেষ্ট আছে। আমরা গান্ধীর সমর্থন লাভ করছি। অতএব অন্য নেতাদের মতামতের প্রয়োজন আমাদের নেই”। ঠিক সেই সময় সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলও বলে বসলেন যে গোয়ার মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে আমাদের কোনও যোগ নেই। লোহিয়ার সব চাইতে বড় আঘাত লাগল যখন জয়প্রকাশ বললেন যে গোয়ার ব্যাপার নিয়ে এত মাথা ঘামাবার প্রয়োজন নেই, তাঁর থেকে আরও অনেক বেশী প্রয়োজনীয় কাজ আমাদের সামনে আছে এখন।

গান্ধিজি কিন্তু লোহিয়াকে সমর্থন করলেন। ১৪ আগস্ট ১৯৪৬-এর “হরিজন” গর্ভনরের চিঠির উত্তরে গান্ধি লিখেলেন, হতে পারে, ডা. লোহিয়া ও আমি রাজনীতিতে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করি । তিনি মানুষকে আত্মসচেতন করেছেন, তাঁকে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছেন, এই কারণে উনি আমার প্রশংসার পাত্র। ডা. লোহিয়া তাঁদের প্রাণে যে বিদ্রোহের মশাল প্রজ্বলিত করেছেন তা যদি গোয়াবাসীরা নিভে যেতে দেন তাহলে সেটাই তাঁদের পক্ষে বিপজ্জনক হবে। আপনারা এবং গোয়াবাসী উভয়েরই উচিত ডা. লোহিয়াকে এই মশাল প্রজ্বলিত করার জন্য ধন্যবাদ জানানো–”।
লোহিয়া কিন্তু একাই গোয়ার ঢাক পেটানোর কাজ চালিয়ে গেলেন। পুনরায় তিনি গোয়া যাত্রা করলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ফলে গোয়ার সভা মিছিল, ধর্মঘটের বান ডাকল। গোয়া সরকার পাঁচ বছরের জন্য লোহিয়ার গোয়া প্রবেশ নিষিদ্ধ করল। অবশেষে ১৯৬১ সালে ১৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু সেনা পাঠিয়ে গোয়াকে ভারতভূক্ত করলেন। শেষ হাসি হাসলেন রামমনোহর লোহিয়া।