• facebook
  • twitter
Monday, 25 November, 2024

ব্ল্যাক ট্যুরিজমই এখন টানছে

কিছু পর্যটকদের মধ্যে এমন কিছু স্থানে ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছা জাগছে যেসমস্ত স্থানের সঙ্গে একটা সভ্যতার কালো অধ্যায় যুক্ত রয়েছে। অর্থাৎ কোনো জনশ্রুতি অনুযায়ী ভৌতিক স্থান, কিংবা কোনো ইতিহাস-কুখ্যাত গণহত্যার স্থান বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের স্থান এই সব।

শঙ্খ অধিকারী

দিন বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মন ও মানসিকতার পরিবর্তন আসা স্বাভাবিক। আজ সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে এমনকি মানুষের চিন্তা ভাবনার মধ্যেও এক আলাদা পরিবর্তন আসছে। একে অপরকে বুঝতে পারা বা বোঝার পদ্ধতি প্রতিদিন পাল্টে যাচ্ছে। আমাদের পর্যটন ক্ষেত্র দিনের পর দিন সমৃদ্ধ হচ্ছে। এই পর্যটন মানসিকতা আমাদের অর্থনীতিকেও ইন্ধন যোগাচ্ছে। ফলে এই পর্যটন ক্ষেত্র নিয়ে রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকার তাদের নানাবিধ কর্মসংস্থানের কথা ভাবছে। কিন্তু এই পর্যটনের ভিতরেই এক ধরনের পর্যটকদের মধ্যে অন্য ধরনের ঝোঁক লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পর্যটন শাস্ত্রের কথায় যাকে ব্ল্যাক ট্যুরিজম বলা হয়ে থাকে।

যেমন, কিছু পর্যটকদের মধ্যে এমন কিছু স্থানে ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছা জাগছে, যে সমস্ত স্থানের সঙ্গে একটা সভ্যতার কালো অধ্যায় যুক্ত রয়েছে। অর্থাৎ কোনও জনশ্রুতি অনুযায়ী ভৌতিক স্থান, কিংবা কোনও ইতিহাস-কুখ্যাত গণহত্যার স্থান বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের স্থান এই সব। খুব সম্প্রতি কেরলের ভুমিধ্বসে ধূলিস্যাৎ হওয়া গ্রাম পরিদর্শন করতে মানুষের আগ্রহ দেখে এই চর্চা আবারও উঠে এসেছে। যদিও কেরালা সরকার এই ধরনের কোনও পর্যটকদের অনুমোদন করছেন না বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। তবে এই ইচ্ছে অর্থাৎ বিপদের স্থানের প্রতি আকর্ষণ অনেক মানুষের মধ্যেই আছে। তারা একটু অন্যরকম পর্যটনের স্বাদ গ্রহণ করতে এই ধরনের কোনও হন্টেড স্থান বেছে নিচ্ছেন। পৃথিবী জুড়ে এই ধরনের স্থানের কিন্তু অভাব নেই। যেমন, চেরনোবিল হত্যাকাণ্ডের যে স্থান, সেখানে অনেকে বেড়াতে যেতে পছন্দ করছেন। তবে খুব বেশি মাত্রায় যে মানুষ যাচ্ছেন তা নয়, তবুও অনেকে যাচ্ছেন। আর এই ভয়ঙ্কর স্থানে যাওয়াকে ঘিরে একটা অর্থনীতিও সমান তালে গড়ে উঠছে। শুধু চেরনোবিল নয়, পোল্যান্ডে অবস্থিত হিটলারের ইহুদি নিধনের যে ক্যাম্প বানানো হয়েছিল, সেটা দেখতেও অনেক পর্যটক যান।

যারা ইতিহাস জানেন, তারা সেখানে ইতিহাসের একটা ভয়ঙ্কর গন্ধ নিতে পছন্দ করেন। আর সাধারণ মানুষ যারা এই ভয়াবহতাকে সেখানে দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করেন, তাদের অনেককে চোখের জল ফেলতে দেখা যায়। কেউ বা মূর্ছিতও হয়ে পড়েন। এছাড়া হিরোশিমা এবং নাগাসাকি অঞ্চলেও আজ অনেকে বেড়াতে যেতে চান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে এই শহর দুটিকে আমেরিকা সম্পূর্ণভাবে ধংস করে ফেলে। শোনা যায়, ওখানে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা এতটাই বেশি ছিল যে, এখনও তার প্রভাব পড়ে মানুষের শরীরে। এই শহর দেখার ইচ্ছেও অন্ধকার পর্যটনকে আলো দেখাচ্ছে। আমাদের দেশেও সে রকম বেশ কিছু স্থান আছে।

এমনকি আমাদের রাজ্যেও পুরুলিয়ার বেগুনকোদর বলে একটি স্টেশনের এই ধরনের বদনাম হয়েছিল। সেখানে ভৌতিক পর্যটনের একটা সম্ভাবনা গড়ে উঠেছিল। এই ধরনের পর্যটনের নৈতিকতা নিয়ে অনেক মানুষ প্রশ্ন তোলেন। এইসব স্থানে মানুষের দুঃখ, মানুষের অসহায়তা, মৃত্যুর ইতিহাস দেখে আমরা বিনোদন নিচ্ছি ঠিকই, কিন্তু এটা কি উচিত? আমরা তো সেখানে বেড়াতে গিয়ে মানুষের ভালো কিছু করতে পারব না, শুধু নিজের কৌতূহলটা মেটাতে পারব। নৈতিকভাবে মানুষের এই বেড়ানোকে কি মেনে নেওয়া যায়? আবার কেউ বলছেন, তাতে করে ইতিহাসের প্রচার হচ্ছে। আমাদের অর্থনীতি কিছু ক্ষেত্রে মজবুত হচ্ছে, তা হলে এই পর্যটন চলতে থাকলে অসুবিধা কোথায়?

এই প্রসঙ্গে আরও একটা কথা জড়িয়ে আছে। তা হলো, এই ধরনের স্থানগুলোতে কোথাও কোথাও ভুতের আর অলৌকিকতার একটা ব্যাপার জড়িয়ে যায়। যেমনটা আমাদের বেগুনকোদরে হয়েছিল। সে সময় পশ্চিমবঙ্গের বিজ্ঞান মঞ্চ কিন্তু পুরো বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে অনেক সচেতনতামূলক ক্যাম্প করে এবং ভুতের অস্তিত্বের সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করে। বিজ্ঞান মঞ্চ যত যাই করুক, মানুষ কিন্তু চিরকালের কৌতূহলী। সে বলবে, ‘আরে ঠিক আছে, একবার গিয়েই দেখা যাক না।’ এই গিয়ে দেখতে যাওয়ার কৌতূহল থেকেই তৈরি হয়ে যাচ্ছে একটা আস্ত অর্থনীতি। এখানেই অনেকের বক্তব্য, মানুষের যে কাজকর্ম কারও ক্ষতি না করে, অর্থনীতির ক্ষেত্রে একটা দিগন্ত খুলে দিতে পারে, তাকে স্বাগত জানানো উচিত। আসল কথা যাই হোক, আমাদের সব কৌতূহল আর ঝুঁকি নিয়ে দুর্যোগ দেখতে যাওয়ার ইচ্ছেও যে কখন পণ্যে পরিণত হয়ে যাচ্ছে, তা কি আমরা বুঝতে পারছি?