স্বপনকুমার মণ্ডল
আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ এন্ড হসপিটালে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের তীব্র জনরোষ ও তার প্রতিবাদী আন্দোলনের বৈপ্লবিক ধারাবাহিকতায় মেডিকেল কলেজ ও হসপিটাল শব্দগুলির গুরুত্ব জনমানসে লঘু হয়ে গেছে । আরজি কর বললেই লোকে তা বুঝে ফেলে। এভাবে বুঝে ফেলাটাও প্রতিষ্ঠানটির কৃতিত্ব বা কলঙ্ক নয়,এটা সরকারের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা কন্ঠস্বরে জনগণের ইতিহাস সৃষ্টিকারী প্রতিবাদী ঐকতান। এরকম ঐকতান ইতিপূর্বে আর একবারই শোনা গিয়েছিল ১৯০৫-এর বঙ্গবিভাগ প্রতিরোধে স্বদেশি আন্দোলনে । বিদেশি ব্রিটিশ সরকার যখন শাসনের সুবিধার্থে বাঙালির ঐক্যকে ভাঙার উদ্দেশ্যে বঙ্গবিভাগের ঘোষণা করেছিল,তখন বাঙালির অস্তিত্ব-সংকটে চূড়ান্ত আঘাত এসে লেগেছিল । তা ছিল বাঙালির মনভাঙার সামিল । এজন্য বঙ্গবিভাজন হয়ে ওঠে বঙ্গভঙ্গ। কয়েক বছরের আন্দোলনই একটি যুগের গরিমা লাভ করে, নাম হয় স্বদেশি যুগ। বাঙালি সেদিন বিদেশি সরকারের বিরুদ্ধে সর্বতোভাবে আন্দোলনে সামিল হয়েছিল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। সেই স্বদেশি আন্দোলনে বাঙালির ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ ইতিপূর্বে আর দেখা যায়নি।
ইতিপূর্বে ১৮৭৪-এ বাংলার তিনটি জেলা আসামের সঙ্গে জুড়ে দিলেও বাঙালি সেদিন প্রতিবাদ না করে নীরব ছিল । ১৯০৫-এর দ্বিখণ্ডিত বাংলাকে মেনে নেওয়া বাঙালির পক্ষে আর সম্ভব হয়নি। বাঙালির অস্মিতাবোধেই তার আঘাত লেগেছিল। সেই আন্দোলনের জেরে ১৯১১-তে বঙ্গবিভাগ রোধ হয়েছিল। এবারে রাজ্যের স্বদেশি সরকারের বিরুদ্ধেই বাঙালির পথে নেমে যেভাবে অবিরত তীব্র প্রতিবাদী আন্দোলনে সামিল হয়েছে,তার সঙ্গে স্বদেশি আন্দোলনে একটি জায়গায় অদ্ভুত মিল আছে,তা হল শাসকের প্রতি সন্দেহ ও তার অনমনীয় মনোভাব । আরজি করের পোস্টগ্র্যাজুয়েটের ডাক্তারি ছাত্রীর নৃশংস মৃত্যুর চেয়ে সেই মৃত্যুকে ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগ যত প্রকট হয়ে উঠেছে,ততই সরকারের বিরুদ্ধে জনরোষের মেঘ ঘনীভূত হয়েছে,অচিরেই তা চারদিক জুড়ে বৃষ্টির জলের মতো প্রতিবাদী জনস্রোত ধেয়ে আসছে অবিরত,অবিরাম । প্রশাসনের নির্মম উদাসীনতা থেকে যা খুশি তা করার স্বেচ্ছাচারী টালবাহানা ও ঔদ্ধত্যের মনোভাব থেকে সেই সন্দেহ যত বেশি সুদৃঢ় হয়েছে, জনতার প্রতিবাদ ততই লক্ষ্যভেদী তীব্র গতি লাভ করে চলেছে । সেক্ষেত্রে স্বদেশি আন্দোলনের চেয়ে ২০২৪-এর ৯ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া আরজি করের ধারাবাহিক প্রতিবাদী আন্দোলন আরও কঠিন,আরও বৈপ্লবিক, অনন্য ইতিহাস সৃষ্টিকারী !
আসলে বিদেশি শাসকের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করা বা আন্দোলনে সক্রিয় হওয়ার মধ্যে জাতিপ্রীতি বা দেশপ্রেমের গৌরব থাকে, আরজি করের ক্ষেত্রে তা নেই,উল্টে স্বদেশি শাসকের বিরুদ্ধেই আন্দোলন গড়ে তোলাই দুরূহ । যেখানে ব্যক্তিস্বার্থের পরাকাষ্ঠায় নিজে বাঁচলেই বাপের নাম মনে হয়, সেখানে শাসক দলের শিকার হয়ে আন্দোলনে সামিল হওয়ার বাসনার অঙ্কুরেই বিনাশ ঘটে। অন্যদিকে প্রতিবাদ করলে চিহ্নিত হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা । তাতে গণতন্ত্রের দলতন্ত্রের মৌরসী পাট্টায় সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঠিকা নিয়ে থাকা বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে নাম জড়িয়ে পড়ার হাতছানি স্বাভাবিক হয়ে ওঠে । সরকারেরও সেক্ষেত্রে মস্ত বড় সুবিধা । বিরোধী দলগুলোর চক্রান্ত বলে দাগিয়ে দিয়ে দল ও প্রশাসনের তৎপরতায় সেই আন্দোলনকে দমনপীড়নের মাধ্যমে স্তব্ধ করে দেওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা । শুধু তাই নয়, যাতে বিরোধী দলের আন্দোলনকে অভিসন্ধিমূলক বলে জনবিচ্ছিন্ন করে ভোটের ময়দানে দেখার বার্তা দিয়ে তার অস্তিত্ব সমূলে বিনাশ করা যায়,তার প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনপুষ্ট সরকারের সুচতুর দৃষ্টি আপনাতেই মুখিয়ে থাকে ।
এবারেরও আরজি করের আন্দোলনকে বিরোধী দলগুলোর চক্রান্ত বলে দমনপীড়নের প্রয়াসেও তা কার্যকরী হয়নি। দিনের পর দিন আন্দোলনের গতি বেড়েছে,রাত দখলের অভিনব আন্দোলনও তাতে সংযুক্ত হয়েছে, জনসমর্থনই শুধু নয়, সমাজের প্রায় সর্বস্তরের জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য উৎসবের মতো মেতে উঠেছে । যেন আন্দোলন থেকে পিছনের কোনও পথ নেই,এগিয়ে তার শেষ দেখাই তার ব্রত। এরকম মরীয়া ধারাবাহিক প্রতিবাদী আন্দোলন দেখে শাসকের সময়ের প্রতীক্ষাও হার মেনেছে। ভেবেছিল শরতের মেঘের মতো তার গর্জনসর্বস্ব অস্তিত্ব অচিরেই মিলিয়ে যাবে বা দমনপীড়নের মাধ্যমে শরতের মেঘের মতো উধাও করে দেবে। অথচ কোনওটাই হল না,উল্টে আন্দোলনের ধারাবাহিক উচ্চ কণ্ঠস্বর প্রশাসন ও শাসক দলের রাতের ঘুম কেড়ে নিচ্ছে । গণতন্ত্রে যে জনগণ বিপুল ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসায়,সেই জনগণই শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে, সিংহাসন থেকে টেনে নামাতে পারে,তার নজির আমরা মনে রাখি না, তা বিশ্বাস করতেও মনে অনীহা জাগে। সম্প্রতি পাশের বাংলাদেশের উদাহরণও আমাদের বিশ্বাস করাতে পারে না। গণতন্ত্রের সৌরভ তো সেখানেই। গণতন্ত্র যে বুলেটে কথা বলে না, ব্যালোটেই তার উত্তর দেয় । অথচ সেই ব্যালোটেই ক্ষমতাসীন হয়ে জনগণকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে শাসকের ভূমিকায় স্বৈরাচারী ও চরম ঔদ্ধত্য রাজকীয় আধিপত্য জেগে থাকে ।
আসলে রাজতন্ত্র অচল হয়ে পড়লেও তার রাজকীয় অস্তিত্ব গণতন্ত্রের মধ্যেও সক্রিয় হয়ে ওঠে । সেখানে গণতন্ত্রের আমজনতার মধ্যে ক্ষমতাসীন শাসক নিজেকে সর্বশ্রেষ্ঠ বা সবার উপরে ভাবার বাতিক আপনাতেই ভর করে । অথচ গণতন্ত্রে শাসকের কোনও অস্তিত্ব নেই,সুষ্ঠু শাসন পরিচালনার জন্য জনগণের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিই সেখানে জনসেবায় আত্মনিয়োগ করে । গণতন্ত্রে শুধু সকলের সমান অধিকারই থাকে না,সকলেই নিজেকে রাজা ভাবতে পারে। রবি ঠাকুরের ১৯১০-এ লেখা একটি জনপ্রিয় গানেই তার পরিচয় উঠে আসে, ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে—‘। সেখানে কেউ কারও প্রজাও নয়,রাজাও নয় । অথচ ক্ষমতাসীন জনপ্রতিনিধির শ্রেষ্ঠত্ববোধ তাকে চরম অহঙ্কারী করে তোলে। রাজতন্ত্রের I am the State-এর চরম আধিপত্য থেকে The king can do no wrong বা রাজা ভুল করতে না পারার চরম ঔদ্ধত্যের চেতাবনি জনপ্রতিনিধির শাসকের ভূমিকায় সদা সক্রিয় হয়ে থাকে। সেখানে আইনের শাসনের চেয়ে শাসকের আইন অতি সক্রিয়। তার স্বেচ্ছাচারিতাই কৃতিত্বের গরিমা পায়। ভুল করে তার দায় নেওয়ার সদিচ্ছাও শাসকের মনে ঠাঁই পায় না । জনগণের সুরক্ষার চেয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার নিশ্চয়তায় কাছের লোকের নিরাপত্তা জরুরি হয়ে ওঠে । স্বাভাবিক ভাবেই জনগণ যখন তা বুঝে ফেলে সোচ্চার হয়ে ওঠে,তখন ভুলের জন্য ক্ষমা চাওয়ার সৎসাহসও হারিয়ে যায় । পিছনে নির্ভীক ও নির্ভুল শাসকের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়ে যায়,সে ভয়ে তার প্রতীক্ষার পথ সুদীর্ঘ হতে থাকে। অন্যদিকে জাগ্রত জনতার কণ্ঠে We want Justice-এর মধ্যে নির্মম নৃশংস হত্যাকারীর বিচার শুধু নয়,সেই হত্যায় জড়িতদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রকারীদের ন্যায়বিচারের দাবিও ক্রমশ লক্ষ্যভেদী হয়ে শাসকের আধিপত্য ও ঔদ্ধত্যের কৃত্রিম ভাবমূর্তিকে তছনছ করে ভেঙে ফেলে দিতে মরীয়া হয়ে ওঠে । এইরকম অভূতপূর্ব বৈপ্লবিক প্রতিবাদ যেন বাঙালির অনন্য প্রতিবাদী সত্তাকে নতুন করে চিনিয়ে দিয়ে চলেছে।