পূর্ণেন্দু চক্রবর্তী
স্বপ্ন ভঙ্গ মোহনবাগানের। আর স্বপ্নের আলোয় নর্থ-ইস্ট ইউনাইটেড। ডুরান্ড কাপের ইতিহাসে সোনার অক্ষরে নাম লিখল নর্থ-ইস্ট ইউনাইটেড। স্বপ্নের খেলা খেলার জন্য পাহাড়ি ছেলেরা ছুটে এসেছিলেন যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গণে। তাঁরা ভালো করেই জানতেন ডুরান্ড কাপ ফুটবল ফাইনালে শতাব্দী প্রাচীন মোহনবাগান সুপার জায়ান্টসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। তাই সম্মুখ সমরে কী তাঁদের কৌশল হবে, তা মাঠে প্রকাশ করতেই পাহাড়ি ফুটবলাররা অপেক্ষায় ছিলেন। তাঁরা প্রমাণ করে দিল, স্বপ্নের দৌড়ে কীভাবে চ্যাম্পিয়ন হওয়া যায়। তাই তো মোহনবাগানের বিরুদ্ধে পিছিয়ে থেকেও দুরন্ত লড়াই করে নির্ধারিত সময়ে খেলা ২-২ গোলে শেষ করার পরেই টাইব্রেকারের জন্য মনোনিবেশ করেন দুই দলের ফুটবলাররা। টাইব্রেকারে ভাগ্য নির্ধারণে বড় ভূমিকা নিয়ে থাকেন গোলরক্ষকরা। মোহনবাগানের গোলরক্ষক বিশাল কাইথের হাত ধরেই শেষ আট ও চারের ম্যাচে জয় এসেছিল। তাই তো আত্মবিশ্বাসী বিশাল কাইথ যখন টাইব্রেকারের জন্য গোলের নীচে অপেক্ষা করছিলেন তখন সতীর্থ ফুটবলাররা কল্পনার জাল বুনছিলেন ম্যাচ জেতার জন্য। অপরপক্ষে নর্থ-ইস্ট দলের গোলরক্ষক গুরপ্রীত সিংও প্রস্তুত ছিলেন প্রতিপক্ষ দলের ফুটবলারদের শট কীভাবে প্রতিহত করা যায়, তার ভাবনায়। শেষ পর্যন্ত বিশাল কাইথের হাতকে স্তব্ধ করে দিয়ে গুরপ্রীতের হাত উজ্জ্বল হয়ে উঠল। শেষ পর্যন্ত নর্থ-ইস্ট ইউনাইটেড টাইব্রেকারে ৪-৩ গোলে মোহনবাগান সুপার জায়ান্টসকে হারিয়ে প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কৃতিত্ব দেখাল। অভাবনীয় ম্যাচের ফলাফলে সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। খেলার প্রথমার্ধে যে দল ২-০ গোলে এগিয়ে থাকে, সেই দল কীভাবে ২-২ গোলে খেলা শেষ করে। দ্বিতীয় পর্বে মাত্র দু’মিনিটের ব্যবধানে নর্থ-ইস্টের ফুটবলাররা গোল করে খেলায় সমতা ফিরিয়ে এনেছিলেন। টাইব্রেকারে ভাগ্য নির্ধারণ হওয়ার পরেই স্টেডিয়ামে উল্লাসে মেতে ওঠেন পাহাড়ি ফুটবলাররা। তাঁরা ফুটবল সমর্থকদের অভিনন্দন জানাতে ভুল করেননি। ফুটবলের চরিত্র কীভাবে বদলে যায়, তার উদাহরণ হয়ে থাকল এবারের ডুরান্ড কাপ ফুটবলের ফাইনাল খেলা।
প্রত্যয় ও প্রত্যাশার ভাবনায় সবুজ-মেরুন সমর্থকরা খেলার শুরু থেকেই গর্জন তুলেছিলেন মোহনবাগানের জয়ের। খেলার প্রথমার্ধে মোহনবাগানের দাপট দেখে অনেকেই আশা করেছিলেন, পরপর দু’বার ডুরান্ড কাপ ফুটবলে বাজিমাত করবে দল। তা অনেকটাই সেই খেলা দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। খেলার প্রথমার্ধেই ২-০ গোলে এগিয়েও গিয়েছিল সবুজ-মেরুন ব্রিগেড। মোহনবাগানের ফুটবলাররা যেভাবে একের পর এক আক্রমণ গড়ে তুলেছিলেন, তাতে নর্থ-ইস্ট ইউনাইটেডের রক্ষণভাগ বেশ চাপে পড়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে মোহনবাগানের আব্দুল সামাদ, লিস্টন কোলাসো, সাহাল, মনবীর সিং ও জেসন কামিংসের চতুষ্কোণ আক্রমণে বেসামাল হয়ে গিয়েছিল পাহাড়ি ফুটবলাররা। তবে, পাহাড়ি ফুটবলারদের দৌড়ের কাছে মাঝেমধ্যেই মোহনবাগানের রক্ষণভাগের খেলোয়াড়দের ব্যস্ত হতে দেখা গিয়েছিল। খেলার ৯ মিনিটের মাথায় মোহনবাগান এগিয়ে গিয়েছিল পেনাল্টি গোলে। বক্সের মধ্যে সাহালকে ফাউল করলে রেফারি পেনাল্টির নির্দেশ দেন। পেনাল্টি থেকে জেসন কামিংস গোল করে দলকে এগিয়ে দেন। স্বাভাবিকভাবেই এগিয়ে থাকা মোহনবাগান আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে খেলতে থাকে। ১৯ মিনিটে গ্রেগ স্টুয়ার্টের শট অল্পের জন্য বারের উপর দিয়ে উড়ে যায়। আবার পাল্টা আক্রমণে নর্থ-ইস্টের জিতিনের হেড গোলরক্ষক বিশাল কাইফ কোনক্রেমে বাঁচিয়ে দেন। ২৮ মিনিটে মনবীরের শট ফিরিয়ে দেন গুরমিত সিং। তারপরেই পাহাড়ি দলে বেমাম্বে চোট পেয়ে মাঠের বাইরে চলে যান। খেলতে আসেন নেস্তর। ৩৮ মিনিটে আলবার্তোর শট গোলের পাশ দিয়ে চলে যায়। মোহনবাগান আক্রণে উঠে এসে চাপ সৃষ্টি করতে থাকে নর্থ-ইস্ট শিবিরে। ৪১ মিনিটে মনবীরের দুরন্ত শট গুরপ্রীত প্রতিহত করেন। পাল্টা আক্রমণে বিশাল কাইথ কোনওক্রমে নেস্তরের শট বাঁচিয়ে দেন। প্রথম পর্বের সংযুক্ত সময়ে বাঁ প্রান্ত থেকে দুরন্ত গতিতে বল নিয়ে বক্সের মধ্যে প্রবেশ করেন কোলাসো। কোলাসো আলতো করে বলটি বাড়িয়ে দেন সাহালকে। সাহাল গোল করতে ভুল করেননি। খেলার প্রথমার্ধে মোহনবাগান ২-০ গোলে এগিয়ে যায়।
খেলার দ্বিতীয় পর্বের শুরুতেই সাহালের পরিবর্তে কোচ হোসে মোলিনা মাঠে নামান দিমিত্রি পেত্রাতোসকে। নর্থ-ইস্ট দলের ফুটবলাররা খেলার গতি পাল্টিয়ে আক্রমণে ঝড় তুলতে থাকেন। খেলার ৫৫ মিনিটের মাথায় আজারাই দুরন্ত গোল করে খেলায় ব্যবধান কমান। সেন্টার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবারও আক্রমণে ঝড় তুলে নর্থ-ইস্ট দল ৫৭ মিনিটে গোল পেয়ে যায়। দেখার মতো গোল করেন গিলেরমো। খেলায় সমতা ফিরে আসার পরেই ছন্নছাড়া ফুটবল খেলতে থাকে মোহনবাগান। সেই সুযোগে পাহাড়ি ছেলেরা অনেক বেশি আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলতে থাকেন। মাঝেমধ্যেই সবুজ-মেরুন ব্রিগেডের ফুটবলাররা আক্রমণ গড়ে তোলার চেষ্টা করলেও সফল হতে পারেননি। প্রতিপক্ষ নর্থ-ইস্টের ফুটবলাররা গোল করার মতো সুযোগ তৈরি করেছিলেন। কিন্তু সেই সুযোগ থেকে গোল করতে না পারায় খেলা শেষ হয় ২-২ গোলে। সবাই হতবাক হয়ে যান মোহনবাগানের এই খেলা দেখে। তবুও আশা করছিলেন, টাইব্রেকারে মোহনবাগানের স্বপ্ন পূরণ হবে। কিন্তু সেখানেও ব্যর্থতা। আত্মবিশ্বাসী বিশাল কাইথের হাত কথা বলল না। বরঞ্চ নর্থ-ইস্ট দলের গোলরক্ষক গুরমিত সিং দুরন্ত ভূমিকা পালন করে লিস্টন কোলাসোর শট ফিরিয়ে দিলেন আর অধিনায়ক শুভাশিস বসুর দুর্বল শট গোল করার মতো জায়গায় পৌঁছয়নি। আর নর্থ-ইস্ট দলের হয়ে গোল করেছেন গিলেরমো,মিগুয়ের জাবাকো, পার্থিব গগৈ ও আজারাই। মোহনবাগানের হয়ে গোল করেন জেসন কামিংস, মনবীর সিং ও দিমিত্রি পেত্রাতোস।এককথায় বলা যায়, বিশালের হাতকে উড়িয়ে দিয়ে গুরমিত নর্থ-ইস্ট ইউনাইটেডকে খেতাব দিয়ে সোনার আলোয় ভরিয়ে দিল।