• facebook
  • twitter
Thursday, 19 September, 2024

দেবী গর্জন

গত ১৪ আগস্ট রাতের পথটা দখল করে নিয়েছিল বেদনাবিদ্ধ জনতা।

মহম্মদ সাহাবুদ্দিন

গত ১৪ আগস্ট রাতের পথটা দখল করে নিয়েছিল বেদনাবিদ্ধ জনতা। মাথার ওপর শুক্লা নবমীর চাঁদ হয়তো বিস্মিত হয়ে ভেবেছে সে কী ভুল সময়ে আকাশ পরিক্রমা শুরু করেছে। না হলে গভীর রাতে আলো হাতে এত পথের যাত্রী কেন। এরা কোন আধারের যাত্রী। কোন স্বপ্ন সঞ্চরণ নয়, ১৪ আগস্ট শ্রাবণী রাতে এক সন্ধি মুহূর্তে পথে নেমেছিল লাখো মানুষ। আমি সচেতনভাবেই মানুষ শব্দটা ব্যবহার করছি। ডাক দিয়েছিলেন এই শহরের এক কন্যা। তাঁর ডাকে শুধু নারী নয়, নারী-পুরুষ সকলেই এসেছেন। জড়ো হয়েছেন লাখো সংখ্যার মানুষ। এই অভাবনীয় সাড়া মানুষের বিবেকের জাগ্রত অগ্নিশিখা।

আজ থেকে ৭৮ বছর আগে এমন করেই এই দিনটিতে মানুষ পথে নেমেছিলেন। সেখানে দেশভাগের বেদনা ছিল আবার স্বাধীনতার আনন্দও ছিল। স্বাধীনতার আটাত্তর বছরে এমন রাত তো আসার কথা ছিল না। মানুষ ভাবেনি এত গভীর বেদনা নিয়ে তাদের পথে নামতে হবে। ডাক ছিল মেয়েদের রাত দখল করার, কিন্তু মেয়েদের বাবা, ভাই, বন্ধু, পরিচিত, অপরিচিত সবাই সামিল হয়েছিলেন। আরজি কর মেডিকেল কলেজের নারকীয় ধর্ষণ ও খুনের ঘটনাকে ধিক্কার জানাতে রাত্রি জেগেছিলেন সব বয়সের মানুষ। সবার ঠিকানা ছিল রাত্রি দখলের পথ।

এটা কোন দেশ, যেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকের মর্মান্তিক অপমৃত্যু হয়। যে মেয়েটির পরিণতি নিয়ে চিকিৎসক সমাজ গর্জে উঠেছেন, তাতেই সমাজের সব স্তরের মানুষ গলা মিলিয়েছেন। ১৪ আগস্টের রাত তারই প্রতিফলন। এই ঘটনা সব মানুষের চেতনাকে নাড়িয়ে দিয়েছে। এই অমানবিকতার শেষ কোথায়।

এমন অনেক অমানবিক ঘটনার কথা মনে পড়ে। ১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে কংগ্রেস কর্মী নয়না সাহানীর হত্যা অথবা ১৯৯৬-এর জানুয়ারি মাসে ২৫ বছরের আইনের ছাত্রী প্রিয়দর্শিনী মাট্টুর ধর্ষণ ও হত্যা তৎকালীন সময়কে নাড়িয়ে দিয়েছিল। দিল্লির এই ঘটনা নিয়ে দীর্ঘদিন আইনি লড়াই চলেছিল। বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থা রেখেও বলতে ইচ্ছে করে, আইন কেন আরও একটু সদর্থকভাবে সন্নিবেশিত হয় না? তবে তো আজ বিলকিস বানোর ধর্ষকরা মালা পরে জেল মুক্তির আনন্দ প্রকাশ করতে পারত না। হতাশ চোখে পরিজন হারা মেয়েকে নিঃসঙ্গেতায় বেঁচে থাকতে হতো না। যে নির্ভয়া নির্যাতিতা হয়ে অমানুষিক যন্ত্রণা নিয়েও বাঁচতে চেয়েছিল, তার মা কি এই ডাক্তার মেয়েটির জন্য চোখের জল ফেলছেন না। এই নৃশংসতার বিরুদ্ধে পৃথিবীর মানুষ আজ প্রতিবাদে এক হয়েছে। উন্নাও, হাথরাস, কামদুনি, আরজি কর মানুষেরই লজ্জা, মানুষেরই তৈরি কলঙ্ক। এরই বিরুদ্ধে ধিক্কারে সবাই এক হয়েছেন। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে মায়ের দল পথে নেমেছেন মশাল হাতে। রাত্রির অন্ধকার দখল করেছেন ন্যায় বিচারের ধ্বনি তুলে। যে মানুষরা এই ঘৃণ্য ঘটনার শরিক, তাদের  জন্য আজ পুরো সমাজ লজ্জিত। শুধু মেয়েরা কেন, পথে নেমেছেন পুরুষরাও। পাড়ার মধ্যে যেসব মেয়েরা মিছিল করেছেন, তাঁদের জন্য যান নিয়ন্ত্রণ করেছেন ছেলেরা। তাঁরা জল এগিয়ে দিয়েছেন, বয়স্ক মহিলাদের হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এরা তো আমাদেরই দেশের ছেলে, আমাদের ঘরের ছেলে। তবে আমাদের ভূবন এমন কালো হয়ে গেল কেন? মনস্তাত্ত্বিকরা ধর্ষণকারীদের চারিত্রিক, ব্যবহারিক অসঙ্গতির মধ্যে তাদের দোষ খোঁজেন। কিন্তু যে সামাজিক অবস্থার মধ্যে, যে কলুষতার মধ্যে তারা বড় হয়, সেখানে সুস্থ মানসিকতা গড়ে ওঠা কঠিন। তার ওপর সুবিধাবাদী সমাজ, তাদের রাজনৈতিক গুরুর দল সহজেই তাদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে। আরজি করের মেয়েটের দেহে যে যৌন নির্যাতনের ভয়ঙ্কর ক্ষতচিহ্ন দেখা গেছে, তা দেখলে আমরা শিউরে উঠব। এদের যৌনপ্রবৃত্তি, হত্যা প্রবৃত্তি একসঙ্গে মিশে থাকে। তারপরও তারা নির্বিকার থেকে যায়। জমানো মাত্র কেউ দুষ্কৃতী হয় না। ধর্ষক হয় না। ধীরে ধীরে নানা ধাপ পার হতে হতে কেউ কেউ প্রবৃত্তিগতভাবে এমন হয়ে ওঠে। এইসব মানুষকেই কাজে লাগানো হয়। এরাই কারও হাতের পুতুল হয়। মাথার ওপর শক্তিশালী হাত থাকায় এরাই আরও বড় দুর্বৃত্ত হয়ে ওঠে।

যে ঘটনা নিয়ে আজ দেশ তোলপাড়, তার নির্মমতার সীমা নেই। দেবী পক্ষের প্রায় দু’মাস আগে তার বিরুদ্ধে সব দেবী গর্জন করে উঠেছেন। প্রশাসন, আইন, আদালত দলমত নির্বিশেষে সবার বেদনা এক হয়ে গেছে, এটাই কাম্য। আজকের সময়ে যে সচেতনতার প্রকাশ পেল, তা কায়েম থাকুক। মায়েদের মেয়েদের কণ্ঠস্বর সোচ্চার হোক। গর্জে উঠুক বাবারা, বন্ধুরা, ভাইয়েরা। অপমান অসম্মান এই শব্দগুলির এখানে কোনও মূল্য নেই। কার অসম্মান? যে ধর্ষিতা খুন হল, তাঁর অসম্মান কেন হবে। অসম্মানিত হয়েছে মানবতা, মমত্ব, মূল্যবোধ, শুভবোধ। আমরা সবাই অসম্মানিত।
চিকিৎসক তরুণীর এই মৃত্যু আমাদের সমাজের আদর্শের খামিত, আমাদের মূল্যবোধের চর্চার খামতিকে চোখে আঙুল দয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। গর্জে উঠুন মায়েরা। তাঁদের গর্ভকে অপবিত্র করছে এই সব দুষ্কৃতীরা। গর্জে উঠুন বাবারা, তাঁদের লালনাকে লাঞ্ছনা করা হয়েছে। প্রতিবাদ করুন ভাইরা, যে বোনরা তাঁদের হাতে রাখি পরান, কপালে চন্দনের ফোঁটা দেন ভাইফোঁটায়। তাদের কল্যাণকামী বোন আজ লাঞ্ছিত। এই মৃত্যু আমাদের কাছে, বিশেষ করে নারীদের মধ্যে প্রতিবাদী বার্তা নিয়ে এসেছে। সূর্য ওঠার আগে পর্যন্ত তাই চলেছে রাত্রি দখলের লড়াই। এই আন্দোলনের লাখো মেয়েদের সমাবেশ এক অন্য আকাশের সম্ভাবনা দেখাচ্ছে। এই দেবী গর্জনে শুনেছি ঐক্যের প্রতিধ্বনি। এই প্রতিধ্বনি মানুষের গভীরে প্রোথিত হোক। তাদের সাহসিকতার পথে ভয়ের অন্ধকার যেন ছায়া ফেলতে না পারে। দেবী গর্জন যেন না থেমে যায়। যেন হারিয়ে না যায় আর অন্য কেউ।