সুখেন্দু হীরা
বর্ষাকালে যে সব উৎসব হয়, তার মধ্যে জন্মাষ্টমী প্রধান। জন্মাষ্টমী ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি। ব্রহ্মপুরাণে শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি বলা আছে ভাদ্রমাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে রোহিনী নক্ষত্রে বৃষরাশিতে চন্দ্রে অর্ধরাত্রিকাল। যদিও বিষ্ণুপুরাণে শ্রাবণ মাসে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল বলা আছে। শ্রীকৃষ্ণের জন্ম উপলক্ষে যে ব্রত পালন করা হয় তার নাম ‘জন্মাষ্টমী’।
একটি বাক্য ব্রহ্মপুরাণ ও বিষ্ণুপুরাণে দুই জায়গাতেই আছে, তা হল, ‘জন্মাষ্টমীতে উপবাস করিবে।’ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে বলা হয়েছে যে, “বিত্তশূন্য অথচ ভক্তি সম্পন্ন মনুষ্যগণ ব্রত না করিতে পারিলেও কেবল উপবাসেই মাধব প্রীত হন।” গরুড় পুরানে বলা আছে, উপবাস করবে আর বিষ্ণুর নাম কীর্তন করে রাত্রি জাগরণ করবে। বিষ্ণু রহস্যে বলা হয়েছে – জন্মাষ্টমী তিথিতে উপবাস করে ভক্তি-পূর্বক শ্রীকৃষ্ণের অর্চনা করলে সাত জন্মের পাপ দগ্ধ হয়ে যায়। যজ্ঞাদি ও দানের ফল শতগুণ প্রাপ্ত হয়। সমস্ত মনোবাসনা পূর্ণ হয়। এই অষ্টমী তিথিতে উপবাস মহাপাপনাশক।
জন্মাষ্টমী উৎসব সারাভারত জুড়ে এবং ভারতের বাইরে হিন্দু পরিবারগুলি পালন করে থাকে। উপবাস ও পূজা-পাঠের মধ্যে উৎসব সীমিত থাকে বলে প্রতি বাড়িতে এটি পালনে কোন অসুবিধা হয় না। যে পরিবারে গৃহদেবতা বিষ্ণু বা কৃষ্ণ, সেখানে তো জন্মাষ্টমী পালন হয়ই।
গোস্বামী মতে জন্মাষ্টমীর পরের দিন শ্রীকৃষ্ণের জন্মোৎসব পালন করা হয়। বৈষ্ণবরা শ্রীকৃষ্ণের জন্ম উৎসবকে নন্দোৎসবও বলে থাকেন কারণ কৃষ্ণের জন্মের পরে নন্দ ঘোষের বাড়িতে বা নন্দ রাজার ঘরে, যে উৎসব হয়েছিল তাই নন্দোৎসব। শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাবে রাজা নন্দের ঘরে আনন্দের ঢেউ খেলে যায়। সারা গ্রাম জুড়ে উৎসব পালিত হয়। শ্রীকৃষ্ণের যে রাতে জন্ম সেই রাতে বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণকে নন্দের ঘরে রেখে এসেছিলেন। তাই নন্দ পরের দিন প্রভাতে কৃষ্ণকে পান বলে নন্দোৎসব জন্মাষ্টমীর পরের দিন হয়ে থাকে। তাই অনেক বৈষ্ণবরা শ্রীকৃষ্ণের জন্মের তিথি পালন না করে নন্দোৎসব পালন করেন।
পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সর্বত্র জন্মাষ্টমী ব্রত পালিত হয়। বৈষ্ণব বাড়ি, আশ্রমে গোস্বামী মতে জন্মাষ্টমীর পরের দিন অর্থাৎ নন্দোৎসবের দিন জন্মাষ্টমী উৎসব পালন করা হয়। যে বাড়িতে শ্রীকৃষ্ণ বা বিষ্ণু কুলদেবতা সেখানে জন্মাষ্টমী পালন হবেই হবে।
জন্মাষ্টমীর দিন সারাদিন ধরে পূজা আরতি এবং ভোগ নিবেদন করা হয়৷ সকালে হয় অভিষেক। দুপুরে অন্নভোগ, রাতে শীতল ভোগ। কোথাও কোথাও সকাল বা সন্ধ্যায় সংকীর্তন হয়।
বাঁকুড়া জেলার নাকাইজুড়িতে রাধারমণ মন্দিরে বারটি পিতলের গোপাল মূর্তি আছে। এঁদেরও এই সময় পূজা হয়। সকালে প্রত্যেকের অভিষেক অর্থাৎ স্নান করানো হয়। সবাইকে জলশঙ্খের সাহায্যে স্নান করানো হলেও গোপালদের ছান্তা অর্থাৎ চালুনীর সাহায্যে স্নান করানো হয়। বলা হয় গোপালরা যেহেতু ছোট তাই তাদের মাথায় সরাসরি জল ফেলা হয় না, কারণ আঘাত লাগতে পারে। চালুনীর মধ্যে দিয়ে বৃষ্টির বারিধারার মতো জল পড়ে।
অনেকে বলেন শ্রীকৃষ্ণের জন্মের সময় ঝড় বৃষ্টি হচ্ছিল, এই বারিধারার মতো স্নান সেই জন্ম মুহূর্তকে স্মরণ করিয়ে দেয়। হলুদ জল দিয়ে অভিষেক হয়। পশ্চিমবঙ্গের যে কয়টি স্থানে জন্মাষ্টমী বিখ্যাত সেগুলো হল – নদীয়া জেলার দিগনগর গ্রামে রাধামদন গাপাল জীউ মন্দির, বাঁকুড়া জেলার সোনামুখী শহরের বাবুপাড়া রাধাগোবিন্দের জন্মাষ্টমী। নবদ্বীপ শহরেও জন্মাষ্টমী ও নন্দোৎসব খুব নিষ্ঠার সঙ্গে পালিত হয়।