আন্তরিকতা, বিষণ্ণতা, হারিয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা, উৎসবের মেজাজ, আবেগগুলােকে সাজিয়ে সরলরেখায় আনা সেখানে নিতান্তই মুশকিল। তাসের ঘরের মতাে ধসে যাওয়া দুর্গাপিতুরি লেন, স্যাকরা পাড়া লেন বিশ্বকর্মা পুজোর দিনেও রইল বিষণ্ণ, স্তব্ধ।
বুধবার, বিশ্বকর্মা পুজোয় উৎসবের লেশ মাত্র ছিল না বউবাজারে। ছিল না জাঁকজমক, মাইকে শােনা যাচ্ছিল না জনপ্রিয় কোনও গানের কলিও। এই নিয়ে প্রশ্ন করতেই এক ব্যবসায়ীর হতাশ উত্তর, ‘গান বাজবে, ভাবলেন কি করে?’ প্রত্যাশা আর প্রশ্নটার ভার বােধহয় বেশি হয়ে গিয়েছিল।
তবে আন্তরিকতায় অভাব ছিল না, কিন্তু সায় দেয়নি পরিস্থিতি। বিশ্বকর্মা পুজোর দিনে স্তব্ধ বউবাজারে প্রতিবারের মতাে এবার আর শােনা যায়নি উল্লাসমুখর সেই পরিচিত ‘ভোকাট্টা’ ধ্বনিও।
কয়েকদিন আগের আতঙ্কের গ্রাস এখনও পিছু ছাড়েনি। রাস্তার ওপারে নবীন চন্দ্র বড়াল লেনে পুজো হলেও দুর্গা পিতুরি লেন, স্যাকরা পাড়া লেনে উৎসবের লেশ মাত্র নেই। পুজোর ভােগে কি চমক থাকবে তা স্থির করা হয়েছিল বহু দিন আগে থেকেই। চলতি বছরে পােলাও এবং আলুর দমের মেনু পরিবর্তন করা হবে, ভেবেছিলেন পুজো উদ্যোক্তারা। গান বাজনা নিয়ে আলাদা করে অবশ্য ভাবনা চিন্তা করা হয়নি। কারণ বিশ্বকর্মা পুজোর দিন ‘ফিকে’ বউবাজার কল্পনারও অতীত। কিন্তু একটা দুর্ঘটনাই ওলটপালট করে দিয়েছে বহু চেনা ছবিটা।
বুধবার বউবাজারের আকাশে মাত্র দুটো তিনটে ঘুড়ি উড়ছিল। আলাদা করে কোনও উৎসবের চিহ্নমাত্র নেই দুর্গা পিতুরি লেনে। ঘটস্থাপন করে কোনওরকমে পুজো করেছেন কয়েকজন। কিন্তু পর্যাপ্ত আলাে-জল না থাকায় ফিকে হয়েছে সেই পুজোর উৎসবের রেশ। অলিতে গলিতে মােতায়েন ছিল পুলিশ। সুরক্ষার ঘেরাটোপে উৎসবের তার কেটেছে বেশ কিছুটা।
বিশ্বকর্মা পুজোর দিন বউবাজারের অন্যান্য বছরের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এক কারখানার মালিক জানান, শুধু মূর্তির জন্যই খরচ হত প্রায় ২ থেকে ৩ হাজার টাকা। এছাড়া ভােগ, গান, বাজনার খরচ ছিল আলাদা। কিন্তু এবার ঘটস্থাপন করে ২০০ টাকার মধ্যেই কোনওমতে পুজো সম্পন্ন হয়েছে, জানান তিনি। এদিকে এই পাড়ায় প্রায় ২৫০ টি ছােট বড় কারখানা রয়েছে। গড়ে কারখানাগুলিতে ২০ থেকে ৩০ জন কর্মী কাজ করেন।
অন্যান্য বছর সকলে মিলে বাড়িগুলির ছাদে উঠে ঘুড়ি ওড়ানােটাই ছিল স্যাকরা পাড়ার বিশেষত্ব। কিন্তু ছেদ পড়েছে সেই প্রথাতেও। এদিন প্রায় ঘুড়ি শুন্যই ছিল স্যাকরা পাড়ার আকাশ। বাসিন্দাদের কথায়, ঘুড়ি ওড়ানাের জন্য যে ধরনের মানসিকতার প্রয়ােজন, তা এখন ছােট বড় কারওর মধ্যেই নেই। চোখের সামনে ধসে গেছে কয়েকশাে বছরের ইতিহাস। এই ধাক্কা সামলে উঠতে সময় লাগবে, জানান এক সােনা ব্যবসায়ী।
এদিকে স্যাকরা পাড়া লেনের উল্টো দিকেই নবীন চাঁদ বড়াল লেন। ধসের বিভীষিকা রাস্তা পার হয়ে উল্টো পারে পৌঁছাতে পারেনি। আপাতত এই পাড়ায় অন্যান্য বছরের মতােই বিশ্বকর্মা পুজো হয়েছে কারখানাগুলিতে। কিন্তু উৎসবের আনন্দে সেখানেও কিছুটা হলেও ভাটা পড়েছিল। স্যাকরা পাড়া লেনের স্বর্ণ কারখানার মালিকদের কথায়, বেশ কিছু কারখানা বর্তমানে নবীন চাঁদ বড়াল লেনে স্থানান্তরিত হয়ে গেছে চড়া ভাড়ার বিনিময়ে। সেখানেই পুজো করেছেন তারা। কিন্তু গান বাজনার লেশমাত্র নেই সেই পাড়াতেও।
নবীন চাঁদ বড়াল লেনের এক ব্যবসায়ীর কথায়, পুজো হয়েছে নির্বিঘ্নেই। পর্যাপ্ত আলাে, জল ছিল সেখানে। কিন্তু প্রতিবেশী পাড়ার বিষণ্ণতার রেশ পড়েছে সেখানেও তা একবাক্যে স্বীকার করেন তিনি। মােটের ওপর চলতি বছর বিষণ্ণতার মধ্য দিয়েই বিশ্বকর্মা পুজো কাটালাে বউবাজার।