• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

হিন্দু-শিখদের পবিত্র ক্ষেত্র মণিকরণ

নীলচে-সবজে পান্না জলে তখন রিভার রাফটিংয়ের আয়োজন চলছে

নন্দিতা মিত্র

হিমালয়ের এমন একটা ম্যাজিকাল চার্ম আছে যার প্রভাবে কেউ আকৃষ্ট হন নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া বিরল। তাই যে একবার তার কাছে গিয়েছে বারবার তাকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছে তা বাস্তবেই হোক কিংবা স্বপ্নে। কাশ্মীরের পরে পর্যটন মানচিত্রে ভারতের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা হিমাচল আর উত্তরাখণ্ড। হিমালয়ের এমন অনিন্দ্যকান্তি রূপ বোধহয় ভারতের আর অন্য কোনও প্রদেশে দেখা যায় না। পাহাড়-নদী-অরণ্য-ঝর্ণা-উপত্যকার সঙ্গে সঙ্গে আপেলচেরিন্যাশপাতি নানা ফলের আর ফুলের সৌন্দর্যের সঙ্গে বরফাবৃত শিখরচূড়া আর তার মাথায় সূর্যরশ্মির সোনালী-রুপোলি রূপএসব দৃশ্যই এখানকার চিরন্তন আকর্ষণ। সিমলায় দুরাত থেকে মানালির অপূর্ব পরিবেশের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে, রোটাং পাস এবং হিড়িম্বা মন্দির ঘুরে এবার আমাদের গন্তব্য কুলু। কুলু থেকে কাসল হয়ে মণিকরণ যাওয়া যায়। পথের রূপমাধুর্য বর্ণনাতীতযেমন রোমাঞ্চকর তেমনই মনকাড়া। এ পথের যে দিকে তাকানো যায় সেদিকেই কেবল দক্ষ চিত্রকরের নিপুণ তুলিতে আঁকা ছবি।যাত্রাপথে সঙ্গী হল বিয়াস। বিপাশা এখানে বিয়াস নাম নিয়েছে। অনেকক্ষণ থেকেই সে আমাদের সঙ্গী ছিল। কিন্তু এবার এর ধারে না নামলেই নয়। নীলচে-সবজে পান্না জলে তখন রিভার রাফটিংয়ের আয়োজন চলছে। উদ্দাম গতিতে বয়ে চলা বিয়াসের বুকে কয়েকজন যুবক-যুবতীর রিভার রাফটিংয়ের দামালপানা দেখতে দেখতে মনে ইচ্ছে জাগলেও সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারলাম না। ফলে শুধু প্রস্তরময় ঠান্ডা জলে পা ভিজিয়ে রিভার রাফটিংয়ের সেই প্রবল ইচ্ছাকে শীতঘুমে পাঠিয়ে দিলাম।

আবার বিয়াসের তীর ঘেঁষে পথ চলা। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে এখানে চলে ফলের রাজত্ব। পথের আশেপাশে আপেল নাশপাতি আলুবখড়া বেদানার নানা বর্ণের ফলে ভর্তি গাছ দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম। এভাবেই এক সময় পৌঁছে যাই এ পথের বিখ্যাত পার্বতী নদী আর বিয়াসের সঙ্গমস্থলে দুই উচ্ছলা চঞ্চলা নদী এখানে দুরন্ত গতিতে এসে মিশেছে এরপরই যাত্রাপথ দুদিকে বেঁকে যায়। পার্বতী নদীর তীর ধরে এগিয়ে যেতে শুরু করলামএক পাশে নদী আরেকপাশে পাহাড়কে সঙ্গে নিয়ে। চারদিকে চিরহরিৎ বৃক্ষরাজির সবুজের বিজ্ঞাপন। এভাবে কিছুটা চলার পরে পৌঁছে যাই বিরাট এক ব্রিজের সামনে যার নিচ দিয়ে খরস্রোতা পার্বতী নদীর সগর্জনে বয়ে চলার শব্দ শোনা যায় অনেকটা দূর থেকেই শোনা যায়। এই সেতু পেরিয়ে পথের একটা বাঁক ঘুরেই মণিকরণ যার চত্বরের একদিকে রয়েছে অতিথিশালা আরেকদিকে শিবমন্দির। একটু এগিয়ে গুরুদুয়ারা। এখানকার অতিথিশালাতেও নিখরচায় থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।

ভারতবর্ষ কিংবদন্তির দেশ। এখানে অলিতে-গলিতে, পথের আঁকে-বাঁকে ছড়িয়ে রয়েছে নানা পৌরাণিক কাহিনি। কখনো কখনো সে কাহিনি ইতিহাসের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তখন আর আলাদা করে পার্থক্য করা যায় না কোনটা কাহিনি আর কোনটা ইতিহাস। ভক্তদের হৃদয়ে সে কাহিনি আখ্যান হিসেবে রয়ে যায় আর ইতিহাসবিদ বা ভৌগলিকদের কাছে থেকে যায় ঐতিহাসিক কিংবা ভৌগলিক তত্ত্ব আর তথ্য হিসেবে। মণিকরণের ক্ষেত্রেও ঠিক একই কথা প্রযোজ্য। তবে হিন্দু ও শিখ উভয় ধর্মাবলম্বীদের পরম আবেগের এই জায়গা তীর্থক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত। হিন্দুদের বিশ্বাস অনুযায়ী এক পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে এই স্থানের সৌন্দর্য শিব-পার্বতীর হৃদয় জয় করে বলে তাঁরা এখানে প্রায় ১১০০-১২০০ বছর ছিলেন। একথা বিশ্বাস করা হয় যে সত্যসুন্দর ও শিবের সহাবস্থান। শিব সত্য ও সুন্দরের উপাসক তাই সুন্দর পর্বতবেষ্টিত এই উপত্যকায় তাঁরা ঘুরে বেড়াবেন এটাই খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। এমনই একদিন ঘুরে বেড়ানোর সময় পার্বতীর কান থেকে তাঁর মণিকুন্তল পড়ে যায়। শেষনাগ সেটি চুরি করে পালিয়ে যায় পাতালে। শিব পার্বতীর কাছে মণিকুন্তল হারানোর কথা শুনে তাঁর অনুচরদের সেটা খুঁজে আনতে পাঠান। কিন্তু তাঁরা ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলে প্রচন্ড রাগে তাঁর তৃতীয় নয়ন উম্মিলিত হয়। শিবের তৃতীয় নয়ন উন্মীলিত হওয়ার নানা কাহিনির কথা প্রচলিত আর তার ফলে কী কী ঘটনা ঘটে সেটারও দৃষ্টান্ত আছে নানা পৌরাণিক কাহিনিতে। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। সমগ্র পৃথিবী কাঁপতে থাকে এবং এই নদীর জল ফুটতে থাকে। সেই খবর শেষনাগের কাছে গিয়ে পৌঁছালে সে পাতাল থেকে ফুটন্ত জলের প্রস্রবণের ভিতর দিয়ে উপরে উঠে শিবের কাছে এসে মণিকুন্তল ফেরত দেয়। সঙ্গে আরো নানারকম মণিরত্ন উপহার দেয় শিবকে তুষ্ট করার জন্য। কিন্তু শিব শুধু মণিকুন্তলই ফেরত নিয়ে অন্যান্য মণিগুলো পাথর করে সেই প্রস্রবণ চাপা দিয়ে দেন। সেখান থেকেই এর নাম হয় মণিকরণ।

অন্যদিকে শিখ ধর্মাবলম্বীদের কাছেও এই শহরটি অত্যন্ত ধর্মীয় গুরুত্ব বহন করে। তাঁদের বিশ্বাস অনুযায়ী ১৫৭৪ সালে গুরু নানক এখানে আসেন শিষ্য ও ভাই মর্দানাকে সঙ্গে নিয়ে। তাঁরা একটি লঙ্গর স্থাপন করতে চেয়েছিলেন।  লঙ্গরখানা শিখধর্মালম্বীদের কাছে বিশেষ প্রথা বলে পরিচিত। তার জন্যগুরু নানক তাঁকে খাবার সংগ্রহ করতে পাঠান। বেশ কিছু লোক খাবার তৈরির জন্য আটা দান করেছিলেন আটা পাওয়া গেলেও রুটি বানানোর জন্য কোথাও আগুন পাওয়া যায় না। তখন নানক মর্দানাকে একটি পাথর সরাতে বলেন। ফলে পাথরচাপা অবস্থায় প্রস্রবণ উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। চাপাটি গরম জলে ফেললে সেটি ডুবে যায় নানক ঈশ্বরকে স্মরণ করেন। এরপর চাপাটি খাবার হিসেবে প্রস্তুত হয়েই তাদের কাছে ফেরত আসে। তাই দেখা যাচ্ছে যে হিন্দু এবং শিখ উভয় ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী এখানে সৎ মনোভাব নিয়ে যাঁরা ঈশ্বরের নামে এখানে কিছু দান করেন তাঁদের সব মনোবাঞ্ছা পূরণ হ। এটা বলার অপেক্ষা রাখে নাযখন কোন জায়গার কিংবদন্তি লোকশ্রুতি হিসেবে প্রচলিত হয় তখন প্রত্যেকেই তাঁদের নিজস্ব বিশ্বাস অনুযায়ী চলতে স্বাধীন। এখানের পার্বতী নদীর উষ্ণ প্রস্রবণে অবগাহন করে পবিত্র হন ভক্তগণ যাই হোক বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু তর্কে বহুদূর…

ধর্মীয় বিশ্বাস ছাড়াও নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে মণিকরণে প্রাকৃতিকভাবে ভূ-তাপীয় কার্যকলাপ রয়েছেযার ফলে প্রাকৃতিক উষ্ণ প্রস্রবণের সৃষ্টি হয়েছে। সারা বিশ্বে উষ্ণ প্রস্রবণগুলিকে থেরাপিউটিক হিসাবে বিবেচনা করা হয়। গুরুদুয়ারায় গিয়ে সেখানে পংক্তিভোজনেও সামিল হই। পরিবেশটি বেশ ভালো লাগে। চারপাশে রংবেরঙের পতাকা দিয়ে ঘেরা আছে গুরুদুয়ারা। তার পাশেই শিবমন্দির। এই মন্দিরের ভেতরেই রয়েছে কুণ্ড। কুণ্ডের উষ্ণ জল এসে পড়ে পার্বতী নদীর শীতল জলে তারপর তারা মিলিত হয়ে একান্তে য়ে গেছে আপন গতিতে আর ছন্দে। যেখানে উষ্ণ জল পার্বতীর হিম শীতল জলের সঙ্গে গিয়ে মিশেছে সেখানে অবিরাম ধোঁয়া নির্গত হচ্ছে। সেখানে স্নান করার ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে রুদ্র রুপী মহাদেবের মূর্তির অবস্থান। জল স্পর্শ করে মাথায় ঠেকালাম। চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্যের সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটিয়ে অবিরত ঠাকুরের নামগানে মুখরিত। টগবগ করে ফুটতে থাকা কুণ্ডর জলে ছোট ছোট থলিতে করে চাল সুতোয়ে বেঁধে সেই জলের মধ্যে ফেলে দিলেই চাল থেকে ভাত হয়ে আসে। এটাই এখানকার মহাপ্রসাদ। বড় বড় হাঁড়িতে করে চাল-ডাল সিদ্ধ করার পদ্ধতির কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম গুরুদুয়ারায় যে লঙ্গরখানা আছে সেখানকার খাবারের একটা বড় অংশ কুণ্ডের ফুটন্ত জল থেকেই আসে। কুণ্ডের কাছাকাছি প্রচণ্ড তাপ বিকিরণের জন্য চারিদিকে হিমেল বাতাস থাকলেও এখানকার বাতাস ভীষণ উত্তপ্ত। ব্রিজের ওপরে গিয়ে দেখতে থাকি খরস্রোতা পার্বতীর জলরাশি কীভাবে শিলাখণ্ডগুলোর ওপর উদ্দাম গতিতে আছড়ে পড়ছে। মন ডুবে যায় নদীর সান্ধ্যরাগ সঙ্গীতের কলতানে। দূরে ধ্যানমগ্ন হিমালয়ের কোল থেকে দেখা যায় সূর্যদেবের পাটে যাওয়ার প্রস্তুতি। দিনান্তের সেই আলোর ছটায় পার্বতী নদীর জল ঝিকমিক করছে। বিশালাকার হিমালয়ের সামনে মাথা নত করে নিজের ক্ষুদ্রতা, দীনতা, তুচ্ছতা, মনের সব গ্লানি স্বীকার করে ইশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি সত্য আর সুন্দরের পথে যেন সারাজীবন চলতে পারি।

কীভাবে যাবেন: হাওড়া থেকে কালকা মেলে সিমলা হয়ে কুলু বা মানালি যাওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায়  গাড়িভাড়া করে যাওয়া। কুলু বা মানালির বাসস্ট্যান্ড থেকে মণিকরণ যাওয়ার বাস পাওয়া যায়। তা না হলে ভুন্তার থেকেও ১৫ মিনিট পর পর মণিকরণের বাস ছাড়ে।

কোথায় থাকবেন: মণিকরণে থাকার সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থা হিমাচল ট্যুরিজমের অন্তর্গত পার্বতী রিসোর্ট। তবে গুরুদুয়ারা বা মন্দিরের অতিথিশালাতেও থাকা যায় নিখরচায়।