বরুণ দাস
স্বনামধন্য কালীভক্ত ভবা পাগলা তাঁর ভক্তদের প্রায়শই বলতেন, ওরে ‘আমার’ শব্দ থেকে ‘আ’ অক্ষরটি বাদ দে। ‘আমার’ থেকে ‘আ’ অক্ষরটি বাদ দিলে থাকে ‘মার।’ অর্থাৎ মায়ের। তাঁর কথায়, এ জগতে কোনও কিছুই আমার নয়; সবই হল গিয়ে মায়ের। তাঁরা ভবা পাগলা] ভক্তগণ এ-কথার মানাতা কতোটা দিয়েছিলেন তা জানার উপায় নেই আমাদের। তবে একটা ধারণা করা যায় যে, ভক্তরা ভবা পাগলা-কে শ্রদ্ধা-ভক্তি করলেও তাঁর ওই কথার তেমন গুরুত্ব দেননি। দিলে জগৎ-সংসার অনেকটাই বদলে যেত।
সেই কাঙ্ক্ষিত বদল কিন্তু আসেনি। বরং আমাদের আসক্তি আগের চেয়ে অনেকটাই বেড়েছে। উদারতা কমে গিয়ে সংকীর্ণতা বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে চূড়ান্ত স্বার্থপরতাও। বিশ্বায়ন বেস্টিত সময়ে আমরা কেবল নিজের দিকে তাকাতেই ভীষণ ব্যস্ত। অন্যের দিকে তাকানোর অবকাশ থাকলেও ইচ্ছে নেই। যেদিকেই তাকাই, শুধু আমি ও আমার। সামাজিক বন্ধনটাই যেন ঢিলে হয়ে গেছে। যদিও ওপর থেকে দেখলে ঠিক বোঝা যায় না। একটু লক্ষ্য করলেই সবটাই যে মেকি এবং লোক-দেখানো তা কিন্তু ধরা পড়ে।
আমরা প্রায় সবাই আমার ছেলে, আমার মেয়ে, আমার স্বামী, আমার স্ত্রী, আমার বাড়ি, আমার গাড়ি, আমার সম্পদ, আমার আমার এটা, আমার ওটা বলে থাকি। সংসারি মানুষের কাছে এটাই স্বাভাবিক। আমি, আমিত্ব ও আমার নিয়েই ডুবে আছি। এই ‘ডুবে থাকা’র মধ্যে সাময়িক আনন্দ আছে নিঃসন্দেহে। আমাদের পার্থিব আচরণেই তার প্রভূত প্রমাণ মেলে। অথচ এই ‘মায়ার সংসার’-এ প্রকৃতপক্ষে কিছুই যে আমার নয়, তা কিক্ত বুঝতে পারি না। তাই সবকিছু আঁকড়ে থাকার প্রবণতা আমাদের মধ্যে কাজ করে।
একবার উত্তরাখন্ডে ট্রেকিং থেকে ফেরার পথে হরিদ্বারে এসেছি। গঙ্গার ধারে এক রেস্টুরেন্টে সকালের জলখাবার খাচ্ছি। সঙ্গে আছেন সফরসঙ্গি সস্ত্রিক বরুণ বসু। খাবার পরিবেশনে সামান্য দেরি হচ্ছিল। পাশের টেবিলের এক বাঙালি পরিবারের সঙ্গে আলাপ। বাংলার বাইরে বাঙালি দেখলে আমাদের আবেগ উথলে ওঠে। কথার পিঠে কথা গড়িয়ে চলে। ক্রমশ আলাপ গড়ায় ব্যক্তিগত স্তরে। ‘আমার ছেলেমেয়ে বিদেশে আছে’- সদ্য আলাপ হওয়া পরিবারের সামনে এটুকু উগরে দেওয়ার জন্য শ্রীমতি বসুর সেকি আকুপাকু অবস্থা।
বুদ্ধিমান বসুজি প্রয়োজনে কিছুটা ঠেকনা দিচ্ছিলেন তার স্ত্রীকে। স্বামী প্রয়োজনীয় অর্থ সরবরাহ করলেও ছেলেমেয়ের উচ্চশিক্ষা এবং বিদেশ যাওয়ার পিছনে আমার ভূমিকাই বেশি- এটা প্রমাণ করতে ভদ্রমহিলার সেকি আপ্রাণ প্রয়াস। আলাপ হওয়া উল্টোদিকের পরিবারটিও কম যান না। তারাও তাদের সন্তানের সাফল্য তথা বিদেশ গমনের কথা উচ্চকিত ভাবে উগরে দিতে ব্যস্ত। সে যেন এক আগ্রাসি প্রতিযোগিতা। কেউ কাউকে একটুকরো জমি ছাড়তে নারাজ। বেশ মজাই লাগছিল দুই পরিবারের বাক্য প্রতিযোগিতার সামনে।
ইদানিং সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক মাধ্যমেও অনেকে সরব। ‘আমার ছেলে’ ‘আমার মেয়ে’-র সাফল্যের কথা জানাতে এমন সব কান্ড করেন যা অপরের কাছে বালখিল্য বলে মনে হতে বাধ্য। অথচ তারা নিজেদেরকে এগিযে থাকা শ্রেণি তথা প্রগতিশীল বলে দাবি করেন। কিন্তু ফেসবুকে’র পোস্ট দেখে বরং উল্টোটাই মনে হয়। কোনটা ‘এগিয়ে থাকার আর কোনটা ‘পিছিয়ে থাকা’র নমুনা- এ নিয়েই ধোঁয়াশা লাগে। প্রগতিশীলতার মানেই বোধহয় বদলে গেছে। প্রগতিশীল মনের মানুষ এমনটা করতে পারেন বলে মনে হয়না।
কিন্তু বাস্তবে করছেন। একবার নয়। বারবার। আজকের দিনে এমন ‘প্রগতিশীল’ মানুষের সংখ্যাই বেশি। যেমন সন্তান সম্বন্ধে উপযাচক হয়ে কোনও বিষয়ে বলতে গিয়ে তারা প্রথমেই পোস্ট-এ লেখেন, ‘মাই সান জুনিয়র সায়েন্সটিস্ট ড. অভিজিৎ বসু…।’ পারিবারিক বিষয়ে ফেসবুকে পোস্ট করতে কোনওরকম দ্বিধাবোধ করেন না। যা নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলে এবং সমীচিনও, তাকেও টেনে বাইরে আনার এক ধরনের আগ্রাসি ও অযৌক্তিক প্রবণতা। এটা কি সন্তানের স্ট্যাটাস জানিয়ে নিজেদের স্ট্যাটাস বাড়ানো।
প্রিয় সন্তানের ওপর বাবা-মায়ের অপত্য স্নেহ-আদর-যত্ন-ভালোবাসা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে অনু- পরিবারে যেখানে অনেকেরই একটি মাত্র সন্তান। বাবা-মা তো বটেই, অন্যান্য কাছের জনের ভালোবাসাও তার ভাগ্যে জোটে। প্রয়োজনের বাইরেও অনেক কিছু পেয়ে থাকে আজকের সন্তানেরা। বলাবাহুল্য, না চাইতেই। ফলে পাওয়ার আনন্দটুকু থেকেও বঞ্চিত তারা। বায়না করে কোনও কিছু পেলে তার গুরুত্ব আলাদা। এক্ষেত্রে অন্ততঃ পাওয়ার আনন্দটুকু উপলব্ধি করা যায়। এই উপলব্ধির তাৎপর্যই কিন্তু আলাদা।
এখানে উল্লেখ্য, একান্নবর্তী পরিবারের সদস্যদের মধ্যে এমন আদেখলেপনা ব্যাপারটা ছিল না। তাদের পরিবারের অনেকেই বিখ্যাত ডাক্তার-বিজ্ঞানী-অধ্যাপক-আমলা-উকিল-বিচারক হয়েছেন। কিন্তু তা ফলাও করে প্রচার করার সাধ তাদের মধ্যে কিন্তু জাগেনি। এমনকি, বিদেশে সেটেলড হলেও আকাশের চাঁদ হাতে পাননি। সন্তানের সাফল্য নিয়ে নিজেদের অহেতুক ‘এক্সপোজ’ করার দৃষ্টিকটু মানসিকতা দেখাননি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সবকিছুই বোধহয় বদলায়। আগে ছিল ‘দেখা’র মানসিকতা, এখন হয়েছে ‘দেখানো’র মানসিকতা।
এটা ভালো কি মন্দ, তা হয়তো এখনই বলা সম্ভব নয়, সময়ই বলবে। কিন্তু এটা যে কিছুটা বিসাদৃশ্য, তা বোধহয় হলফ করেই বলা যায়। যে কোনও তুচ্ছ কিংবা ঠুনকো ব্যাপারেই নিজেকে অহেতুক সর্বসমক্ষে উন্মোচন করার ব্যগ্রতা, সন্তানের সাফল্যে নিজেদেরকে গরিমান্বিত করার আগ্রাসি প্রবণতা— কতটা ঠিক? পারিবারিক তথা ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলো ব্যক্তিগত স্তরে সীমাবদ্ধ রাখলেই তো ভালো। তাকে অহেতুক টেনে-হিঁচড়ে বাইরে আনার কী প্রয়োজন? কিন্তু এসব নিয়ে মোটেই ভাবিত নন আজকের আধুনিক অভিাবকরা।
প্রিয় সন্তানের বাজারি ‘সাফল্য’-এ নিজেদেরকে গরিবান্বিত করার কী প্রয়োজন? নিজেদের কাজ দ্বারা নিজেরা গরিমান্বিত হন না কেন? সেটাই তো প্রকৃতপক্ষে করারও কোনও মানে নেই। কেউ বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন যে, সন্তানের খারাপ (অসামাজিক) কাজের যাবতীয় দায় মাথায় নিয়ে বাবা-মা প্রকাশ্যে অনুশোচনা করবেন? কিংবা বাবা-মায়ের অনৈতিক কাজের দায় নিয়ে প্রকাশ্যে অনুশোচনা করবে তার প্রিয় সন্তানেরা?
এ তো গেল এই নষ্ট সময়ের ‘বিতর্কিত’ একটা দিক। অন্য যে দিকটা আছে, সেদিকেও এবার আমাদের দৃষ্টি দেওয়া দরকার। তা না হলে ব্যাপারটা একপেশে হয়ে যাবে একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। যা কখনও কাম্য নয়। অনেকেই কমবেশি জানেন, পারিবারিক সম্পর্কের টানাপোড়েনে এই সময়ের সিংহভাগ বাবা-মায়েরাই বড় বিধ্বস্ত। বড় বিপন্ন। বড় অসহায়। প্রায় প্রতিটি পরিবারেই এই অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাধি বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। বিশেষ করে অনু-পরিবারে বাবা-মায়ের সঙ্গে তাদের প্রিয় সন্তানের সম্পর্কের জটিল টানাপোড়েন।
আর বলা বাহুল্য, এখানে বিত্ত কোনও ব্যাপার কিংবা অন্তরায় নয়। উচ্চবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তের দিকে পা বাড়ানো সিংহভাগ পরিবার— সবার ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা কিন্তু সমান প্রযোজ্য। অপার (পড়ুন মাত্রাতিরিক্ত) স্নেহ-আদর-যত্ন দিয়ে যে সন্তানকে বড় করে তুলেছেন বাবা-মা, আর্থিক সামর্থ্যের বাইরে দাঁড়িয়েও নামি স্কুলে পড়িয়েছেন, অকারণে অপ্রয়োজনীয়, বায়না মিটিয়েছেন, সেরা পোশাক আর দামি খাবার মুখে তুলে দিয়েছেন, সেই সন্তানই বড় হয়ে বাবা-মাকে ছেড়ে অন্যত্র ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে চলে যাচ্ছে।
আধুনিক সুবিধাযুক্ত দোতলা বাড়ি। একেবারে কলকাতা লাগোয়া এলাকায়। একমাত্র সন্তানকে নিয়েই থাকতেন বাবা-মা। ব্যাঙ্কের অবসরপ্রাপ্ত কর্ম বাবা সমীরণ মুখোপাধ্যায়। একমাত্র সন্তানকে ডাক্তারি পড়িয়েছিলেন। অত্যন্ত মেধাবী সন্তান। ফলে তরতর করে এগিয়ে গেছে চিকিৎসাবিদ্যার জগতে। এমডি-পর ডিএনবি করেছে। এরপর কলকাতার সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে শিক্ষকতা সহ কলকাতার অভিজাত বেসরকারি হাসপাতালে বসছে। প্রতি মাসের নির্দিষ্ট দিনে জেলা ও রাজ্যের বাইরেও ছুটে বেড়ায় রোগী দেখতে।
এমন উদাহরণ হয়তো আরও অনেক আছে। এক সমীরণ মুখোপাধ্যায় নন। আমাদের চারপাশে মানসিকভাবে বিপন্ন-বিধ্বস্ত আরও অনেক সমীরণ মুখোপাধ্যায়রা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। যাদের সাজানো-গোছানো বাড়ির ফাঁকা ঘরগুলো হাহাকার তোলে। রাতের নিস্তব্ধতাকে ঘনীভূত করে যন্ত্রণার আবহ নির্মাণ করে। প্রিয় সন্তান দূরে চলে যাওয়ার অব্যক্ত ব্যথা যাদের প্রতি মুহূর্তে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। সন্তানের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা নয়, কেবল মানসিক সহায়তা চান জীবনের প্রান্তপ্রহরে পা দেওয়া বয়স্ক ও নিঃসঙ্গ বাবা-মায়েরা।
বাবা-মায়ের কাছ থেকে দূরে থাকার বাসনায় অনেক সন্তানের ইচ্ছে করে বদলি নিয়ে রাজ্য কিংবা দেশের বাইরে চলে যান। যাদের স্নেহ-আদর-যত্ন-ভালোবাসার স্পর্শে বড় হয়ে ওঠা— বিয়ের পর তাদের থেকেই দূরে থাকার ইচ্ছে প্রবল হয়ে ওঠে। তাদের সংস্পর্শ এড়িয়ে জীবনের বাকি পথটা চলতে চায় আজকের ‘উচ্চশিক্ষিত’ ও ‘সফল’ সন্তানেরা। এ কোন দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে চলেছি আমরা? যাদের ‘বাজারি সাফল্য নিয়ে একসময় পরিচিত-প্রতিবেশীদের কাছে গর্ব করতেন, নিজেদেরকে আলাদা মনে করতেন, তারাই ফাঁকি দিয়ে দূরে যায়।
বিদেশে যাঁরা যান, তাঁদের কেউ কেউ আবার মাকে সঙ্গে আনার চেষ্টা করেন। বিশেষ করে তাঁদের অনু-পরিবারে সন্তান এলে। বিদেশে কাজের তথা সন্তান পালনের জন্য লোক রাখার খরচ অনেক। মা যদি সে খরচ বাঁচিয়ে দিতে পারেন তো মন্দ কী? মায়ের ক্ষেত্রে শুধু খাওয়া-পরার খরচটুকু বহন করলেই চলে। এক্ষেত্রে বাবার কদর অবশ্য শূন্য। কারণ সে শুধু লায়াবিলিটি। হোক না বাবা, এমন ‘লায়াবিলিটি’ কোন সন্তানই বা বহন করতে চায়? এখনকার উচ্চশিক্ষিত ও আর্থিকভাবে সফল সন্তানেরা ততটা বোকা নয় নিশ্চয়ই।
কিন্তু নিজের শিকড় উপড়ে কোনও মা-ই চান না বিদেশ-বিভূঁইয়ে ছেলে-বউয়ের অধীনে থাকতে। যেখানে নিজের ভাষায় প্রাণের কথা বলার মতো কাউকে পাবেন না। পাবেন না নিজের খুশিমতো একটু চলাফেরার অবকাশ। এমনকি, পরিচিত কেউই নেই যেখানে। এছাড়া জীবনের শেষপ্রান্তে এসে বৃদ্ধ স্বামীকে ছেড়েও থাকতে অনিচ্ছুক অনেক মা। সুখে-দুঃখে একসঙ্গেই থাকতে চান তারা। তাই সন্তানের সঙ্গে থাকা হয় না। বাকি জীবনটুকু সন্তানের কথা ভেবেই কাটিয়ে দেন এঁরা। যদিও প্রিয়সন্তানেরা ভাবে না তাদের বাবা-মায়ের কথা।