• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

বাংলাদেশের পুনরায় স্বাধীনতার মানে পুনরায় সে দেশের সংখ্যালঘুদের স্বদেশে পরবাসী ও শরণার্থীর ছিন্নমূল অনিশ্চিত জীবন

বাঙালি হিন্দুদের প্রতি ধর্মীয় বিদ্বেষে উৎখাত করার সদিচ্ছা সে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদেরও নেই

স্বপনকুমার মণ্ডল

বাংলাদেশের চাকরিতে কোটা বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পথ ধরে পুনরায় স্বাধীনতার নামে সে দেশের সরকার উৎখাতে তীব্র জনরোষের বীভৎস নৃশংসতা নেমে এসেছে । ৫ আগস্ট সে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুর্নীতি ও স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা জনরোষের নেপথ্যে যে ভারতবিরোধীতা ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষভাবনাও জড়িয়ে ছিল,তা শুধু আন্দোলনের মধ্যেই প্রকট হয়ে ওঠেনি, সরকার উৎখাতের সাফল্য উদযাপনের মধ্যে তা আরও তীব্র আকার ধারণ করে । শুধু তাই নয়, সে দেশের সংখ্যালঘুদের উপরে তার প্রভাব ক্রমশ নারকীয় আক্রমণে সক্রিয় হয়ে উঠছে । এর আগে সে দেশের সংখ্যালঘুদের বিশেষ করে বাঙালি হিন্দুদের প্রতি অন্যায় অত্যাচার দৈনন্দিনের ব্যাপার হওয়ায় দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকদের জীবনে স্বাভাবিক মনে হতে শুরু করে । সেখানে প্রায় প্রতিবছর সারা পৃথিবী জুড়ে যখন শারদীয় দুর্গোৎসবের আয়োজনে চারিদিকে আনন্দের ঐকতান ভেসে আসে,তখন বাংলাদেশে তার বিষাদঘন আবহ দেশ দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ত। সেখানে প্রতিমা ভেঙে দিয়ে পূজায় বিঘ্ন করা বা উৎসবকে ভণ্ডুল করার নৈমিত্তিক ব্যাপার আগেও শোনা গেছে ।

শুধু তাই নয়, দেশভাগের শিকার থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভে হিন্দুদের স্বদেশে পরবাসী হওয়ার কথা এ দেশে সেদিনও ছিন্নমূল বাঙালি হিন্দুদের ঘরে ঘরে । সেক্ষেত্রে হিন্দুদের প্রতি মুসলিমের উগ্র বিদ্বেষী মানসিকতা সমান সচল ছিল। বাঙালি বহু সংগ্রামের মধ্যে স্বাধীন দেশ পেয়েছে ঠিকই,আবার সে দেশেই বাঙালিদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ প্রকট হয়ে ওঠে । অবশ্য এর মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকতা নেই । স্বার্থেই মানুষ সংকীর্ণ হয়, আত্মসচেতন মনে তার অধিকার জেগে ওঠে । সভ্যতাগর্বী আধুনিকতার বোধ যত বেড়েছে, শ্রেষ্ঠত্ববোধে মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতাবোধ তত শ্রীবৃদ্ধি লাভ করে,ততই আত্মসচেতনতার উগ্র আত্মকেন্দ্রিকতায় স্বার্থপর দৈত্যের আবির্ভাব ঘটে ।

এজন্য সারা পৃথিবী জুড়ে বিশ্বায়নের ভুবনগ্রামের হাতছানির মধ্যেই আঞ্চলিকতাবোধ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে । যে আধুনিক চেতনা যুক্তি ও বিজ্ঞানের মাধ্যমে অগ্রসর হয়েছে,সেই পরিসরেই ধর্মীয় আধিপত্যের বিস্তার আরও প্রকট মনে হয় । একদিকে মননের আলোর বিস্তার,অন্যদিকে অস্তিত্বের সোপানে অধিকার অর্জনে অন্ধত্ব । বিশ্বময় সাম্য-মৈত্রী ও স্বাধীনতার আধারে সম্প্রীতির বার্তার উগ্রতায় তার বৈষম্যবোধ আরও প্রকট হয়ে ওঠে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আহ্বানের আড়ালে জাতিদাঙ্গা, ধর্মীয় সন্ত্রাস ও উগ্র দেশাত্মবোধ জেগে থাকে । সেখানে ভারতের মতো বৃহৎ দেশে হিন্দুমুসলমানের মধ্যে বৈরি মনোভাব যে দেশের প্রধান সমস্যা,সেকথা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন । সেই সমস্যা দেশভাগেও শেষ হয়নি,স্বাধীন বাংলাদেশেও জেগে ছিল।

সেক্ষেত্রে সরকার উৎখাতের মাধ্যমে যেভাবে পুনরায় স্বাধীনতার লাভের উদযাপনের মধ্যেই সে দেশের বাঙালি হিন্দুদের উপরে নির্বিচারে লুণ্ঠন, হত্যার ধ্বংসলীলা নেমে এসেছে,তাতে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রাণ হাতে করে হাজার হাজার মানুষের স্বদেশে পরবাসী হয়ে প্রাণ হাতে করে ছিন্নমূল শরণার্থীর অস্তিত্ব সংকটের পরিচয় ভেসে ওঠে। সেখানে উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিকৃত ক্ষুধার আগুনে আত্মঘাতী বাঙালির ভয়ঙ্কর পরিণতি আমাদের নির্বাক করে দেয় ।

রবীন্দ্রনাথের মতে মুসলিমরা ধর্মে গোঁড়া,হিন্দুরা আচারে। সেখানে ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলিমদের একাধিপত্য যেভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছে,হিন্দুদের আচারসর্বস্বতায় তা না হওয়াই দস্তুর । উল্টে হিন্দুদের বর্ণবাদী সমাজে উপেক্ষা আর অবজ্ঞাও হিন্দুদের প্রতি মুসলিমদের আরও ধর্মবিদ্বেষী করে তোলে । শুধু তাই নয়,উনিশ শতকে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতি আলোয় হিন্দুদের জয়যাত্রা যতই অগ্রসর হয়,পিছিয়ে পড়া মুসলিম সমাজের মানসিক দূরত্ব ততই বেড়ে চলে । প্রতিযোগিতায় ব্যর্থতা মেনে নেওয়ার সৎসাহস সবসময় সক্রিয় হয় না। এজন্য তার কারণের প্রতি দৃষ্টিনিবদ্ধ না হলেও বিজয়ীর প্রতিই বিদ্বেষ জেগে ওঠে।

নিজেদের অসফলতার জন্য সেক্ষেত্রে হিন্দুদের প্রতি বৈরী মনোভাবে মুসলিমদের বৈষম্যবোধ আরও তীব্র মনে হয় । শুধু তাই নয়, সময় যত এগিয়েছে, সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নতাবোধ ততই আক্রমণাত্মক হয়েছে। সেখানে আধুনিক শিক্ষার আলো সামনের দিকে এগিয়ে না দিয়ে পেছনের দিকে অস্তিত্বের মূলে সক্রিয় করেছে। আর তার লক্ষ্যেই হিন্দুদের প্রতি শত্রু মনোভাব সক্রিয় হয়ে উঠেছে । অন্যদিকে শিক্ষায় আত্মসচেতনতা যত বেড়েছে,ততই তার আক্রমণ যেমন বহুমুখী হয়েছে,তেমনই কূটকৌশলে তা তীব্রতা লাভ করেছে। সেদিক থেকে দীর্ঘদিন পরে এবারের সাম্প্রদায়িকতার শিকারে নতুনত্ব না থাকলেও তা যে সুপরিকল্পিত,তা সহজেই অনুমেয়।

বিশ্বাস যখন টলে যায়,সন্দেহ তখন তীব্র হয়ে ওঠে । বাঙালি পরিচয়ের চেয়ে যখন তার ধর্মীয় অস্তিত্ব প্রাধান্য লাভ করতে শুরু করে,তখনই বাঙালির আত্মঘাতী সত্তা প্রকট হয়ে পড়ে । সেখানে অবশ্য রাজনীতির সংযোগও ধর্মীয় মেরুকরণের জন্য দায়ী । ক্ষমতা,কর্তৃত্ব ও অধিকারের ত্রিবেণী সঙ্গমে ধর্ম ও রাজনীতি একেঅপরের পরিপূরক । সেখানে রাজনীতির ক্ষমতায়নে ধর্মকে হাতিয়ার বা ধর্ম প্রতিষ্ঠায় রাজনীতির আশ্রয় সবই সচল। শুধু তাই নয়, আধুনিক বিশ্বে রাজনীতি সচেতনতাতেও ধর্মীয় যোগ আরও নিবিড় । সেখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চেয়ে তার বিচ্ছিন্ন একক উগ্র অস্তিত্ব অনেক বেশি প্রভাবশালী। সেখানে ধর্মীয় সম্প্রদায় ভিত্তিক রাজনীতিও হিন্দুমুসলমানের বিভেদকে আরও জিইয়ে রাখতে উৎসাহী। অন্যদিকে বাঙালিদের মধ্যে যে ধর্মীয় পরিচয় ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠেছিল,তা স্বাধীনতা লাভের আগেই একাধিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাতেই প্রতীয়মান। সেখানে ধর্মীয় শান্তি প্রতিষ্ঠায় যে দ্বিখণ্ডিত স্বাধীনতার বন্দোবস্ত হয়েছিল, তাও অসফল হয়ে পড়ে।

পূর্ব পাকিস্তানের বিধর্মীদের ভয়ে বাঙালি হিন্দুদের স্বদেশের ভিটেমাটি ছেড়ে এদেশে আসার মধ্যে শুধু বাঁচার লক্ষ্যই ছিল না, নিজের ধর্ম রক্ষা করাও সমান সক্রিয় ছিল। আবার স্বাধীনতার আরও চব্বিশ বছর পর বহু রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি যখন একটি স্বাধীন দেশ পেল,সে দেশেও বাঙালি হিন্দুর ঠাঁই না মেলাটা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে । সেক্ষেত্রে সে দেশে হিন্দুদের ধর্মীয় অস্তিত্বই শুধু মৌলবাদীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়,তাদের ফেলে যাওয়া ধনসম্পত্তি,জমিজমা,বাড়িঘর প্রভৃতি হাতানোও তার সঙ্গে যুক্ত। এছাড়াও আছে কায়েমি স্বার্থ চরিতার্থ করা । সেক্ষেত্রে মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের কাছে দেশভাগ আশীর্বাদ হয়ে ওঠে। আবার ঠিক একই ভাবে এবারও সেই ট্র্যাজেডি সমান তালে চলেছে । একাত্তরের পরে দীর্ঘ তেপান্ন বছরেও যে সে সে দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গড়ে ওঠেনি,বরং তা আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে, হিন্দুদের উপরে নৃশংস আক্রমণেই তা প্রতীয়মান ।

সে দেশে হিন্দুদের অবর্তমানে মুসলিমদের মধ্যে চাকরি-ব্যবসা,শিক্ষা-সংস্কৃতি প্রভৃতির দ্রুত প্রসার ঘটে। গোলাম মুরশিদ তাঁর ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’ বই-এ জানিয়েছে : ‘মোট কথা, দেশবিভাগের ফলে সত্যি সত্যি কেউ যদি লাভবান হয়ে থাকেন, তা হলে তাঁরা হলেন বাঙালি মুসলমান । এক কথায় বললে, উচ্চবর্ণের হিন্দুরা বেকায়দায় পড়লেন, বিশেষ করে বেকায়দায় পড়লেন পূর্ববাংলার শিক্ষিত এবং উচ্চবর্ণের হিন্দুরা। আর নিম্নবর্ণের হিন্দুদের অবস্থা যেমন ছিলো,তেমনই থেকে গেলো । কিন্তু রাজনীতির কারণে মুসলমানরা নিজেদের দেখতে পেলেন একটা দারুণ সুবিধাজনক অবস্থানে ।’

অন্যদিকে একাত্তরে সেই ‘নিম্নবর্ণের হিন্দুদের’ অবস্থা যে ভয়ংকর হয়ে ওঠে,তা এদেশে শরণার্থীদের ভিড়েই প্রতীয়মান । অবশ্য সকলেই হিন্দুদের দেশত্যাগকে ভালো চোখে দেখেননি । আহমদ শরীফ থেকে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস দেশভাগ মেনে নিতে পারেনি,বাঙালি হিন্দুদের অবর্তমানে সে দেশের আত্মিক সংকটের কথা তাঁরা নানাভাবে ব্যক্ত করেছেন।

আসলে বাঙালি হিন্দুদের প্রতি ধর্মীয় বিদ্বেষে উৎখাত করার সদিচ্ছা সে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদেরও নেই । সেখানে সেই বিদ্বেষকে পুঁজি করে যাদের রাজনীতি থেকে ধর্মীয় অস্তিত্বের বিস্তার, তারাই তা কূট কৌশলে সংগঠিত করে । এতে বাঙালির ঐক্য বিনষ্ট হয়,ধর্মীয় সংকীর্ণতা ছড়িয়ে পড়ে, মানবিকতা নিঃস্ব হয়ে যায় । শুধু তাই নয়, সেখানে মুক্তমনা মানুষের প্রতিবাদও সন্দেহের মনে হয় । ধর্মীয় গোঁড়াদের ভয়ে সব ধর্মের মানুষই প্রতিবাদে সামিল হতে ভয় পায় । যারা করে,তাদের বক্তব্য হয় সন্দেহের চোখে দেখা হয়,নয় মূল্যহীন হয়ে পড়ে । সেখানে আগে এদেশে সংখ্যালঘুদের হয়ে প্রতিবাদে সামিল না হওয়ায় বর্তমানে সে দেশের প্রতিবাদের অধিকার নেই বলে বিরোধী কণ্ঠ জোরালো হয়। বক্তব্য খণ্ডনের চেয়ে ব্যক্তিকেই খণ্ডিত করার প্রয়াসে প্রতিবাদও সোচ্চার হতে পারে না। পাল্টা তা নিয়ে মৌলবাদী মানসিকতায় হিন্দু বা মুসলিম বিদ্বেষ বেরিয়ে আসে,ছড়িয়ে পড়ে । সেখানেও বোধনে বিসর্জন, ভাবা যায়!

একথা বিশেষ ভাবে স্মরণীয়, ধর্মভেদে দেশভাগের আজও স্বস্তি মেলেনি। দেশভাগ করতে গিয়ে মানুষভাগই বড় হয়ে উঠেছে । যেখানে মানুষে মানুষে বিভেদচেতনাই প্রধান্য লাভ করে,সেখানে মানবতা নিঃস্ব হয়ে পড়ে,ধর্মান্ধতার বীভৎস রূপ দেখা দেয় । সেদিক থেকে সংখ্যালঘুর ওপরে সংখ্যাগুরুর নির্যাতনের তত্ত্বকে অতিসরলীকরণ মনে হয়। বিশেষ করে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি ধর্মীয় অত্যাচারই নয়,মানবিক অস্তিত্বকেও অস্বীকারের প্রবণতা প্রবহমান,তা আবার দেশত্যাগের মতো পরিস্থিতিতেই প্রতীয়মান । মানুষের অধিকারই যেখানে বিপন্ন,সেখানে ধর্মীয় ভাবে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের নির্যাতনের আধারে ছকবন্দি চেতনায় তাকে মূল্যায়ন করার মধ্যে মূল সংকটকেই আড়াল করার প্রবণতা সক্রিয় হয়ে ওঠে । বাংলাদেশের পুনরায় স্বাধীনতার অর্থ দাঁড়ায় পুনরায় বাঙালি হিন্দুর স্বদেশে পরবাসী ও শরণার্থীর ছিন্নমূল অনিশ্চিত জীবন। দুর্ভাগ্য, আমরা সব জেনেও না জানার ভান করি।