• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

কান পেতে গান শোনা নয় ‘রীল’ খুলে গান দেখা

কোহিনূর কর গান ভালোবাসে না এরকম মানুষ বোধহয় পৃথিবীতে বিরল। এই সঙ্গীত শিল্প কত শতসহস্র বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে আজ একটা জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে। শাস্ত্রীয় বা লোকসঙ্গীত থেকে শুরু করে কালের সাথে তাল মিলিয়ে আধুনিক গানের জনপ্রিয়তা বেড়েই চলেছে। ছায়াছবির গান হলে তো কথাই নেই। তার ওপর আছে র‍্যাপ বা ফিউশনের মত মারাত্মক জিনিস যা আনন্দও

কোহিনূর কর

গান ভালোবাসে না এরকম মানুষ বোধহয় পৃথিবীতে বিরল। এই সঙ্গীত শিল্প কত শতসহস্র বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে আজ একটা জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে। শাস্ত্রীয় বা লোকসঙ্গীত থেকে শুরু করে কালের সাথে তাল মিলিয়ে আধুনিক গানের জনপ্রিয়তা বেড়েই চলেছে। ছায়াছবির গান হলে তো কথাই নেই। তার ওপর আছে র‍্যাপ বা ফিউশনের মত মারাত্মক জিনিস যা আনন্দও দিতে পারে আবার কিছু শ্রোতাকে অস্বস্তিতেও ফেলতে পারে। আমি সঙ্গীতজ্ঞ বা সঙ্গীত বিষারদ নই; তবে বিভিন্ন সময়ের অনেক ভালো শিল্পীর একজন গুণমুগ্ধ শ্রোতা হিসাবে গান নিয়েই খুব সাধারণ কিছু অনুধাবনের কথা তুলে ধরতে চাই।

আমাদের বয়েসী যারা খুব ছোটবেলায় রেডিওতে পঙ্কজ মল্লিক বা শচীন কর্তার গান শুনে মনে করত আমার বাবা-কাকার মনের মত কথা আর সুর-তাল-লয়, মান্না বা হেমন্তর গান শুনলে বেশ আধুনিকতার স্বাদ পেত, আর আর. ডি. বা কিশোরের গান একটু অকালপক্ক ছেলেপুলের মানায় ভাবা হত – আমরা কিন্তু বাছবিচার না করে সব গানই শুনেছি। আর শুধু শোনা কেন, কথাগুলোর মানে বোঝা আর সুরের মুর্ছনায় ডুবে যাওয়ার মধ্যে এক ধরণের আনন্দ ছিল। একটু বড় হয়ে যেসব গান নিয়ে বন্ধুদের সাথে আলোচনাও করতাম। তখন তো কেউ কল্পনাতেও আনেনি ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ কিম্বা ‘বেহাগ যদি না হয় রাজি’ সোস্যাল মিডিয়ায় কত মিলিয়ন ‘লাইক’ পেয়েছে?

কিছুদিন আগে প্রখ্যাত শিল্পী ও কোলকাতার বিবিধ ভারতীতে প্রত্যেক রোববার দুপুরের এক বিশেষ অনুষ্ঠানের সঞ্চালিকা শ্রাবন্তী মজুমদারের সাথে কথা হচ্ছিল আগেকার শিল্পী-শ্রোতাদের আত্মিক সম্পর্ক নিয়ে। মনে আছে কত শিল্পীর কত কালজয়ী গান আমরা শুনতে পেতাম রেডিওতে যা আমাদের মনে একধরনের তৃপ্তি দিত। সেসব গান তৈরীর পেছনে সঙ্গীতের সঙ্গে যুক্ত কলা-কুশলীদের অনেক সাধনা আর পরিশ্রম দিতে হয়েছে। এখনকার মত একটা গানকে ভেঙ্গে টুকরো করে আলাদা আলাদা রেকর্ড করে শেষে সুন্দরভাবে জোড়া দিয়ে পুরো গান করা যেত না। শুনেছি অনেক ছবির গান আগেভাগে তৈরী হয়ে যায়, পরে সেগুলো ছায়াছবির ডায়লগের ফাঁকে ফাঁকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ফ্লেক্সিবিলিটী অনেকগুণ বেশী আর প্রযুক্তির অবদানও অসামান্য।

এবার আসা যাক গানের কথা নিয়ে। রবীন্দ্রনাথ বা নজরুল ছেড়ে দিলাম, আধুনিক বা ছায়াছবির গান লিখে যারা অনেকের মনকে নাড়া দিয়েছেন তাদের গানের আবেদন চিরকাল থেকে যাবে। যারা গানবাজনার চর্চা করেন বা সত্যিই ভালোবাসেন তারা কিন্তু সেইসব চিরকালের গানগুলোর কথা বা সুরের প্রতি সমানে শ্রদ্ধাবান। আজ অনায়াসেই আমরা কত লাইভ অনুষ্ঠান আর রিয়্যালিটি শো দেখতে পাই টেলিভিশনের পর্দায় কিম্বা ওটিটি মারফৎ। এবার মজাটা হল এই যে, আমরা যখন একজন শিল্পীকে মুখ নেড়ে বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দুলিয়ে বা পুরো মঞ্চ জুড়ে নৃত্য-সহকারে গান পরিবেশন করতে দেখি সেই ভিজ্যুয়াল ব্যাপারটা বাড়তি আকর্ষণ হিসেবে পাই। কান দিয়ে শোনা ছাড়াও চোখ দিয়ে দেখার সুযোগ যখন আছেই তাহলে কে না চায় শিল্পীকে একটু দেখে নিতে?

একজন শিল্পীর কাজ তাঁর কলাকুশলীকে যতটা সম্ভব উজাড় করে সবার সামনে তুলে ধরা। সঙ্গীত পিপাসুদের ক্ষেত্রে যে আমুল পরিবর্তন হয়েছে – রেডিও খুলে কোলকাতা ‘ক’-তে কান পেতে গান শোনা আর আজকের মুঠোফোনে ‘রীল’ খুলে কারও গান দেখা – এই দুই এর মধ্যে বিরাট পার্থক্য। ছোটবেলায় কি কখনও ভেবেছি যে হেমন্ত মুখার্জী কেমন দেখতে ছিলেন বা কেমন করে সবার সামনে গাইতেন? আমাদের মনে আছে ছবিতে উত্তমকুমার কেমন সেই গানটাকে অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে উপস্থাপন করেছেন। দু’জনেই অসম্ভব গুণী, কিন্তু গান শোনার সময় হেমন্তর গলাকে বাহবা দিতাম। এর উল্টোটাও হতে পারে। অরিজিৎ বা শ্রেয়ার গান শুনে যারা মুগ্ধ তাদের কাছে ছবিতে কে লিপ দিয়েছেন সেটা বড় কথা না। ভালো ছবি ভালো অভিনেতা হলে দু’ভাবেই একটা গান প্রশংসিত হয়।

আজ যে মাধ্যমেই আমরা সঙ্গীতের স্বাদ নিয়ে থাকি না কেন, আমাদের সামনে লক্ষ লক্ষ আইটেম। বন্ধুমহলে ঠাট্টা করে বলে থাকি আজকাল ভালো শ্রোতার চেয়ে শিল্পীর সংখ্যা হয়তো একটু বেশী। একটা গান শুনে তার কথার কদর কজন করে বা কেই বা ভাবে সুরের মধ্যে কোন রাগের আশ্রয় আছে? একটা গান কোনও ছবিতে হিট হলে সেই ছবিটাই মনে বড় ছাপ ফেলে। গান শোনা আর গান দেখার মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির তফাৎ একটা থাকেই। তার মানে এই নয় যে আজকের প্রজন্ম ‘রীল’ করা নিয়ে বেশী চিন্তিত বলে গান ভালো করে না। কিম্বা ভালো অভিনেতা-অভিনেত্রী না পেলে ‘রীল’ ভালো চলবে না এটা ভাবাও ভুল।

আজ থেকে চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে সংখ্যায় অনেক কম গান শোনার সুযোগ ছিল, তাতেই যেন আমরা মগ্ন হয়ে যেতাম। এখন এত শিল্পী এত গানের প্রকার আর প্রচার-মাধ্যমের দাপট যে পছন্দের গান বাছাই করাও বেশ কঠিন কাজ। আর কোন গানটা একবারের জায়গায় দু’তিন বার শুনবো সেটা ঠিক করা আরও জটিল। কত ভালো গান এখনও তৈরী হয়ে চলেছে, কিন্তু তাও মনে হয় যেসব গান আজ থেকে চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগেই হিট করেছে সেগুলো বারবার শোনাই যায়। হয়তো হাজার বার সেইসব কথা আর সুর শুনতে শুনতে মস্তিস্কে গভীর দাগ কেটে ফেলেছে তাই। তার মানে দাঁড়ালো ভালো গান কান দিয়ে আমাদের মস্তিষ্কে প্রবেশ করে আর পাকাপাকি জায়গা করে নেয়। একটা গানে কথার গভীরতা আর সুরের মূর্ছনার সঠিক মেলবন্ধন ঘটলেই শ্রোতাদের মনকে নাড়া দেয় আর সেইসব গান এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে স্বচ্ছন্দে ফিরে ফিরে আসে।