নিজস্ব প্রতিনিধি, বারাসত: ভরাডুবি বারাসতের যুবসমাজের। জুয়ার নেশায় নিমগ্ন হচ্ছেন ছাত্র-যুবরা। বর্তমানে বারাসত শহরটিই পরিণত হয়েছে লোটো এবং সাট্টার রমরমা বাজারে। একটি নয়, দু’টি নয়, বারাসতের ৩৫টি ওয়ার্ড জুড়েই রমরমিয়ে চলছে লোটো, সাট্টা সহ জুয়া খেলা। শুক্রবার হঠাৎই বারাসতের আরিফ বাড়ির মোড়ে হানা দেয় বারাসত পুলিশ। সেখানে অবস্থিত একাধিক লোটোর ঝুপড়ি থেকে সাতটি মেশিন (কম্পিউটার) ও দশটি মোবাইল বাজেয়াপ্ত করা হয়। সেই সঙ্গে ১০,৮৬৭ টাকা নগদ অর্থ উদ্ধার করেছে পুলিশ। বারাসত পুলিশ জেলার পুলিশ সুপার প্রতীক্ষা ঝাড়খড়িয়া নিজেই এই বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, বাজেয়াপ্ত করা তিনটি মেশিনের দায়িত্বে রয়েছেন সোমেন নামক এক ব্যক্তি। আর এই সোমেনের কার্য পরিচালনা করেন মানিকতলা বিধানসভায় বসবাসকারী বিক্রম নামক অপর এক ব্যক্তি। বিভিন্ন সূত্র মারফত জানা যায়, নিতান্তই দাপুটে ব্যক্তি এই বিক্রম। অর্থের বিনিময়ে প্রশাসনকে দমিয়ে রেখে জুয়া খেলার পথকে সুগম করেন তিনি। এমনকি, সোমেনের দাপটও কম নয়! “নেতা, পুলিশ টাকা পয়সা দিয়ে চালাই”, এমন বিকৃত মন্তব্যও করতে শোনা গিয়েছে সোমেনকে।
তবে এখনও অধরা মূল পাণ্ডা এই সোমেন এবং বিক্রম। বিরোধীদের অভিযোগ, সোমেন, বিক্রমের মতো কিছু দাপুটে ব্যক্তিরাই অর্থের বিনিময়ে প্রশাসন এবং কিছু তৃণমূল নেতৃত্বের মদতপুষ্ট হয়ে গোটা বারাসত জুড়ে এই জুয়ার অসাধু ব্যবসা চালাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, লোটো-সাট্টার পাশাপাশি যুবসমাজের হাতে হাতে ঘুরছে কিছু ড্রাগস। আর ড্রাগসের নেশাই নিঃস্ব করছে বারাসত শহরকে। আজকের যুব সম্প্রদায়ের এই করুণ পরিস্থিতির জন্য দায়ী কারা? অবশ্যই, পুলিশ-প্রশাসন এবং শাসকদলের কিছু নেতৃত্ব।
উল্লেখ্য, বারাসতের পাড়ায় পাড়ায় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে জুয়ার কারবার। রাস্তার ধারে, পাড়ার মোড়ে ঝুপড়ি প্রস্তুত করেই তার অভ্যন্তরে চলছে দেদার টাকার বাজি। লোটো সাধারণত বসে বারাসতের হাটখোলা বার, হসপিটাল গেট, চরকডাঙ্গা মায়া রেস্টুরেন্ট চত্বরে। অন্যদিকে, সাট্টা সাধারণত বসে বিজয়া সিনেমা হলের সামনে, ১২নম্বর রেলগেট সহ বারাসতের বিভিন্ন অঞ্চল জুড়ে। এই লোটো-সাট্টার রমরমা ব্যবসার গ্রাস করেছে বারাসতের যুবসমাজকে। কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছে যুবদের ভবিষ্যতের আকাশে।
এখন প্রশ্ন হল, এসবের পরও প্রশাসন কি তাহলে চোখ বুজে রইল? জুয়ার অসাধু ব্যবসা একদিনে বারাসত ছেয়ে যায়নি। মাসের পর মাস ধরে এই কার্যক্রম চলে আসছে শহরের বুকে। যুবক-যুবতীরা দিনে দিনে অসৎ সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে জেনেও, পূর্বেই কেন কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হল না পুলিশের তরফ থেকে? এই প্রশ্ন তুলছেন শহরের বাসিন্দা থেকে বিরোধী শিবির। কেনই বা মাত্র তিনটি মেশিন বাজেয়াপ্ত করা হল? যেখানে লোটো-সাট্টার ঝুপড়িতে ঢেকে গিয়েছে শহরের পাড়া-পাড়া! সঠিকভাবে কেন তল্লাশি অভিযান চালানো হচ্ছে না জুয়া কারবারের বিরুদ্ধে? বিরোধীদের স্পষ্ট দাবি, শাসকদলের মদত ব্যতীত বারাসত শহরের প্রত্যেক পাড়ায় পাড়ায় দেদার জুয়ার কারবার চালানো অসম্ভব। তৃণমূল কংগ্রেসের বেশ কিছু নেতৃত্ব প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মদত করে যাচ্ছেন এই জুয়া কারবারিদের। যার ফলে তাদের সাহস পরিণত হয়েছে দুঃসাহসে।
এখানেই শেষ নয়, পুলিশ প্রশাসনও যে চোখে কালো কাপড় বেঁধেছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এক্ষেত্রে বিরোধী শিবিরের দাবি, শাসকদলের কিছু অসাধু নেতৃত্বের সঙ্গেই হাত মিলিয়েছে পুলিশ। যার জেরেই বাড়তি সুবিধা পেয়েছেন লোটো-সাট্টার আয়োজকরা। কেবল বিরোধীদের বক্তব্যই নয়, প্রশাসন ও বেশ কিছু তৃণমূল নেতৃত্বের তরফ থেকে পরোক্ষ সাহায্য পাওয়ার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন এক সাট্টার আয়োজক। অর্থের বিনিময়ে প্রশাসন এবং কিছু তৃণমূল নেতা লোটো ও সাট্টার ব্যবসা জারি রাখার অনুমতি দেন। এমনই খবর মিলেছে এক সূত্র মারফত। লক্ষ্মী লাভ দেখেই অসাধু ব্যবসার প্রতি আত্মনিয়োগ করেছে পুলিশ প্রশাসন থেকে কিছু তৃণমূল নেতৃত্ব।
অন্যদিকে, এবারের লোকসভা নির্বাচনে বারাসতে তৃণমূল কংগ্রেসের জয় হলেও শহরাঞ্চলে ভোট কমেছে শাসক দলের। একাধিক পুরসভাতে হার হয়েছে জোড়াফুল শিবিরের। উন্নয়ন হওয়া সত্ত্বেও বারাসত শহরে তৃণমূলের পশ্চাদগামীতার অন্যতম কারণ হল এই জুয়ার কারবার। এমনই বলছে বিরোধী শিবির। লোটো-সাট্টার প্রতি তৃণমূলের কিছু নেতৃত্বের সহযোগিতা, শহুরে মানুষকে তৃণমূল বিমুখ করে তুলছে।