হীরক কর
ঘটনার সূত্রপাত সেই সাতচল্লিশে। যেদিন কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিং ভারতের সঙ্গে সংযুক্তি করনের প্রশ্নে দ্বিধায় ছিলেন। ১৯৪৭ সালে ভারত-বিভাজনের অন্যতম শর্ত ছিল, ভারতের দেশীয় রাজ্যের রাজারা ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দিতে পারবেন, অথবা তাঁরা স্বাধীনতা বজায় রেখে শাসনকাজ চালাতে পারবেন। কিন্তু, ভারত না পাকিস্তান, কার সঙ্গে যাবেন, দ্বন্ধে ছিলেন হরি সিং। শেষপর্যন্ত অবশ্য ১৯৪৭ সালের ২৬ শে অক্টোবর হরি সিং কাশ্মীরের ভারতভুক্তির চুক্তিতে সই করেন। কালের নিয়মে তাঁকে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ডাকতে জওহরলাল নেহরুর দ্বারস্থ হতে হয়। কেননা ততদিনে পাকিস্তানি সেনা বাহিনী হরি সিংয়ের কাশ্মীরের অনেকটাই দখল করে নিয়েছে। তৈরি হয়েছে “লাইন অব কন্ট্রোল” অর্থাৎ ‘এলওসি ‘।
দুটি প্রতিবেশী দেশ, যে দেশগুলো ১৯৭১ সালে একটি উল্লেখযোগ্য সংঘাতে জড়িয়ে পরে । যার ফলস্বরূপ গঠিত হয় ‘বাংলাদেশ’। পাকিস্তানের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করে দেয় ভারত। জন্ম নেয় ‘বাংলাদেশ’। প্রতিশোধ স্বরূপ তখন থেকেই ‘কাশ্মীর’কে ভারতের থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার ব্রত নেয় পাকিস্তান।
এই নিয়েই পরবর্তী বছরগুলোতে চলমান উত্তেজনা অনুভব করেছে একই সময়ে জন্ম নেওয়া দুই প্রতিবেশী দেশ। যদিও সরাসরি সশস্ত্র সংঘাত সীমিত করা হয়েছে। তবে তারা “এলওসি”-র কাছাকাছি পর্বতশৃঙ্গগুলোতে সামরিক ফাঁড়ি স্থাপন করে সিয়াচেন হিমবাহের নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।
উত্তেজক পরিস্থিতি আরও বৃদ্ধি পায় যখন উভয় দেশ ১৯৯৮ সালে পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়। উত্তেজনা কমানোর জন্য, তারা ১৯৯৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে লাহোর ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করে । যার লক্ষ্য ছিল কাশ্মীর সংঘাতের একটি শান্তিপূর্ণ ও দ্বিপাক্ষিক সমাধান চাওয়া।
১৯৯৯ সালে, প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর পাকিস্তান সফরের তিন মাসের মধ্যেই, পিছন থেকে ছুরি মেরেছিল পাকিস্তান। সীমান্তরেখা পেরিয়ে কাশ্মীরের ঢুকে পাক সেনা দখল করে নিয়েছিল, প্রবল তুষারপাতের জন্য শীতকালে ছেড়ে যাওয়া ভারতীয় ঘাঁটিগুলি। পাক সেনার মূল লক্ষ ছিল ১-ডি জাতীয় সড়কটিকে দখল করে ভারত থেকে লাদাখকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। লাদাখকে বিচ্ছিন্ন করতে পারলেই পাকিস্তান নির্বিঘ্নে দখল করে নেবে সিয়াচেন গ্লেসিয়ার। যেটি নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে তুমূল লড়াই চলছে দশকের পর দশক। কিন্তু পাকিস্তান কাজটা যতটা সহজ ভেবেছিল, কাজটা ততটা সহজ ছিল না। পাক হানাদারদের খতম করতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর শুরু করেছিল ‘অপারেশন বিজয়’। শ্রীনগর থেকে ২০৫ কিলোমিটার দূরের গ্রাম ‘কার্গিল’ হয়ে উঠেছিল এক রক্তক্ষয়ী রণাঙ্গণ। যুদ্ধ চলাকালীন ও যুদ্ধের অব্যবহিত পরে পাকিস্তান এই যুদ্ধের দায় সম্পূর্ণত কাশ্মীরি জঙ্গিদের ওপর চাপিয়ে দেয়। তবে যুদ্ধের পর ফেলে যাওয়া তথ্যপ্রমাণ এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধানের পরবর্তীকালের বিবৃতি থেকে স্পষ্টতই জানা যায় যে পাকিস্তানের আধাসামরিক বাহিনীও এই যুদ্ধের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল। এই বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জেনারেল আশরাফ রাশিদ।
সম্প্রতি এক চাঞ্চল্যকর তথ্য এসেছে ভারতের একটি খুফিয়া এজেন্সির হাতে । আর ভারতীয় এজেন্সিটিকে তথ্য সরবরাহ করে ইজরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা ‘মোসাদ ‘। ‘মোসাদ ‘-এর খবর কার্গিল যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ১৯৯৯ সালের ২৮ মার্চ তৎকালীন পাক সেনা প্রধান পারভেজ মুশারফ নিয়ন্ত্রণ রেখা ( ‘এলওসি’) পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছিলেন। আর ভারতে নাকি এক রাত কাটিয়েও গিয়েছিলেন। তিনি এসেছিলেন কাশ্মীরি মুজাহিদের ভেকধারী পাকিস্তানী সেনাদের ভারতে ঢুকিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা সরজমিনে দেখতে। আর কার্গিল যুদ্ধ শুরু হয় ঠিক তার একমাস পাঁচ দিন বাদেই। ৩ রা মে, ১৯৯৯ সালে।
সেই সময় অনুপ্রবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছিল পাক সেনা। প্রায় ৫০০০ জওয়ানকে কার্গিলে প্রবেশের জন্য পাঠিয়েছিলেন মুশারফ। ভারত-পাকিস্তান দুই দেশই তখন পারমাণবিক শক্তিধর দেশ ছিল। যুদ্ধে পিছিয়ে পড়ে ভারতের বিরুদ্ধে নাকি পারমাণবিক শক্তি প্রয়োগের পরামর্শও দিয়েছিলেন সেনা প্রধান মুশারফ।
অনুপ্রবেশকারীদের নিকেশের পর ভারতীয় সেনা যখন তাদের তল্লাশি চালায়, প্রত্যেকের কাছ থেকে পাকিস্তানের পরিচয়পত্র পাওয়া যায়। পাকিস্তানের দাবি অনুযায়ী, কারগিল যুদ্ধে সে দেশের ৩৫৭ জন সৈনিকের মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু ভারতীয় সেনার তদন্তে অন্য তথ্য উঠে এসেছিল। তিন হাজারেরও বেশি পাক সেনাকে জান্নাতের রাস্তা দেখানো হয় । যাঁদের বেশিরভাগই পাকিস্তানের প্যারা মিলিটারি ফোর্সের জওয়ান ছিল। ১৯৯৯ সালের পর এঁদের রেগুলার রেজিমেন্টে শামিল করা হয়।
যুদ্ধ চলাকালীন এবং যুদ্ধের অব্যবহিত পরে পাকিস্তান এই যুদ্ধের দায় সম্পূর্ণত কাশ্মীরি জঙ্গিদের ওপর চাপিয়ে দেয়। তবে যুদ্ধের পর ফেলে যাওয়া তথ্যপ্রমাণ এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধানের পরবর্তীকালের বিবৃতি থেকে স্পষ্টতই জানা যায় যে পাকিস্তানের আধাসামরিক বাহিনীও এই যুদ্ধের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল। এই বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জেনারেল আশরাফ রাশিদ।
গোপনে পাকিস্তান “অপারেশন বদর” নামে ভারতীয় ভূখন্ডে তার বাহিনী পাঠিয়ে কার্গিল এলাকা দখল করে।অনুপ্রবেশের এজেন্ডা ছিল কাশ্মীর থেকে লাদাখকে বিচ্ছিন্ন করা । এবং সিয়াচেন উপত্যকার বাসিন্দাদের ক্ষুধার্ত করে ভারতকে পাকিস্তানের শর্ত মেনে নিতে বাধ্য করা।
ভারত যাতে এই যুদ্ধে পাকিস্তানের সঙ্গে পেরে উঠতে না পারে তার জন্য পাক বাহিনীর পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করেছিল চীনা সেনার আর্টিলারি বাহিনীও । এই তথ্যও ভারতীয় গোয়েন্দা এজেন্সির কাছে এসেছে ।পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অপারেশন বিজয়ের অধীনে কার্গিলকে সুরক্ষিত করতে বিশেষ বাহিনীর সাথে প্রায় ৩০ হাজার সৈন্য কার্গিল এলাকায় চলে আসে।
কারগিল যুদ্ধের সেনাপ্রধান জেনারেল ভিপি মালিক নিজের বই “ভারত রক্ষক মনিটর- ভলিউম ফোর”-এ ভারত যে কার্গিল যুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিয়েছে সে সম্পর্কে লিখেছেন। প্রথম এবং সর্বাগ্রে, তিনি ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে একটি ‘প্রক্সি যুদ্ধ’ বা ‘ছায়া যুদ্ধ’কে একটি প্রচলিত যুদ্ধে পরিণত হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। দ্বিতীয়ত, তিনি উল্লেখ করেছেন যে “রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সন্ত্রাস” একটি অস্ত্র । এটি প্রধানত ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে সামাজিক-রাজনৈতিক বিভাজনের কারণে বিস্তৃত হয়।”পরমাণু অস্ত্র”- ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা কমিয়ে দিয়েছে এমন ধারণাকে তিনি অস্বীকার করেন । তাঁর মতে, যে কোনো সময় এই দুটি দেশের মধ্যে প্রচলিত যুদ্ধ খুবই সম্ভব । এবং কার্গিল যুদ্ধ সেই ব্যপারে সতর্ক করেছে ভারতকে,- পাকিস্তানকে বিশ্বাস নেই,সদা সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে।
জেনারেল ভিপি মালিক তাঁর বইতে লিখেছেন, তদুপরি, কৌশলগত সংস্কৃতির অভাব এবং বেসামরিক-সামরিক সম্পর্কের ভারসাম্যহীনতা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। ভারতীয় সামরিক বাহিনীকে আকস্মিক আক্রমণ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী , যা ভারতীয় সামরিক বাহিনীর অবমূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেয় তাঁরা । তিনি যুদ্ধের সম্ভাবনা ও উত্তেজনা কমাতে আরও স্বচ্ছতা এবং আস্থা ও নিরাপত্তা-নির্মাণ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার ওপরও জোর দেন। প্রতিটি যুদ্ধই কিছু শিক্ষা দেয়। সর্বোচ্চ যুদ্ধক্ষেত্র, কার্গিলে সংঘটিত যুদ্ধের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ছিল না।
অপারেশন বিজয়ে অংশ নেওয়া সৈন্যদের গর্ব এবং বীরত্বকে পুনরুজ্জীবিত করতে প্রতি বছর ২৬ শে জুলাই কার্গিল বিজয় দিবস পালিত হয়। ভারত পাকিস্তানের এই লড়াইটি ‘কার্গিল যুদ্ধ’ নামে পরিচিত । ২৬ শে জুলাই, ১৯৯৯-এ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দ্বারা দখল করা পর্বত শৃঙ্গ গুলো দখলে ভারতীয় সৈন্যদের বিজয়কে চিহ্নিত করে।
ভারতীয় সৈন্যদের অফিসিয়াল মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৫২৭ জন সেনা, যেখানে পাকিস্তানের পক্ষে, মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৩৫৭ থেকে ৪৫৩ এর মধ্যে। কার্গিল যুদ্ধের সময় ভারত তার অন্যতম সাহসী সৈন্য, ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রাকেও হারিয়েছিল। এই দিনটি কার্গিলের সুপারহিরোদের সম্মান জানানো হয়। ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রা তাঁর মৃত্যুর পর ভারতের সর্বোচ্চ বীরত্বের সম্মান পরম বীর চক্রে ভূষিত হন। ‘শেরশাহ’ নামে একটি হিন্দি ছবি মুক্তি পায় যা ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রার জীবন কাহিনীকে বিশদভাবে চিত্রিত করেছিল।
উল্লেখযোগ্যভাবে ২ মাস, ৩ সপ্তাহ,২ দিন দীর্ঘ যুদ্ধের পর, ২৬ জুলাই, ১৯৯৯-সালে শেষ হয়। ভারতীয় সৈন্যরা পাকিস্তানি অনুপ্রবেশকারীদের তাদের দখলকৃত অবস্থান থেকে সরিয়ে দেয়। এটি ভারতীয় যুদ্ধের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য দিন হয়ে ওঠে। পোষাকি নাম, ‘কার্গিল বিজয় দিবস’। আজ, ২৬শে জুলাই। আজ কার্গিল দিবস। আমার ভারতের সেনাদের স্যালুট। জয় হিন্দ।