• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

উপনির্বাচনে বড় ধাক্কা : সমবায়ী যুক্তরাষ্ট্রের পথে হাঁটবে বিজেপি?

শোভনলাল চক্রবর্তী: লোকসভা মিটতে না-মিটতেই পশ্চিমবঙ্গ-সহ সাতটি রাজ্যের উপনির্বাচনে ধাক্কা খেল বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ। ১৩টি আসনের মধ্যে বিজেপি-বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র ঝুলিতেই গেল ১০ আসন। বাকি তিন আসনের মধ্যে মাত্র দু’টি আসনে জয় পেয়েছে বিজেপি। একটা আসনে জিতেছেন নির্দল প্রার্থী। কোনও কেন্দ্রের বিধায়কের দলবদল, কোনও কেন্দ্রে আবার বিধায়কের মৃত্যুর কারণে আসন ফাঁকা হয়ে যায়। সেই সব আসনেই

শোভনলাল চক্রবর্তী: লোকসভা মিটতে না-মিটতেই পশ্চিমবঙ্গ-সহ সাতটি রাজ্যের উপনির্বাচনে ধাক্কা খেল বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ। ১৩টি আসনের মধ্যে বিজেপি-বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র ঝুলিতেই গেল ১০ আসন। বাকি তিন আসনের মধ্যে মাত্র দু’টি আসনে জয় পেয়েছে বিজেপি। একটা আসনে জিতেছেন নির্দল প্রার্থী। কোনও কেন্দ্রের বিধায়কের দলবদল, কোনও কেন্দ্রে আবার বিধায়কের মৃত্যুর কারণে আসন ফাঁকা হয়ে যায়। সেই সব আসনেই উপনির্বাচন করিয়েছিল নির্বাচন কমিশন।

রাজনৈতিক মহলের মতে, লোকসভার ভোটের পর উপনির্বাচনের ফল চিন্তায় রাখবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী-সহ বিজেপি নেতৃত্বকে।উত্তরাখণ্ডের দু’টি আসন— বদ্রীনাথ এবং মঙ্গলৌরও মল্লিকার্জুন খাগরে-রাহুল গান্ধীর দলের দখলে। একটি আসন বিজেপি জিতেছে। এ ছাড়াও পঞ্জাবের জালন্ধর পশ্চিম বিধানসভায় আম আদমি পার্টি (আপ) এবং তামিলনাড়ুর বিক্রবন্দিতে ডিএমকে জিতেছে। মধ্যপ্রদেশের অমরওয়াড়ায় জিতেছে বিজেপি। হিমাচল প্রদেশের হামিরপুরে বিজেপি জিতেছে। দেহরায় জিতেছেন কংগ্রেস প্রার্থী তথা সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সুখবিন্দর সিংহ সুখুর স্ত্রী কমলেশ। নালাগড়েও জয়ী কংগ্রেস। বিহারের একটি আসনে জিতেছেন নির্দল প্রার্থী। পশ্চিমবঙ্গে উপনির্বাচনে তিনটি আসন বিজেপির হাতছাড়া হয়েছে। রায়গঞ্জ, রানাঘাট দক্ষিণ, বাগদা এবং মানিকতলার উপনির্বাচনে জিতেছে তৃণমূল। অথচ ২০২১-এর নীলবাড়ির লড়াইয়ে এর মধ্যে প্রথম তিনটি ছিল বিজেপি দখলে।উপনির্বাচনের আগে এই ১৩টি আসনের মধ্যে চারটি আসন বিজেপির দখলে ছিল। বাকি ৯টি আসনের মধ্যে পাঁচটি ছিল বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র। তিনটি নির্দল এবং একটি বিএসপির। সে দিক থেকে দেখতে গেলে পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া একমাত্র বিহারেই এনডিএ আসন হারিয়েছে। বাকি রাজ্যগুলির মধ্যে হিমাচল প্রদেশ এবং মধ্যপ্রদেশে হারা আসন নিজেদের দখলে এনেছে বিজেপি। অন্য দিকে, কংগ্রেস হারা তিনটি আসন জিতলেও মধ্যপ্রদেশের অমরওয়াড়াতে উলটপুরাণ হয়েছে। কংগ্রেসের জেতা আসনে থাবা বসিয়েছে বিজেপি।

পশ্চিমবঙ্গে এবার বিজেপির আসন সংখ্যা আরও কমে গেল। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি ৭৭টি আসন জিতেছিল। এই উপনির্বাচন শেষে তাদের খাতায়-কলমে বিধায়কের সংখ্যা এসে দাঁড়াল ৭১-এ।উপনির্বাচনের ফল থেকে স্পষ্ট বিজেপির সে অর্থে ‘ভরাডুবি’ হয়নি। এই ভোটে নিজেদের আসন সংখ্যা বাড়িয়ে নেওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হয়ে ওঠেনি।ভারতীয় শাসনতন্ত্র নামে যুক্তরাষ্ট্রীয়, কাজে এককেন্দ্রিক— এ-কথায় কোনও নতুনত্ব নেই, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রাথমিক স্তরের পরীক্ষায় ছাত্রছাত্রীরা বর্ষে বর্ষে দলে দলে এই বিষয়ে বিস্তর শব্দে খাতা ভরিয়ে এসেছে। এ-কথাও সর্বজনবিদিত যে, রাজ্যের উপর কেন্দ্রের ক্ষমতা জাহির করবার নানা প্রকরণ থাকলেও প্রথম এবং প্রধান প্রকরণটির নাম: বলং বলং অর্থবলম্। কোষাগারের চাবি কার্যত কেন্দ্রের দখলে, সুতরাং দুই তরফের অবস্থান কোনও কালেই সমান থাকেনি। তার ফলে কেন্দ্র-রাজ্য আর্থিক সম্পর্ক অনিবার্য ভাবেই ক্রমাগত দড়ি টানাটানির চেহারা নিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আর্থিক সম্পদের দাবিতে রাজ্যকে নানা ভাবে চাপ সৃষ্টি করতে হবে, বাস্তব পরিস্থিতি বুঝে যে যত বেশি চাপ দিতে পারবে সে তত টাকা আদায় করতে পারবে, এমনটাই এ-খেলার কালজয়ী রীতি।

স্বভাবতই, কেন্দ্রীয় সরকার গড়তে যদি প্রধান শাসক দলের একার জোরে না কুলোয়, শরিকদের উপর নির্ভর করতে হয়, বিশেষত এমন শরিকের উপর যারা রাজ্য স্তরে সরকার চালাচ্ছে, তা হলে এই খেলায় একটি বিশেষ মাত্রা যুক্ত হয়। সেই শরিকরা নিজের রাজ্যের জন্য রকমারি সুযোগসুবিধার দাবি জানিয়ে কেন্দ্রের প্রধান শাসকের উপর চাপ সৃষ্টিতে অতিমাত্রায় তৎপর হয়ে ওঠে। কোষাগারের উপর কেন্দ্রের আধিপত্য তখন শাসকের পক্ষে এক বিড়ম্বনা হয়ে দাঁড়াতে পারে।এই বিড়ম্বনাই আপাতত নরেন্দ্র মোদীর নিত্যসঙ্গী। দশ বছরের একাধিপত্য হারিয়েছেন তিনি, সংসদে তাঁর সরকারের স্থিতি নির্ভর করছে শরিকদের, বিশেষত দুই প্রধান শরিক দল জেডি(ইউ) ও টিডিপি-র সমর্থনের উপর।

লক্ষণীয়, এই দুই শরিকেরই ‘হিন্দুত্ব’ নিয়ে বিশেষ কোনও মাথাব্যথা নেই, সঙ্ঘ পরিবারের সঙ্গে তাদের নৈতিক কোনও বন্ধন নেই, ফলে তাদের সঙ্গে মোদী বা তাঁর দলের সম্পর্ক ষোলো আনাই স্বার্থবুদ্ধির ছকে বাঁধা। স্বার্থের সম্পর্ক এবং অর্থের সম্পর্ক এ ক্ষেত্রে সমার্থক। বিহারের নীতীশ কুমার এবং অন্ধ্রপ্রদেশের চন্দ্রবাবু নায়ডুর স্বার্থ আপন আপন রাজ্যের স্বার্থের সঙ্গে ওতপ্রোত, কারণ উভয়েরই রাজনৈতিক লীলাক্ষেত্র বহুলাংশে স্বরাজ্যে সীমিত। এবং এই দুই শরিক দলই আপন রাজ্যের শাসনক্ষমতায়। দুই দলনায়কই প্রবীণ এবং ধুরন্ধর রাজনীতিক। সুতরাং তাঁরা আপন সমর্থনের বিনিময়ে রাজ্যের জন্য বাড়তি সম্পদ ও সুযোগ আদায়ে বদ্ধপরিকর। বিশেষ সুবিধাসম্পন্ন রাজ্যের তকমাই হোক আর পরিকাঠামো ও অন্যান্য খাতে বিশেষ বরাদ্দই হোক, প্রধানমন্ত্রী তথা তাঁর অর্থমন্ত্রীকে এই দুই রাজ্যের জন্য বাড়তি অর্থের সংস্থান করতে হবে, নান্যঃ পন্থাঃ।

কিন্তু অন্য রাজ্যগুলি কী করবে? যেখানে বিজেপির নিজের শাসন, সেখানে তো নিজের কোলে ঝোল টানার পুরনো রীতি এখন ‘ডাবল ইঞ্জিন’ নামাঙ্কিত ঘোষিত নীতি হিসাবে সাব্যস্ত হয়েছে, সর্বত্র বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসকরা খোলাখুলি ঘোষণা করতে থাকেন যে, রাজ্যেও তাঁদের সরকার গড়া হলে বিশেষ সুবিধা মিলবে! প্রধানমন্ত্রী তাঁর সূচনাপর্বে ‘কোঅপারেটিভ ফেডারালিজ়ম’ বা সমবায়ী যুক্তরাষ্ট্রীয়তার ধ্বজা উড়িয়েছিলেন, অচিরেই ফাঁস হয়ে যায় সেটি নিতান্তই জুমলা, রাজ্যের শাসকরা বিরোধী পক্ষে থাকলে রাজ্যকে শাস্তি পেতে হবে। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের অভিজ্ঞতা বিশেষ ভাবে ভয়াবহ। এই রাজ্যের শাসকরা অংশত রাজনৈতিক বিরোধিতার তাগিদে এবং বহুলাংশে নিজেদের অপদার্থতা ও দুরাচারের তাড়নায় কেন্দ্রের সঙ্গে দীর্ঘকাল যাবৎ যে দ্বন্দ্বের বাতাবরণ তৈরি করে রেখেছেন, তার পরিণামে কেন্দ্রের কাছে রাজ্যের স্বাভাবিক প্রাপ্যও বিভিন্ন ক্ষেত্রে মিলছে না। এখন, ‘শরিক রাজ্য’গুলির বাড়তি চাহিদা মেটানোর অভিঘাতে ‘বিরোধী রাজ্য’ যদি দ্বিগুণ বঞ্চিত হয়, তবে পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎও দ্বিগুণ অন্ধকার হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। সমবায়ী যুক্তরাষ্ট্রের গল্প আপাতত ভুলে যাওয়াই বিধেয়।