• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

কেরালা ও তামিলনাড়ুর মাঝে তিন আদিম অরণ্যের মিলনকেন্দ্র পোল্লাচির ‘টপস্লিপ’ 

পিয়ালী হাজরা    পোল্লাচি, এক মিষ্টি মধুর নাম, যে নাম ভ্রমণপিপাসুদের মনে ঢেউ তোলে।  যেখানে প্রকৃতি অকৃপণ, উদার । কোয়েম্বাটুরের কাছে তামিলনাড়ুর এক ছোট্ট শহর পোল্লাচি। আর এই পোল্লাচি থেকে মাত্র ২৪ কিলোমিটার দূরে শুরু হচ্ছে আন্নামালাই পাহাড়। এই পাহাড়ের উপরে টপস্লিপ । ব্রিটিশদের শাসনকালে পাহাড়জোড়া ঘন বনের বড় বড়় গাছের গুঁড়ি কেটে গড়িয়ে দেওয়া হত পাহাড়ের উপর থেকে। সেইসব গাছের বিশালাকৃতির

পিয়ালী হাজরা 
 

পোল্লাচি, এক মিষ্টি মধুর নাম, যে নাম ভ্রমণপিপাসুদের মনে ঢেউ তোলে।  যেখানে প্রকৃতি অকৃপণ, উদার । কোয়েম্বাটুরের কাছে তামিলনাড়ুর এক ছোট্ট শহর পোল্লাচি। আর এই পোল্লাচি থেকে মাত্র ২৪ কিলোমিটার দূরে শুরু হচ্ছে আন্নামালাই পাহাড়। এই পাহাড়ের উপরে টপস্লিপ । ব্রিটিশদের শাসনকালে পাহাড়জোড়া ঘন বনের বড় বড়় গাছের গুঁড়ি কেটে গড়িয়ে দেওয়া হত পাহাড়ের উপর থেকে। সেইসব গাছের বিশালাকৃতির বহুমূল্য গুঁড়ি নেমে আসত পাহড়ের ঢাল বেয়ে । সেই কারণেই পাহাড়চূড়োর নাম হয়ে যায় টপস্লিপ। আন্নামালাই পাহাড় অরণ্যের একদিকে আন্নামালাই স্যাংচুয়ারি , অন্যদিকে কেরালার পেরাম্বিকুলাম অভয়ারণ্য। টপস্লিপ থেকে চার কিলোমিটার দূরে অনাপ্পাডি চেকপোস্ট পেরিয়ে কেরালার সীমানা।       

পোল্লাচি তামিলনাড়ুর কোয়েম্বাটোর জেলার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। পোল্লাচি পরিচিত ছিল পোজিল ভাইচি নামে যার অর্থ প্রাকৃতিক সম্পদ এবং সমৃদ্ধির দেশ। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সহজ করে পোল্লাচি নামই এখন পরিচিত । একদিকে পশ্চিমঘাট পর্বতমালার সান্নিধ্য, অন্যদিকে দক্ষিণ-পশ্চিম এবং উত্তর-পূর্ব মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাতের কারণে প্রকৃতি এখানে নিজেকে সাজিয়েছে অপরূপ সৌন্দর্যে। মেদহীন, ঋজুশরীরে দাঁড়িয়ে সেগুলের বন, বাঁশবন , বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ, বন্যপ্রাণীর নিশ্চিন্ত আবাসস্থল , একথায় প্রকৃতির স্বর্গ ।  টপস্লিপ হল ভারতের প্রথম মেডিসিনাল প্ল্যান্টস ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টার। এখানে ঔষধি গাছের চাষ হয়ে থাকে। আন্নামালাই  স্যাংচুয়ারি নাম পাল্টে  হয়েছে ইন্দিরা গান্ধি অভয়ারণ্য।  প্যান্থার, হরিণ, বাঘ, হাতি, সিভেট, গাউর, বন্য ভালুক, স্লথ বিয়ার, প্যাঙ্গোলিন, সজারুর অবাধ বিচরণভূমি।  এছাড়াও রয়েছে আন্নামালাই টাইগার রিজার্ভ। পাহাড় আর জঙ্গলের আকর্ষণে এখানে ভিড় জমান পর্যটকেরা। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর পোল্লাচিতে তামিল ও অন্যান্য ভাষার বহু ছবির শ্যুটিং হয়েছে। 
পোল্লাচি থেকে পেরাম্বিকুলাম হাইওয়ে হয়ে টপস্লিপ যেতে যেতে সময় লাগে প্রায়  ২ ঘন্টা, দূরত্ব ৩৬ কিলোমিটার।  পোল্লাচি শহর থেকে বাস যাচ্ছে নিয়মিত।   এই টপস্লিপ ২৫০ প্রজাতির পাখির  আশ্রয়স্থল। এছাড়াও জীববৈচিত্র্যেও খামতি নেই। বাইসন এবাং হাতি দেখা এখানে কোন ভাগ্যের ব্যাপার নয়। এখানে কোজিকামুথি নামে একটি হাতিশিবির রয়েছে , যেখানে প্রশিক্ষিত হাতি বা কুনকি হাতির সেরা সংগ্রহ রয়েছে। বনবিভাগ এখানে আগস্ট মাসে বিশ্ব হাতি দিবস উদযাপন করে থাকে, হাতি সংরক্ষণের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে । ঘন অরণ্যে রাত্রিযাপনে ট্রি – হাউসের ব্যবস্থা রয়েছে।  এছাড়াও রয়েছে বন-বাংলোর ব্যবস্থা। 
 
একদিকে হিলস্টেশন, অন্যদিকে জঙ্গলের বন্য আদিমতা- এই দুইয়ের অনির্বচনীয় সৌন্দর্যে ভরপুর টপস্লিপ ভ্রমণপিপাসুদের কাছে এখন অন্যতম আকর্ষণকেন্দ্র। তাই পরবর্তী ট্যুর প্ল্যানে আপনিও দু-চোখ বুজে বেছেন নিতে পারেন দক্ষিণ ভারতের পোল্লাচিকে। বনবিভাগের দুটি বাংলো রয়েছে টপস্লিপে, বাইসন লজ আর চিতল লজ। পাহাড়চূড়োর এই বনবাংলো দুটিকে ঘিরে রয়েছে ঘন জঙ্গল।  গ্রীষ্মের প্রখর তাপেও এখানে ছড়িয়ে থাকে আলতো ঠান্ডার আবেশ।  সকাল থেকে সন্ধ্যে, যখন-তখন চোখে পড়তে পারে চিতল হরিণের দল। কখনো চলে আসে গউর বা ভারতীয় বাইসন।  এখানে জঙ্গলে ঘোরার জন্য ব্যবস্থা রয়েছে বনবিভাগের মিনিবাসের। চিতল, গউর, সম্বর, ভাগ্য ভাল থাকলে মেলে হাতির দেখাও। এছাড়াও বাঘ, প্যান্থার, নীলগিরি তাহর, ভালুক, বুনো কুকুরদেরও বিচরণভূমি এই জঙ্গল ।  পর্যটকদের খিদে মেটাতে জঙ্গলের গভীরে নিয়ে যায় বনবিভাগের এই বাস।   
 
টপস্লিপে বাস রাস্তার ধারে মিউজিয়াম। ৬ কিলোমিটার দূরে এলিফ্যান্ট ক্যাম্প। পোষা হাতিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এই ক্যাম্পে। হাতিদের ব্যবহার করা হয় গাছের বড় বড় লগ তোলার কাজেও। সেখানে গেলে দেখতে পাবেন জঙ্গলের ইতিউতি কেটে রাখা গাছের মোটা, বড় গুঁড়ি দাঁত আর শুঁড়ের মাঝখানে ধরে তারা সাজিয়ে রাখছে যত্ন করে।  মিউজিয়ামটিতে রয়েছে, এই অঞ্চলের বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখির স্টাফ করা দেহ। মজার কথা হল মিউজিয়ামে রাখা আছে একটি ছবির ফ্রেম, যেটি পর্দা দিয়ে ঢাকা থাকে। সেখানে লেখা আছে, পৃথিবীর সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক প্রাণীকে দেখতে হলে  পর্দাটি তুলুন । যখনই আপনি নিজের হাতে পর্দাটি সরাবেন নিজেরই মুখের প্রতিফলন দেখতে পাবেন আয়নায়। মজার হলেও এক বড়সড় শিক্ষনীয় বার্তা।  টপস্লিপ থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে রয়েছে আরও একটি আকর্ষণীয় দেখার জায়গা স্টুয়ার্ট ব্লক। এখানে একটি প্রাচীন বনবাংলো এবং হুগো উডের কবর রয়েছে। । হুগো উড ছিলেন একজন বিবেকবান ব্রিটিশ নাগরিক যিনি জোর দিয়েছিলেন , কেটে ফেলা প্রতিটি গাছের জন্য একটি করে চারাগাছ রোপণ করতে হবে।   
 
টপস্লিপ অরণ্যের গা ঘেঁষে কারিয়ান শোলা ন্যাশনাল পার্ক। টপস্লিপ থেকে হাঁটা পথ ধরে, জঙ্গলের বুক ভেদ করে তা মিশে গেছে জাতীয় উদ্যানের ভিতরে। জঙ্গলে ঢুকতে গেলে গাইড পাওয়া যাবে টপস্লিপের রিসেপশন কাউন্টার থেকে। আবার টপস্লিপ থেকেই ১২ কিলোমিটার দূরে থুনাকাডাভু । পথেই পড়বে ডিএফও-র কার্যালয়। তার লাগোয়া কেরালা বনবিভাগের সুসজ্জিত, নজরকাড়া বাংলো। লেকের ধারে ট্রি-টপ। থুনাাকাডাভু ড্যাম থেকে সরলরেখায় পথ চলে  গেছে পেরাম্বিকুলাম ড্যামে। সেখানে রয়েছে পিডব্লুডির বাংলো, এবং তথ্যকেন্দ্র। ছিমছাম সাজানো একফালি শহর , , যেন পিকচার পোস্টকার্ড । বাঁধের জলে বোটিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। ড্যাম থেকে টানেলের মধ্যে দিয়ে জল নেমে আসছে পাহাড়ের নিচে। তারই মধ্যে টারবাইন বসিয়ে তৈরি হচ্ছে জলবিদ্যুত। থুনাকাডাভু থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে সুঙ্গমে রয়েছে কেরালা বনবিভাগের এলিফ্যান্ট ক্যাম্প। বনের গভীরে লেকের ধারে ওয়াচ টাওয়ার। 
 
থুনাকাডাভু থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে কান্নিমারা টিক। বিশাল পরিধির আকাশছোঁয়া প্রাচীন সেগুন গাছগুলি সব গাছ ছাড়িয়ে দাঁড়িয়ে বোধহয় সূর্যালোকের আশায়। এই অরণ্যের সামনে এসে দাঁড়ালে মনে হয় আদিম কোনও রহস্য লুকিয়ে রয়েছে এই বনের আনাচে কানাচে।  
 
এমন এক অভিজ্ঞতার শরিক হতে যেকোন ভ্রমণপ্রিয় মানুষের মন চাইবে পোল্লাচির গহন অরণ্যে হারিয়ে যেতে, বিশেষত পাহাড় আর জঙ্গল যাদের মন টানে।  পোল্লাচি যাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় হাওড়া থেকে চেন্নাই হয়ে কোয়েম্বাটুর অবধি ট্রেনে। চেন্নাই থেকে কোয়াম্বাটুর পৌঁছনোর ট্রেন রয়েছে। কোয়েম্বাটুর থেকে পোল্লাচি ৪৫ কিলোমিটার পোল্লাচি থেকে টপস্লিপ ৩৬ কিলোমিটার পথ। 
 
টপস্লিপ যাওয়ার সেরা সময় জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর।  এখানে বনবাংলোগুলি বুক করতে গেলে যোগাযোগ করতে হবে ওয়াইল্ড লাইফ ওয়ার্ডেন , ইন্দিরা গান্ধি ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি মীনাকারাই রোড , পোল্লাচি ।  এছাড়াও যোগাযোগ করা যেতে পারে ফিল্ড ডিরেক্টর, আন্নামালাই টাইগার রিজার্ভ, মীনাকারাই রোড, পোল্লাচি-তে। টেলিফোন নম্বর ০৪২৫৯- ২৩৮৩৬০ , অথাবা টপস্লিপ রিসেপশন -ফোন নম্বর – ৯৩৮৫৭ ২৩২২৪।