• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

উপমহাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষাবিদ মুহম্মদ শহিদুল্লাহ

১৩ জুলাই প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধার্ঘ্য রাজু পারাল ১৯৪৭ সালের ৩ আগস্ট ‘কমরেড’ পত্রিকার ‘দি ল্যাঙ্গুয়েজ প্রবলেম অফ পাকিস্তান’ নামক একটি নিবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, ‘পাকিস্তান রাষ্ট্রের বাংলাভাষী অংশ যদি বাংলা ব্যতীত অন্য কোনও ভাষা রাষ্ট্রভাষা হয়, তাহলে সেই স্বাধীনতা হবে পরাধীনতারই নামান্তর৷’ ১৯৫১ সালে পূর্ববাংলার বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা বাংলাকে সরকারি ভাষারূপে চালু করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে যে

১৩ জুলাই প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধার্ঘ্য

রাজু পারাল

১৯৪৭ সালের ৩ আগস্ট ‘কমরেড’ পত্রিকার ‘দি ল্যাঙ্গুয়েজ প্রবলেম অফ পাকিস্তান’ নামক একটি নিবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, ‘পাকিস্তান রাষ্ট্রের বাংলাভাষী অংশ যদি বাংলা ব্যতীত অন্য কোনও ভাষা রাষ্ট্রভাষা হয়, তাহলে সেই স্বাধীনতা হবে পরাধীনতারই নামান্তর৷’ ১৯৫১ সালে পূর্ববাংলার বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা বাংলাকে সরকারি ভাষারূপে চালু করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে যে স্মারকলিপি দেওয়া হয়, তাতে প্রথম নামটাই ছিল ওই মানুষটির৷ প্রতিবাদী এই মানুষটির নাম ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯)৷ ছিলেন উপমহাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষাবিদ, ভাষাবিজ্ঞানী, গবেষক ও শিক্ষাবিদ৷ ইংরেজি, ল্যাটিন, ফারসি, গ্রিক, পাঞ্জাবি, মারাঠি, সংস্কৃত, তামিল ইত্যাদি একাধিক ভাষায় তিনি দক্ষ ছিলেন৷ বাংলাভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টা ও লেখনী শক্তির প্রভাব ছিল অসাধারণ৷ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনে তিনি প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন৷ মাতৃভাষার প্রতি তাঁর অগাধ শ্রদ্ধাবোধ তাঁকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি রূপে পরিচিতি দেয়৷

কর্মজীবনে শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে আদর্শ মনে করেছিলেন শহিদুল্লাহ৷ কিন্ত্ত আর্থিক প্রয়োজনে ওকালতিকে পেশা করতে বাধ্য হন৷ ওকালতি পেশায় যখন তিনি ব্যস্ত, সে সময়ে (১৯১৯) অকস্মাৎ একদিন স্যার আশুতোষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় শহিদুল্লাহের৷ স্যার আশুতোষ তখন কলকাতা হাইকোর্টের প্রথম শ্রেণির জজ৷ শহিদুল্লাহ ওকালতি করছে শুনে স্নিগ্ধ হেসে তিনি বলেন, ‘শহিদুল্লাহ ওকালতি তোমার জন্য নয়! বিশ্ববিদ্যালয়ে এস৷ আমি চাকরির ব্যবস্থা করব৷’ স্যার আশুতোষের প্রচেষ্টায় তাঁর চাকরি হয়েছিল৷ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ ড. দীনেশচন্দ্র সেন তাঁকে ‘শরৎকুমার লাহিড়ী গবেষণা’ সহায়ক নিযুক্ত করেন৷ ভাষা ও সাহিত্যের রূপ, রস, রহস্য তাঁকে আগ্রহী করে তোলে সারস্বত সাধনায়৷ ইতিপূর্বে কলেজে পড়াকালীনই ‘ভারতী’ পত্রিকায় ১৩১৩ সালের শ্রাবণ সংখ্যায় শহিদুল্লাহের লেখা নিবন্ধ ‘মদনভস্ম’ প্রকাশিত হয়৷

এ প্রসঙ্গ ‘ভারতী’র সম্পাদিকা স্বর্ণকুমারী দেবী লেখেন, ‘…ইনি সংস্কৃত সাহিত্যের অনন্তরে কতদূর প্রবেশ করিয়াছেন, এই প্রবন্ধ তাহার পরিচায়ক৷ … বর্তমান লেখকের আমাদের পুরাতন সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ দেখিয়া আমরা অতিশয় আনন্দলাভ করিয়াছি৷’ পরে শহিদুল্লাহের লেখা অনেক গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, রম্যরচনা— ‘কোহিনুর’, ‘প্রতিভা’, ‘আল-এসলাম’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়৷ তাঁর রচিত গ্রন্থাদির মধ্যে ‘বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত’, ‘The Buddist Mystic Songs’, ‘বাংলা ব্যাকরণ’, ‘শেষ নবীর সন্ধানে’, ‘ইকবাল’ ও ‘ওমর খৈয়াম’৷ তিনি বহু পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন৷ তাঁর সম্পাদিত উল্লেখযোগ্য পত্রিকার মধ্যে রয়েছে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’, ‘বিদ্যাপতি শতক’, ‘বঙ্গভূমি’, ‘Peace’ ইত্যাদি৷ প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রেও মহম্মদ শহিদুল্লাহ ছিলেন সিদ্ধহস্ত৷ প্রবন্ধ রচনায় তাঁর প্রেরণা ছিল বাংলার তিন কৃতী পুরুষ— আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, হরিনাথ দে ও দীনেশচন্দ্র সেন৷

ভাষা ও গবেষণায় মহম্মদ শহিদুল্লাহের অবদানও ছিল যথেষ্ট৷ বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’ (১ম খণ্ড)-এর সম্পাদক ছিলেন তিনি৷ বাংলা একাডেমির ইসলামী বিশ্বকোষ প্রকল্পের অস্থায়ী সম্পাদকও ছিলেন তিনি৷ এছাড়া বাংলা একাডেমির পঞ্জিকার তারিখ বিন্যাস কমিটির সভাপতি ও উর্দু অভিধান প্রকল্পের সম্পাদক ছিলেন তিনি৷ ১০৬৭ সালে ড. শহিদুল্লাহ প্রাচ্যের অন্যতম সেরা ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্য্যালয় থেকে প্রথম ‘এমিরেটাস’ অধ্যাপক পদ লাভ করেন৷ ফ্রান্স সরকারের দেওয়া সম্মানজনক পদক ‘নাইট অব দ্য অর্ডারস অব আর্টস অ্যান্ড লেটার্স’ও অর্জন করেন মহান এই ভাষাবিজ্ঞানী৷

‘মাতৃভূমি’ ও ‘মাতৃভাষা’র প্রতি আমৃতু্য শ্রদ্ধা জাগ্রত ছিল তাঁর অন্তরে৷ মাতৃভাষাকে সকলের ঊর্ধ্বে রেখে তিনি বলতেন, ‘আমি মনে করি শিক্ষার আদর্শ হচ্ছে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা, এতে হবে মনের পরিপুষ্টি, ধর্মীয় শিক্ষা, আত্মার পরিপুষ্টি ও সামরিক শিক্ষা৷ … আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি৷’

মহম্মদ শহিদুল্লাহের জীবন ছিল অত্যন্ত কর্মমুখর, বর্ণাঢ্য ও নানা ঘটনায় পরিপূর্ণ৷ জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ ও অনুশীলন, ভাষার প্রতি পাণ্ডিত্য ও পরিশ্রম, শিক্ষার প্রতি আগ্রহ ও মনোযোগ তাঁকে অসাধারণ ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল সমকালেই৷ বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই জ্ঞানতাপস জীবিতকালেই ছিলেন কিংবদন্তী৷ তিনি ‘চলন্ত বিশ্বকোষ’ নামে অভিহিত হয়েছিলেন৷

বহু ভাষাবিদ, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সাহিত্য-সাধক ড. মহম্মদ শহিদুল্লাহ ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে চলে যান ১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই৷ জ্ঞান, প্রজ্ঞা, অনুসন্ধিৎসা ও নিষ্ঠার এক বিস্ময়কর সমন্বয় ঘটেছিল তাঁর জীবনকালে৷