নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা, ১৩ জুলাই: গত মাসেই শেষ হয়েছে লোকসভা ভোট। সেই নির্বাচনে তৃণমূলের কাছে গোহারা হেরেছে বিজেপি। এক মাস যেতে না যেতেই এবার বিধানসভার চার আসনের উপনির্বাচনেও ধরাশায়ী হল গেরুয়া শিবির। মানিকতলায় ফের তৃণমূল জয়ী হওয়ার পাশাপাশি, বিজেপির পকেটে থাকা আরও তিনটি আসন কেড়ে নিল ঘাসফুল শিবির। বাগদা, রানাঘাট দক্ষিণ ও রায়গঞ্জে বিপুল ভোটে কার্যত ধরাশায়ী হল গেরুয়া শিবির।
গত ১০ জুলাই রাজ্যের এই চার আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ভোট শেষে চার আসনেই জয়ের ব্যাপারে তৃণমূল আত্মবিশ্বাসী থাকলেও রাজনৈতিক মহলে সেটা নিয়ে কিছুটা সংশয় তৈরি হয়। যদিও বিজেপি দাবি করে, তারা ফের তাদের জেতা আসন পুনরুদ্ধার করবে। এমনকি মানিকতলা আসনে জেতার ব্যাপারে আশা প্রকাশ করেছিল গেরুয়া শিবির। অথচ শনিবার ভোট গণনার শুরুতেই আভাস পাওয়া যায়, উপনির্বাচনের ফল তৃণমূলের অনুকূলে যাচ্ছে। মানিকতলাতে বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছে তৃণমূল। ওই আসনে রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী সাধন পান্ডের স্ত্রী সুপ্তি পাণ্ডেকে প্রার্থী করে চমক দিয়েছিলেন তৃণমূল সুপ্রিমো। আর সেই সিদ্ধান্তেই আস্থা রেখেছেন মানিকতলার মানুষ। ৬২ হাজার ৩১২ ভোটে জয়ী হয়েছেন তৃণমূল প্রার্থী।
যথারীতি রানাঘাট দক্ষিণে ৩৯ হাজার ৪৮ ভোটে জয়ী হন তৃণমূল প্রার্থী মুকুটমণি অধিকারী। যিনি আগে এই আসনে বিজেপির হয়ে জয় লাভ করেছিলেন। এবং পরে তৃণমূলে যোগদান করেন। লোকসভা ভোটে প্রার্থী হওয়ার জন্য তিনি এই আসনে বিজেপির বিধায়ক পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি ফের তৃণমূলে যোগদান করে প্রমাণ করে দিলেন, রানাঘাট দক্ষিণের মানুষ গেরুয়া পদ্ম প্রতীকের চেয়ে তাঁর এবং তৃণমূলের ওপরই বেশি ভরসা করেন।
একইভাবে ২০২১ সালে বাগদা কেন্দ্রে বিজেপির প্রতীকে জয়লাভ করেন বিশ্বজিৎ দাস। তিনি পরে তৃণমূলে যোগদান করেন এবং দলের জেলা সভাপতি হন। গত লোকসভা ভোটে বিজেপি সাংসদ শান্তনু ঠাকুরের বিরুদ্ধে তাঁকেই লোকসভার প্রার্থী করে তৃণমূলের হাই কম্যান্ড। সেসময় তিনি নিয়ম মেনে বিজেপি-র বিধায়ক পদে পদত্যাগ করেই তৃণমূলের প্রার্থী হন। কিন্তু লোকসভা ভোটে শান্তনু ঠাকুর ফের জয়লাভ করেন। বিশ্বজিৎ দাস পরাজিত হলেও তিনি কিন্তু উপনির্বাচনে ফের তৃণমূলের প্রতীকে প্রার্থী না হয়ে ঠাকুর পরিবারের কনিষ্ঠ এক সদস্য মধুপর্ণা ঠাকুরকে প্রার্থী করে ভোটে লড়েন। সেই নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয় ঘাসফুল শিবির। ৩৩,৪৫৫ ভোটে জয়ী হন রাজ্যসভার সদস্য মমতাবালা ঠাকুরের মেয়ে মধুপর্ণা ঠাকুর। গত ১৩ বছরে এই প্রথম বাগদা জয় করল তৃণমূল। পাশাপাশি, বর্তমানে রাজ্য বিধানসভায় তিনিই হতে চলেছেন সবচেয়ে কনিষ্ঠ বিধায়ক। শুধু তাই নয়, মধুপর্ণার এই জয়ের মাধ্যমে বাগদা তথা বনগাঁতে বিজেপি শিবিরে ধসের ইঙ্গিত স্পষ্ট। রাজনৈতিক মহলের ধারণা, বাগদাতে বিপুল ভোটে তৃণমূলের জয় প্রমাণ করে দিয়েছে, গত একমাসে মতুয়া ভোট ব্যাংকে বিজেপি শিবিরে ব্যাপকভাবে ধস নেমেছে।
এদিকে একই অবস্থা হল রায়গঞ্জ বিধানসভা আসনেও। এই কেন্দ্রের প্রার্থী কৃষ্ণকল্যাণী ৫০ হাজার ৭৭ ভোটে জয়ী হয়েছেন। তিনিও একসময় বিজেপি থেকে তৃণমূলে যোগদান করেন। ২০২১ সালে তিনি বিজেপির টিকিটে বিধায়ক পদে জয়লাভ করেন। এরপর ফের তিনি তৃণমূলে ফিরে যান। গত লোকসভা ভোটে এই কেন্দ্রে তিনি তৃণমূলের প্রার্থী হলেও বিজেপি প্রার্থী কার্তিক পালের কাছে পরাজিত হন। লোকসভা ভোটে প্রার্থী হওয়ার সময় তিনিও বিজেপি-র বিধায়ক পদে পদত্যাগ করেন। এবার সেই আসনের উপনির্বাচনে তৃণমূলের টিকিটে ফের জয়ী হলেন কৃষ্ণকল্যাণী। তবে তাঁর এই জয়ের মধ্যে বিজেপি শিবিরে বড় কোনও বিপর্যয়ের ইঙ্গিত পাচ্ছে রাজ্যের রাজনৈতিক মহল। এতদিন যে উত্তরবঙ্গকে গেরুয়া শিবিরের ঘাঁটি বলে ধরা হয়েছিল, সেই উত্তরবঙ্গেও এবার বিজেপি-র ভোট ব্যাংকে ভাঙনের ইঙ্গিত খুবই স্পষ্ট। রাজনৈতিক মহলের মতে, এই নির্বাচন বুঝিয়ে দিচ্ছে, উত্তরবঙ্গে ক্রমশ আলগা হচ্ছে বিজেপি-র পায়ের তলার মাটি। তবে শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, দেশেও বড় ধাক্কা খেয়েছে গেরুয়া শিবির। বাংলা বাদে বাকি ছয় রাজ্যে ৯টি বিধানসভা আসনের মধ্যে মাত্র দুটিতে জয়ী হয়েছে বিজেপি। বাকি আসনগুলিতে জয়ের নিরিখে এগিয়ে রয়েছে ইন্ডিয়া জোট।
সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী, ২০২৬ সালের প্রথম দিকেই সমাপ্ত হবে আগামী বিধানসভা নির্বাচন। সেই ২০২৪ ও ২০২৬-এর মাঝখানে রয়েছে আর মাত্র একটি বছর ২০২৫ সাল। তার আগেই অশনি সংকেত বিজেপি শিবিরের কাছে। রাজনৈতিক মহল মনে করছে, এই উপনির্বাচনের ফলাফল বলে দিচ্ছে, ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে গেরুয়া শিবিরের ফিরে আসা তো দূরের কথা, ২০২১ সালে জেতা আসনগুলি ধরে রাখাও যথেষ্ট কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।