কলকাতা, ২৯ জুন – প্রত্যেক ভারতীয়ের কাছে আদালত ন্যায় এবং বিচারের মন্দির। কিন্তু বিচারকদের দেবতা ভাবা ভুল এবং খুবই বিপদের। শনিবার কলকাতা হাই কোর্টের বার লাইব্রেরির দ্বিশতবর্ষ উপলক্ষে ন্যাশনাল জুডিশিয়াল অ্যাকাডেমির একটি আলোচনাসভায় এ কথা বলেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়। ডিওয়াই চন্দ্রচূড় বলেন, বিচারপতি এবং বিচারকের আসনে যাঁরা বসেন, তাঁদের নিজস্ব ভাবনাচিন্তা রয়েছে৷ আর এক্ষেত্রে মানুষ এবং বিচারপতি ও বিচারকদের একাংশ ‘ন্যায়ের দেবতা’ ভেবে ভুল করেন, বলে মন্তব্য করলেন দেশের প্রধান বিচারপতি ৷
প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় বলেছেন, ‘‘বিচারপতিদের অধিকাংশ সময়েই ‘লর্ডশিপ’, ‘অনার’ বা ‘লেডিশিপ’ বলে সম্বোধন করা হয়। কিন্তু মানুষ যদি বিচারালয়কে ন্যায়ের বা বিচারের মন্দির বলে বিশ্বাস করেন তা হলে খুবই বিপদ। আর আমরা বিচারপতিরা যদি নিজেদের সেই মন্দিরের দেবতা বলে ভাবতে শুরু করি তা হলেও ঘোর বিপদ।’’
শনিবার কলকাতার এক পাঁচতারা হোটেলে ন্যাশনাল জুডিশিয়াল অ্যাকাডেমির তরফে একটি সম্মেলনের আয়োজন করা হয় ৷ সেখানে উপস্থিত ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়, কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম এবং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ মঞ্চে বক্তব্য রাখতে উঠে মুখ্যমন্ত্রী বিচারব্যবস্থা যাতে রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট না হয়, সেই অনুরোধ জানান ৷ মূলত, তাঁর এই অনুরোধ ছিল প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের কাছে ৷
মমতার সেই মন্তব্যের প্রেক্ষিতেই এদিন বিচারব্যবস্থা নিয়ে মানুষের এবং বিচারপতি ও বিচারকদের একাংশের ভুল ধারণার প্রসঙ্গ তুলে ধরেন দেশের প্রধান বিচারপতি ৷ তিনি বলেন, “আদালতকে ন্যায় এবং বিচারের মন্দির বলে মনে করা হয় ৷ আর আমরা নিজেদের সেই মন্দিরের দেবতা ভেবে ভুল করি ৷ এটা খুবই বিপজ্জনক ৷ মনে রাখতে হবে আমাদেরও নিজস্ব চিন্তাভাবনা রয়েছে ৷ সেই চিন্তাভাবনার সঙ্গে বিচার প্রক্রিয়াকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না ৷”
তাঁর স্পষ্ট বার্তা, বিচারকের আসনে বসলে নিজস্ব চিন্তাভাবনাকে সরিয়ে রাখতে হবে ৷ প্রধান বিচারপতি বলেন, “বিচার করবেন ৷ কিন্তু, কারও সম্পর্কে আগাম ধারণা তৈরি করবেন না ৷ কারণ, আমাদের উলটোদিকে যাঁরা দাঁড়িয়ে থাকেন, তাঁরাও মানুষ ৷” দেশের প্রধান বিচারপতি জানান, “আমার সামনে আদালতকে কেউ মন্দির বলে উল্লেখ করলে, আমি তাঁকে বাধা দিই ৷ কারণ, মন্দির বললেই মনে হবে প্রত্যেক বিচারপতি এক-একজন দেবতা ৷ আসলে তাঁরা মানুষের সেবক ৷ ন্যায় বিচারের মাধ্যমে মানুষের সেবা করাই আমাদের কাজ ৷” সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, ‘‘বিচারক বা বিচারপতিরা যদি ভেবে নেন, তাঁরা মানুষের সেবা করছেন, তা হলে দেখবেন, বিচারকের ভাবমূর্তিতে দয়া, সহমর্মিতা, সহানুভূতির মতো ভাবনার প্রতিফলন হবে। এক মাত্র তা হলেই এক জন বিচারক বিচার করবেন কোনও পূর্ব ধারণার বশবর্তী না হয়ে।’’
বিচারপতি চন্দ্রচূড় বলেন, ‘‘সাংবিধানিক নৈতিকতার শিক্ষা হল , বৈচিত্রকে গ্রহণ করো এবং সহনশীল হও।বিচার করতে হবে সমাজকে নিয়ে সংবিধান মাথায় রেখে।’’
তথ্য প্রযুক্তির সাহায্যে দেশের বিচারব্যবস্থাকে আরও উন্নত করার জন্য এই আলোচনা সভার আয়োজন বলেও জানান প্রধান বিচারপতি।সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘‘তথ্যপ্রযুক্তি আমাদের সুযোগ দিয়েছে যাতে আমরা যে রায় দিই, তা অন্য ভাষায় অনুবাদ করার। আমরা ৫১ হাজারের বেশি রায় অন্য ভাষায় অনুবাদ করছি। বাংলা এবং ওড়িয়া-সহ সংবিধান যে ভাষাকেই স্বীকৃতি দেয়, সেই সব ভাষায় অনুবাদ করা হয় রায়। আমি বিশেষ করে বাংলা এবং ওড়িয়া ভাষার উল্লেখ করছি। আমার স্ত্রী ওড়িয়া ভাষা ভালবাসে। বাংলা ভাষাও খুব কাছের।’’