মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পর বিস্ফোরক পৌর প্রধান
আমিনুর রহমান, বর্ধমান, ২৮ জুন — মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফুটপাত বেদখল নিয়ে কড়া বার্তা দিয়েছেন। আর তারপরেই বর্ধমান শহরে জবরদখল হটাতে তৎপরতা তুঙ্গে। বৃহস্পতিবার মুখ্যমন্ত্রী ফের নতুন নির্দেশিকা জারি করেন। তিনি হকার উচ্ছেদ নিয়ে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার কথা বলেন। কিন্তু তারপরেই বিস্ফোরক মন্তব্য করলেন বর্ধমান পৌরসভার চেয়ারম্যান পরেশ চন্দ্র সরকার। সরাসরি তিনি বলেন, বাইরে থেকে লোক এনে টাকার বিনিময়ে ফুটপাত দখল হচ্ছে। কোথা থেকে এদের আনা হয়েছে জানি না । তবে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে দাদা আছে মামা আছে বলা হয়। আমাদের পিছনে কেউ নেই। এভাবেই চলছে। পুরসভার চেয়ারম্যান বেআইনি পুকুর ভরাট থেকে শুরু করে সরকারি জমি দখল, অবৈধ নির্মান এমনকি দামোদর নদে বালি চুরি নিয়ে সরব হন প্রকাশ্যে। বলেন, সবই চলছে রাজনৈতিক মদতে এবং টাকার বিনিময়ে। এমনকি দামোদর গর্ভে যেভাবে বালি তোলা হচ্ছে, তাতে জুজুটিতে তৈরি আম্রুত জল প্রকল্পের গ্যালারি যে কোনও সময় ভেঙ্গে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন চেয়ারম্যান। তবে এই সব দাদা, কাকা, মামারা কারা? সে ব্যাপারে খোলসা করে কিছু বলেননি। কিন্তু তাঁর এই বিস্ফোরক মন্তব্য ঘিরে শাসক দলের অন্দরে রীতিমতো জল্পনা শুরু হয়েছে। শহরের একটি অনুষ্ঠানে পৌরসভার চেয়ারম্যান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন। সেখানেই তিনি ক্ষোভ উগরে দেন।
দীর্ঘ সময় ধরে জেলা শহর বর্ধমানের রাস্তায় যানজট, বেআইনি দখলদারি নিয়ে দুর্ভোগে সাধারণ মানুষ। অভিযোগের পর অভিযোগ জমা পড়ে। পুলিশ, প্রশাসন পৌরসভার পক্ষ থেকে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়না বলেই অভিযোগ। এ নিয়ে ক্ষোভ তুঙ্গে। বিরোধীদের দাবি, জনগণের দুর্ভোগের জন্য এবারের লোকসভা ভোটে পৌরসভা এলাকায় ভরাডুবি হয়েছে শাসক দলের। এসব বিতর্কের মুখে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেন, কোনও রকম বেআইনি দখলদারি, সরকারি জমি বেদখল হতে দেওয়া যাবে না। আর মুখ্যমন্ত্রীর ওই ঘোষণা বর্ধমানবাসীর কাছে অক্সিজেন জুগিয়েছে। শহরের লোকজন আশাবাদী, এবার দীর্ঘ দুর্ভোগের অবসান হবে। তাই বর্ধমান পৌরসভার চেয়ারম্যানও কার্যত ঘোষণা করলেন, কোনও অনিয়ম আর বরদাস্ত করা হবে না। শুক্রবার সকাল থেকে শহরে পৌরসভার পক্ষ থেকে মাইকিং করে যাবতীয় বিষয়ে সতর্কতা করা শুরু হয়েছে।
বর্ধমান শহরের মুখ্য রাস্তা বিসি রোড, তেঁতুলতলা বাজার ও খোসবাগানে লাগামহীন জবরদখল রয়েছে। ফুটপাত বলে কোনও কিছু নেই বিসি রোডে। এখানেই শেষ নয়, শহর বর্ধমানের প্রাণকেন্দ্র এই বিসি রোডে যে সব ছোট-বড়ো দোকান রয়েছে, সে সব দোকানের সামনেই পসরা সাজিয়ে দখলদারি অবাক করার মতো ঘটনাও। এনিয়ে ব্যবসায়ী ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বার বার আপত্তি জানিয়ে আসছে। কোনও লাভ হয়নি। সবচেয়ে বেশি বেআইনি দখলদারি তেঁতুলতলা বাজার এলাকায়। রানীগঞ্জ বাজার মোড় থেকে পার্কাস রোড মোড় পর্যন্ত শহরের মুখ্য রাস্তা দখল করে আছেন দোকানদাররা। এখানে রাস্তার দু’পাশে যে সব দোকান রয়েছে সেগুলো দোকানের সামনের অংশে বাঁশের কাঠামো তৈরি করে রাস্তার প্রায় ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ দখল হয়ে আছে। তারপর আছে ফুটপাত জবরদখল। ফলে যাতায়াতের জন্য সামান্য একটু জায়গায় নিত্য দিনের যানজট লেগে থাকে। সবচেয়ে দুর্ভোগে পড়তে হয় স্টেশনে যাতায়াত করতে যাওয়া যাত্রীদের। এসব নিয়ে পৌরসভা, প্রশাসনের কাছে অভিযোগ ভুরি ভুরি। কিন্তু সাধারণের মতে কোনও হেলদোল নেই।
একই অবস্থা হাসপাতালে যাওয়ার জন্য খোসবাগনের রাস্তা। টোটো আর ফুটপাত দখল থাকায় রোগীদের নিয়ে যাতায়াত মাঝে মধ্যে থমকে যায়। এমনকি অ্যাম্বুলেন্সে মুমুর্ষ রোগীদের নিয়ে যাবার সময়ও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। পৌরসভার চেয়ারম্যান এই যাবতীয় অভিযোগ কার্যত স্বীকার করে নেন। বেশ কয়েক মাস আগে শহরের যানজট নিরসনে প্রশাসন পুলিশ পৌরসভার পক্ষ থেকে নানা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। সে কথাও বলেছেন। জেলাশাসক, পুলিশ সুপার, বিধায়ক থেকে শুরু করে প্রশাসনের সমস্ত কর্তারা রাস্তায় নেমে দখলদার হটিয়েছিলেন। মাত্র একমাসের মধ্যে সব কিছু অনিয়ম আগের মতো হয়ে যায় বলে অভিযোগ। শুধু তাই নয়, তার পর থেকে বীরহাটা, বাবুর বাগ, নার্স কোয়াটার জেলখানা মোড়, উত্তর ফটক সহ একাধিক এলাকায় সমস্ত সরকারি জায়গা দখল করে দোকানপাট গড়ে তোলা হয়েছে। একথাও বলেন খোদ চেয়ারম্যান। বলেন, টাকার বিনিময়ে ফুটপাত দখল করতে ছাড়পত্র মিলেছে। উচ্ছেদ করতে গেলে দাদা, কাকা, মামা দেখিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তবে সব জায়গাতেই স্থানীয়দের অভিযোগ কাউন্সিলরদের মদতে ওই দখলদারি ঘটেছে। এমনকি টাকা পয়সা নিয়ে অনুমতি দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ। দিন প্রতি টাকা আদায় হয় বলে শাসকদলের অন্দরেই অভিযোগ উঠেছে। পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয় না বলে ক্ষোভ তুঙ্গে।
এদিকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেদিন উচ্ছেদ অভিযানের ঘোষণা করেন, ঠিক তার পরের দিন থেকেই শহরে ওই সব অনিয়মের বিরুদ্ধে কিছুটা হলেও তৎপরতা শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে বর্ধমান স্টেশন লাগোয়া অঞ্চলে দখলদারদের উঠে যেতে বলা হয়েছে। তবে তেঁতুলতলা বাজার, বিসি রোডের একাংশে অবাধ দখলদারি কবে হটানো হবে, সে বিষয়ে কোনও কিছু ঘোষণা হয়নি। এর মধ্যে অবশ্য পৌরসভার চেয়ারম্যান পরেশ চন্দ্র সরকার পুরসদস্য ও সমস্ত বিভাগের প্রধানদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করেন। পরে চেয়ারম্যান জানান, সমস্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। যেখানে যা সমস্যা আছে, সবকিছু ব্যবস্থা নেওয়া হবে।