স্বপনকুমার মণ্ডল: বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা সাহিত্যের উন্নতির জন্য শুধুমাত্র নব্য লেখকদের প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ করেননি, সেই সঙ্গে বাঙালির মনস্কতায় বাংলা সাহিত্যের প্রতি অহেতুক অশ্রদ্ধেয় ধারণার প্রতিও কুঠারাঘাত করতে দ্বিধা করেননি। অর্থাৎ স্বদেশপ্রীতিজাত স্বদেশানুরাগের ভিতেই তাঁর উন্নয়নবোধ শুধুমাত্র লেখকদের অস্বাস্থ্যের প্রতিই নয়, তার পাশাপাশি পাঠকদের মানসিক কুস্বাস্থ্যের নীরোগ সাধনের প্রতিও সজাগ ছিল। তার উজ্জ্বল নিদর্শন ‘লোকরহস্য’-এর দ্বিতীয় সংস্করণের (১৮৮৮) ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের আদর’ সরস ব্যঙ্গাত্মক রচনাটি। শ্রদ্ধার ভিতে উন্নতির সোপান প্রস্তুতের কথা বঙ্কিমচন্দ্র ‘বঙ্গদর্শন’-এর সূচনাতেই স্পষ্ট করে তুলেছিলেন। সেদিক থেকে বাংলা সাহিত্যের উন্নয়নে তাঁর সদর্থক প্রয়াস নানাভাবে বিকশিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, সম্পাদনাসূত্রে প্রাপ্ত তাঁর নানারৈখিক প্রতিকূল অভিজ্ঞতা তাঁকে আরও পরিণতি প্রদান করেছে। সেক্ষেত্রে আদর্শ সাহিত্যিকের দৃষ্টান্ত স্বকীয় প্রতিভায় বিকশিত করে তিনি সাহিত্যসম্রাটের আসনে সমাসীন হয়ে বাঙালিমানসে শ্রদ্ধা অর্জন করলেও নতুন লেখকদের প্রেরণার আধার না হয়ে ব্যতিক্রমীতে স্বতন্ত্রতার দূরত্ব বাড়িয়েছেন মাত্র। অন্যদিকে বঙ্কিমচন্দ্রের সেই প্রখর ব্যক্তিত্বময়ী সাহিত্যিক প্রতিভার সঙ্গে তাঁর সব্যসাচী সম্পাদকীয় অভিভাবকত্ব বাঙালিমানসে সশ্রদ্ধ বিস্ময়ের উদ্রেক করেছে ঠিকই, কিন্তু তাতে নব্য লেখকদের দিশারির অভাববোধ তখনও সক্রিয় ছিল। এজন্য ‘বঙ্গদর্শন’-এর বৃহৎ দৃষ্টান্ত যে নবা লেখকদের অন্তঃপুরে প্রবেশের পক্ষে সহজসাধ্য নয়, সে বিষয়টিও বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর স্বকীয় প্রতিভায় উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন। সেদিক থেকে ‘প্রচার’-এর মতো ছোট মাপের পত্রিকার প্রয়োজনবোধ বন্ধিমমানসে নিবিড় হয়ে উঠেছিল। ‘প্রচার’-এর ‘সূচনা’য় (শ্রাবণ ১২৯১) সেকথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে : ‘… পৃথিবীতে হিমালয়ও আছে, বল্মীকও আছে। সমুদ্রে জাহাজও আছে, ডিঙ্গীও আছে। তবে ডিঙ্গীর এই গুণ, জাহাজ সব স্থানে চলে না, ডিঙ্গী সব স্থানে চলে। যেখানে জাহাজ চলে না, আমরা সেইখানে ডিঙ্গী চালাইব। চড়ায় ঠেকিয়া বঙ্গদর্শন-জাহাজ বানচাল হইয়া গেল প্রচার ডিঙ্গী, এক হাঁটু জলেও নির্বিঘ্নে ভাসিয়া যাইবে ভরসা।’ এজন্য ‘সত্য, ধৰ্ম্ম এবং আনন্দের প্রচারের জন্যই’ ‘সুলভ পত্র’ ‘প্রচার’-এর আবির্ভাব ঘটেছে। শুধু তাই নয়, তার অব্যবহিত অনুচ্ছেদেই ‘প্রচার’-এর উদ্দেশ্যটিও অপ্রচার থাকেনি : ‘যখন সর্বসাধারণের জন্য আমরা পত্র প্রচার করিতেছি, তখন অবশ্য ইহা আমাদিগের উদ্দেশ্য যে, প্রচারের প্রবন্ধগুলি সর্ব্বসাধারণের বোধগম্য হয়। আমাদিগের পূর্ব্ববর্ত্তী সম্পাদকেরা এ বিষয়ে কতদূর মনোযোগী হইয়াছিলেন, তাহা বলিতে পারি না — আমাদের এ বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ থাকিবে ইহা বলিতে পারি। কাজটি কঠিন, কৃতকার্য্য হইতে পারিব, এমন ভরসা অতি অল্প। তবে সাধারণ পাঠ্য বলিয়া আমরা বালকপাঠ্য প্রবন্ধ ইহাতে সন্নিবেশিত করিব না। ভরসা করি, প্রচারে যাহা প্রকাশিত হইবে, তাহা অপণ্ডিত ও পণ্ডিত উভয়েরই আলোচনীয় হইবে।’ অর্থাৎ লেখাটা আগে লেখা হয়ে উঠতে হবে, তারপরে তার প্রকাশের ছাড়পত্র মিলবে। এজন্য যথার্থ লেখার প্রয়োজনে লেখকের সার্থকতার দায় আপনাতেই নিবিড় হয়ে ওঠে। আর সেক্ষেত্রেই ‘প্রচার’-এর আলোতে বঙ্কিমী পাচনবাড়ি ‘নিবেদন’র মাধ্যমে সবেদন আবেদনে প্রকট মনে হয়। অবশ্য এজন্য তার স্বরূপটি একবার ফিরে দেখা প্রয়োজন।
ব্যাখ্যার চেয়ে উদাহরণের সহজ পথ যখন রুদ্ধ হয়ে পড়ে, তখন ব্যাখ্যার চেয়ে স্পষ্টতা অনিবার্য মনে হয়। সেদিক থেকে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর সাহিত্যকীর্তির মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের উন্নতি প্রদর্শনে বহু লেখকদের আদর্শে ব্যতিক্রমী হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে তাতে “কেমন হওয়া উচিত’-এর পরিবর্তে ‘কেমন করে হওয়া উচিত’-এর বিষয়টি আবেদনক্ষম হয়ে উঠেছে। সেক্ষেত্রে ‘কেন লিখব’ তার যেমন স্বচ্ছ ধারণার প্রয়োজন, তেমনই ‘কী লিখব’ এবং ‘কীভাবে লিখব’ বিষয়-দুটির সম্যক গতিপথ আপনাতেই সক্রিয় হয়ে ওঠে। মূলত এই তিনটি বিষয়ের অবতারণা করে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’-এ (‘প্রচার’-এর ১২৯১-এর মাঘ সংখ্যা) বারোটি ‘নিয়ম’ উপস্থাপিত করেছেন। তাঁর লক্ষ্যও শেষে স্পষ্ট করে তুলেছেন: ‘বাঙ্গালা সাহিত্য বাঙ্গলার ভরসা। এই নিয়মগুলি বাঙ্গালা লেখকদিগের দ্বারা রক্ষিত হইলে, বাঙ্গালা সাহিত্যের উন্নতি বেগে হইতে থাকিবে।’ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যে-সব নিয়মের কথা বঙ্কিমচন্দ্র পূর্বেই নানাভাবে বলার চেষ্টা করেছেন, তা এখানে সুসংহত ও সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন। আপাতভাবে মনে হতে পারে এসব কথা প্রথম থেকে ‘নিবেদন’ করা হলে আখেরে আরও বেশি লাভ হ’ত। কিন্তু উপদেশ দেওয়ার জন্য উপদেশকের যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। সেদিক থেকে প্রখর আত্মসচেতন ব্যক্তি হিসাবে বঙ্কিমচন্দ্র স্বকীয় প্রতিভায় সে যোগ্যতায় সফলকাম হয়েই সেই ‘নিবেদন’-এ সামিল হয়েছেন। এজন্য স্বদৃষ্টান্তে উপদেশেকের যোগ্যতায় তার অবিসংবাদী ব্যক্তিত্বের আধারে নিবেদনটি বাঙালি লেখকদের পাথেয় হয়ে উঠেছে। একজন লেখকের পক্ষে যে বিষয়গুলি মেনে চলা আবশ্যক, সে-বিষয়গুলিকে বঙ্কিমচন্দ্র সূত্রাকারে লিপিবদ্ধ করেছেন। প্রথমদিকে হবু লেখকদের লেখার উদ্দেশ্যটি স্বচ্ছ হয়ে ওঠে না। সেখানে ‘কেন লিখব’ এবং ‘কী লিখব’র বিষয় দুটি বঙ্কিমচন্দ্র প্রথম চারটি নিয়মে জানিয়েছেন। প্রথম দুটি নিয়মে ‘যশ’ ও ‘টাকা’র জন্য লেখার প্রতি তাঁর দ্বিধাবোধ স্পষ্ট। দুটোই লেখার ভালো গুণকে ব্যাহত করে। আর ‘লেখা ভালো হলে যশ আপনি আসিবে।’ সেই সঙ্গে টাকার জন্য লিখতে গিয়ে লোকরঞ্জনের দায়ে ‘রচনা বিকৃতি ও অনিষ্টকর হইয়া ওঠে’। লক্ষণীয়, বঙ্কিমচন্দ্র টাকার জন্য লেখায় যে অনীহা বাক্ত করেছেন, তার মধ্যে তাঁর সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গিই প্রকাশিত হয়েছে।
তখনও আমাদের দেশে লেখা ও টাকার সম্পর্ক নিবিড় হয়ে ওঠেনি। অন্যদিকে পাশ্চাত্যে তখন তার প্রচলন সুবিদিত। শুধু তাই নয়, সেই ধারা সেখানে প্রকট হয়ে উঠেছে এবং বঙ্কিমচন্দ্রের কথায় তার সাফল্যও মিলেছে। সেদিক থেকে বাংলায় লিখে টাকা পাওয়ার বিষয়টি প্রচলিত হয়েছে তার অনেক পরে। শুধু তাই নয়, পরবর্তীতে বিশ শতকেই বুদ্ধদেব বসুর মতো সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব লেখায় পেশাদারি দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন নিয়ে সওয়াল করেছেন। আবার শিবরাম চক্রবর্তীর মতো রসসাহিত্যিক অকপটে টাকার জন্যই লেখার কথা জানিয়েছেন। অন্যদিকে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে সুভাষ মুখোপাধ্যায় বা সমরেশ বসুর মতো অনেকেই লেখাকেই পেশা করে নিয়েছেন। কিন্তু তাতে বঙ্কিমচন্দ্রের কথা অন্যথা হয়ে যায় না। তিনি বাংলা সাহিত্যের উন্নতির সোপানে অর্থের বিনিময়ে অনর্থের বিরুদ্ধে হবু লেখককে সচেতন করে দিয়েছেন। কেননা লেখাতে তখনও সাধনার স্তরে দেখার প্রতি দায়বদ্ধ থাকার কথাই তাঁর মনে হয়েছিল। তাঁর কথায়, ‘কিন্তু আমাদের এখনও সে দিন হয় নাই।’ অর্থাৎ সময়ই সেই সম্পর্কের নিবিড়তা বলে দেবে এমনই মনোভাব তিনি ব্যক্ত করতে চেয়েছিলেন। সেক্ষেত্রে হবু লেখকের প্রথম থেকেই অর্থপ্রাপ্তিযোগের সম্ভাবনায় লেখনীধারণে ‘লোক-রঞ্জন’-এর সৃষ্টি আপনাতেই বিপথগামী হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে ওঠে। এজন্য অনেক কবি-সাহিত্যিকই সাহিত্যসাধনায় অর্থের যোগের চেয়ে বিয়োগের কথায় আশ্বস্তবোধ করেছেন। একালের স্বনামধন্য কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত তাঁর একটি সাক্ষাৎকারে (‘বইয়ের দেশ’, জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১৩) সেকথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন : ‘… ডব্লিউ এইচ অডেনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, প্রবন্ধ কেন লেখেন? উত্তর দিয়েছিলেন, টাকার জন্য। আমার কিন্তু কখনও সেরকম মনে হয়নি।’
অন্যদিকে টাকার দিকে দৃষ্টি দিতে গিয়ে লেখায় স্বাভাবিকতা ব্যাহত হয়ে কৃত্রিমতার আগমন সহজসাধ্য হয়ে ওঠে। সেদিক থেকে বঙ্কিমচন্দ্রের চেতাবনি শুধু সাময়িকই নয়, তার চিরন্তন দাবিকেও অস্বীকার করা যায় না। প্রসঙ্গত স্মরণীয়, বঙ্কিমচন্দ্র সাহিত্যকে শুধুমাত্র জ্ঞানচর্চার মাধ্যম করে তুলতে চাননি, সেই সঙ্গে লোকরঞ্জনও চেয়েছেন। ‘বঙ্গদর্শন’-এর সূচনা থেকেই তার পরিচয় বর্তমান। তাই বলে সাহিত্যকে তিনি শুধুমাত্র লোকরঞ্জন সর্বস্ব করে তোলেননি বা চানওনি। সেক্ষেত্রে টাকার জন্য লেখায় লোকরঞ্জনের আধিক্য স্বাভাবিক মনে হওয়ায় সে পথে তাঁর ছাড়পত্র না মেলাটাই স্বাভাবিক। এজন্য তৃতীয় নিয়মে তাঁর স্পষ্ট উচ্চারণ যা সাধারণ্যে আপ্তবাক্যের মর্যাদায় সমাদৃত হয়েছে তা আমাদের সচকিত করে তোলে, ‘যদি মনে এমন বুঝিতে পারেন, লিখিয়া দেশের বা মনুষ্যজাতির কিছু মঙ্গল সাধন করিতে পারেন, অথবা সৌন্দর্য্য সৃষ্টি করিতে পারেন, তবে অবশ্য লিখিবেন।’ অবশ্য এতে বঙ্কিমচন্দ্র কোনো নতুন কথা বলেননি। কিন্তু তিনি নতুন ভাবে বলেছেন। পাশ্চাত্য শিল্প-সাহিত্যেই শুধু নয়, প্রাচ্যেও এরূপ মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র সেকথাই সুদৃঢ় করে তুলেছেন।