পাটনা, ২০ জুন – ‘নিট’ পরীক্ষায় দুর্নীতির জাল কতদূর বিস্তৃত ? গোলকধাঁধা এই প্রশ্ন নিয়ে তোলপাড় দেশ। কারণ ‘নিট’ প্রশ্নপত্র নিয়ে প্রতিদিনই উঠে আসছে নতুন চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। জানা গেছে, পরীক্ষার আগের দিনই ফাঁস হয়ে যায় নিট পরীক্ষার প্রশ্নপত্র। ৩০ থেকে ৩২ লক্ষ টাকার বিনিময়ে নিট পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করা হয়েছিল। পুলিশের দাবি, অভিযুক্ত অমিত আনন্দ নিজেই এই স্বীকারোক্তি দিয়েছে। এদিকে সর্বভারতীয় প্রবেশিকার প্রশ্নপত্র ফাঁস কাণ্ডে জড়িত পড়েছে আরজেডি প্রধান তেজস্বী যাদবের সহকারীর নামও ।
ডাক্তারি পরীক্ষার প্রবেশিকা পরীক্ষা নিট নিয়ে দুর্নীতির মারাত্মক অভিযোগ উঠছে। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস থেকে শুরু করে মেধাতালিকায় জালিয়াতির অভিযোগ ভুরি ভুরি। গত সপ্তাহেই পুলিশ বিহার থেকে নিট দুর্নীতিতে অভিযুক্ত ১৩ জনকে গ্রেফতার করে।
পুলিশ সূত্রে খবর, নিট দুর্নীতির মাস্টারমাইন্ড অমিত আনন্দ। পুলিশি জেরায় অমিত স্বীকার করে নিয়েছে যে পরীক্ষার আগের দিনই প্রশ্নপত্র ফাঁস করা হয়েছিল। জেরায় অমিত জানিয়েছে, পড়ুয়াদের কাছ থেকে মাথাপিছু ৩০ থেকে ৩২ লক্ষ টাকা করে নেওয়া হয়েছিল। ওই অর্থের বিনিময়ে শুধু প্রশ্নপত্র ফাঁসই নয়, পরীক্ষার্থীরা মাত্র একটি রাত হাতে পায় তাদের হাতে পৌঁছে যাওয়া প্রশ্নাবলীর উত্তর তৈরী করার।
পুলিশ অমিতের ফ্ল্যাটে তল্লাশি চালিয়ে যে সমস্ত পোড়া কাগজ পেয়েছিল, তা নিটেরই প্রশ্ন ও উত্তরপত্রের কপি। অমিত স্বীকার করে নিয়েছেন যে এর আগেও একাধিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছে সে। পাটনার এজি কলোনীর যে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে অমিত থাকত, সেখানেই ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করার জন্য পড়ুয়াদের আসতে বলা হত । পড়ুয়াদের মাথা পিছু লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে এই প্রশ্নপত্র বিলি করা হত।
এদিকে সর্বভারতীয় প্রবেশিকার দুর্নীতি কাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে আরজেডি প্রধান তেজস্বী যাদবের সহকারীর নাম । বৃহস্পতিবার এই দাবি করেন বিহারের উপমুখ্যমন্ত্রী বিজয়কুমার সিন্হা। তাঁর দাবি, দুর্নীতিতে ধৃত ছাত্রের জন্য সরকারি বাংলোয় থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন তেজস্বীর সহকারী। যদিও সেই বাংলোর অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এনএইচএআই জানিয়েছে, পাটনায় তাদের কোনও বাংলোই নেই।
বৃহস্পতিবার সাংবাদিক বৈঠক করে বিজয় জানিয়েছেন, লালুপ্রসাদ যাদবের পুত্র তেজস্বীর সহযোগী প্রীতম কুমার বিহার সড়ক নির্মাণ বিভাগ -এর এক কর্মীকে ফোন করেন। তাঁকে ফোন করে সিকন্দরপ্রসাদ যাদবেন্দুর জন্য একটি ঘর বুক করতে বলেন। সিকন্দর পেশায় এক জন ইঞ্জিনিয়ার। এই সিকন্দর অতীতে দাবি করেছিলেন, নিট দুর্নীতিতে জড়িত রয়েছেন এক জন ‘মন্ত্রী’। সিকন্দর জানিয়েছেন, নিজের এক ভাইপোর জন্য পাটনার সরকারি বাংলোয় ঘর বুক করেছিলেন। সেই ভাইপোর নাম অনুরাগ যাদব। তিনি ছিলেন নিট পরীক্ষার্থী। অনুরাগ, তাঁর মা এবং কয়েক জন ছিলেন বাংলোয়। নিট পরীক্ষায় অনিয়মের অভিযোগে এই অনুরাগ এখন জেলে। অনুরাগ যাদব জানান, কোটায় তিনি ‘নিট’ পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ওই ছাত্রের কথায়, ” আমাকে নিট প্রশ্নপত্রের উত্তর মুখস্থ করতে বলা হয়। পরীক্ষাতেও একই প্রশ্ন এসেছিল।”
‘নিট’ নিয়ে এই দুর্নীতির আবহে বাতিল হয়ে যেতে পারে নিট-এর গোটা মেধা তালিকাই। নাম বাদ পড়তে পারে র্যাঙ্ক করা ছাত্র-ছাত্রীদের। গ্রেস মার্কস বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরই মেধাতালিকায় এই বড় অদল-বদল হতে পারে বলে জানা গেছে। নিট নিয়ে দুর্নীতির মামলায় সুপ্রিম কোর্টে এনটিএ জানিয়েছে, গ্রেসমার্কস পাওয়া ১৫৬৩ জন পড়ুয়ার স্কোরবোর্ড বাতিল করে দেওয়া হচ্ছে। তাদের পুনরায় পরীক্ষা নেওয়া হবে। ২৩ জুন ফের পরীক্ষা হবে। ৩০ জুন ফল প্রকাশ হবে।
প্রসঙ্গত, গত ৪ জুন ফলপ্রকাশ হয় নিট পরীক্ষার। মেধা তালিকায় প্রথম স্থানে ৬৭ জন পড়ুয়ার নাম রয়েছে তাতে। এরপরই দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। মেধাতালিকায় থাকা বাকি পড়ুয়াদেরও যে গ্রেস মার্কস দেওয়া হয়েছিল, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়। দেশজুড়ে নিট পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু হয়। মামলা গড়ায় সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত। চাপে পড়ে এনটিএ-র তরফে গ্রেস মার্কস প্রাপ্ত ১৫৬৩ জনের মার্কশিট বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে সুপ্রিম কোর্টের তরফে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, কোনওভাবেই নিট-র কাউন্সেলিং বাতিল করা যাবে না। সিবিআই তদন্তের আর্জিও খারিজ করে দেওয়া হয়েছে। আগামী ৬ জুলাই নিট-র কাউন্সেলিং।
পড়ুয়াদের দাবি, ফের নতুন করে ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি কাম এন্ট্রান্স টেস্ট-আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পরীক্ষা নিতে হবে। যে পরীক্ষায় ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগে আগামী ৮ জুলাই সামগ্রিকভাবে শুনানি হবে। তবে ইতিমধ্যেই সূত্রে জানা গেছে, আদালত নির্দেশ দিলে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রক নতুন করে নিট পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে আপত্তি জানাবে না। সরকারি একটি সূত্র জানিয়েছে, শিক্ষামন্ত্রক নিট পরীক্ষা আবার নেওয়ার ব্যাপারে রাজি আছে।
পরীক্ষা বাতিল সহ বেশ কয়েকটি আবেদন সুপ্রিম কোর্টে জমা পড়ে। সর্বোচ্চ আদালতের বেঞ্চ সেই সমস্ত মামলাকে এক করে ৮ জুলাই শুনানির জন্য নির্ধারিত করেছে। সেই সঙ্গে রাজস্থান,কলকাতা ও বম্বে হাইকোর্টে জমা পড়া আবেদনের শুনানিতে স্থগিতাদেশ দিয়ে, সেগুলিকেও শীর্ষ আদালতে নিয়ে আসার এনটিএ-র আবেদনে সিলমোহর দিয়েছে।
এদিকে বুধবার রাতে বিবৃতি জারি করে বাতিল করা হয়েছে এই বছরের ইউজিসি-নেট পরীক্ষা। পরীক্ষা হয়েছিল ১৮ জুন। একদিন পরেই তা বাতিল করে কেন্দ্রীয় সরকার। যদিও শিক্ষামন্ত্রকের তরফে জান্যানো হয়েছে, কারও কোনও অভিযোগের কারণে ২০২৪-এর ইউজিসি-নেট পরীক্ষা বাতিল হয়নি। পরীক্ষার্থীদের কথা মাথায় রেখে শিক্ষামন্ত্রক স্বতঃপ্রণোদিত পদক্ষেপ করেছে।