শৈলজারঞ্জন মজুমদার : রবীন্দ্রসঙ্গীতে আত্মনিবেদিত নীরব সাধক
স্বপনকুমার মণ্ডল
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু ইতিহাস সৃষ্টি করেননি, ইতিহাসের ধারক-বাহক হিসাবেও তাঁর অবিসংবাদিত ভূমিকা বর্তমান । সেই ইতিহাসের আধারে তাঁর সান্নিধ্যলাভে যাঁরা ধন্য হয়েছেন, তাঁরাও তাতে স্বনামধন্য হওয়ার অবকাশ পেয়েছেন । শুধু তাই নয়, তাঁর সান্নিধ্যের পরশে তাঁরই সৌরভ বিস্তারে ব্রতী হয়ে আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন অনেকেই । তাঁদের পরিচয়ের আধারই রবীন্দ্রনাথের পরশ । সেই পরশে স্বাভাবিক ভাবেই রবীন্দ্রনাথ পরশমণি । তাঁর ছোঁয়ায় জীবনধন্য করার মানসে যাঁরা নিজেকে সঁপে দিয়েছেন, বা আজীবন ব্রত উদযাপনে সক্রিয় থেকেছেন, তাঁরা সকলে স্বকীয় বৃত্তে পরিচিতি পেলেও জনসমাদরে জনপ্রিয়তা লাভে তাঁদের মধ্যে তারতম্য অনিবার্য হয়ে ওঠে । সেখানে প্রখ্যাত হওয়ার অবকাশ যাও-বা সক্রিয় হয়ে ওঠে, বিখ্যাত হওয়ার পরিসর আপনাতেই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়ে । অথচ মুখ থেকে প্রমুখ হওয়ার হাতছানি তার অনায়াসে সক্রিয় হয়ে ওঠে । গুরুভক্তির পরাকাষ্ঠায় গুরুর মহিমায় আপনাকে সামিল করার আত্মগৌরবে সেই হাতছানি আপনাতেই প্রকাশমুখর । সেদিক থেকে রবীন্দ্রনাথের পরশধন্য হওয়ার গৌরববোধে তাঁর মাহাত্ম্যের প্রচারে বা প্রসারে প্রমুখের ভূমিকা আপনাতেই জনমানসে আবেদনক্ষম হয়ে ওঠার হাতছানিকে সক্রিয় করে তোলে । অথচ জনমানসের সেই আলোতেও যিনি রবীন্দ্রনাথের সংযমের আদর্শকে পাথেয় করে নীরবে তাঁর সঙ্গীতসুধাকে আপন করে যাপন করে দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার ব্রতে আজীবন সনিষ্ঠ ছিলেন, তিনি বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীতজ্ঞ, রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিক্ষক ও স্বরলিপিকার শৈলজারঞ্জন মজুমদার (১৯০০-১৯৯২) । তাঁর আত্মনিবেদিত প্রকৃতিই তাঁর নীরব সাধনাকে সবুজ ও সজীব করে তুলেছে ।
শৈলজারঞ্জন বারবার তাঁর সঙ্গীতঅন্তপ্রাণের কথা নানাভাবে তুলে ধরেছেন । বাংলাদেশের নেত্রকোনার বাহাম গ্রামে তাঁর জন্মস্থানে তিনি বেড়ে ওঠেন । ।ছোটবেলাতেই ঠাকুমার কাছে বৈষ্ণবীয় গানে প্রাণ খুঁজে পেতেন । এছাড়া কীর্তন, বাউল, ভাটিয়ালি প্রভৃতি লোকসঙ্গীতও শিখেছিলেন তিনি । অথচ তা তাঁর শিক্ষাজীবনে আনুকূল্য লাভ না করাই দস্তুর । পড়াশোনাতে ভালো হওয়ায় গানের যোগ্ আপনাতেই বিয়োগ হয়ে ওঠে । অথচ তারপরেও তাঁর গানের প্রতি টান কমেনি, বরং প্রতিকূলতায় আরও তীব্র হয়েছে । সেখানে পড়াশোনার চেয়ে গানেই শৈলজারঞ্জন প্রাণ ফিরে পেতেন । অন্যদিকে ইতিমধ্যে শান্তিনিকেতনে পাঠরত খুড়তুতো কাকাদের কাছে থেকে সেখানকার আশ্রমিক জীবন ও রবীন্দ্রনাথের গানের কথা তাঁকে স্বপ্নলোকের হাতছানি দেয় । এজন্য নেত্রকোনা দত্ত হাইস্কুল থেকে যখন তাঁর উচ্চশিক্ষায় দুটি বিকল্প স্কুলের একটি শান্তিনিকেতনের কথা উঠে আসে, তিনি কায়মনোবাক্যে তার জন্য প্রতীক্ষা করেন । এদিকে তাঁর বাবা রমণীকিশোর দত্ত মজুমদার যেমন রবীন্দ্রবিরোধী ছিলেন, তেমনই তিনি চেয়েছিলেন ছেলে তাঁর মতো করেই মানুষ হবে । সেখানে শৈলজারঞ্জনের ইচ্ছে-অনিচ্ছার মূল্য ছিল না । এজন্য কলকাতায় স্কটিশ চার্চ থেকে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বরাবরই কৃতিত্বের পরিচয়েও রমণীকিশোরের মন ভরেনি । এম.এসসি-তে রসায়নে দ্বিতীয় বিভাগে প্রথম(১৯২৪) হয়ে যে ছেলেটি গবেষণায় সামিল হয়েছিল, তাঁকেও বাবার কথামতো ওকালতি পাশ করে(১৯২৭) নেত্রকোনায় তাঁরই আসনে সমাসীন হতে হয়েছে । অবশ্য তার পূর্বে কলকাতার আশুতোষ কলেজে কিছুদিন লেকচারার হিসেবে কাজের কথা জানা যায় । অন্যদিকে অনিচ্ছায় ওকালতির কাজ বেশিদূর এগোয়নি । মাসতিনেকের মধ্যেই তা থেকে শুধু রেহাই পাননি, পেয়েছিলেন সব পেয়েছির দেশ । সে দেশের সাকিনঠিকানার হদিশ যে কলকাতায় গিয়েই প্রাণস্হ করেছিলেন । সেখানে কলেজে পড়তে গিয়ে সেই কাকাদের কাছে পেলেন, পেলেন জোড়াসাঁকোর হদিশ । আর ১৯২১-এ জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে বর্ষামঙ্গল অনুষ্ঠানে পেলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের পরশ, তাঁর স্বকণ্ঠে গান ও আবৃত্তি শোনার সৌভাগ্য । সেই থেকে রবীন্দ্রনাথের গান শৈলজারঞ্জনকে সঞ্জীবনী সুধায় আপন করে নেয় । দিল্লি আকাশবাণীর জন্য ‘উত্তরসূরি’র সম্পাদক অরুণ ভট্টাচার্যের নেওয়া সাক্ষাত্কারে শৈলজারঞ্জন জানিয়েছেন : ‘তারপর থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত একেবারে আমাকে জাপটে ধরেছে ।রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া কোন গানই আমার মনে দাগ কাটেনি ।’ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শ্রদ্ধাভক্তির পরাকাষ্ঠায় শৈলজারঞ্জন নেত্রকোনায় ফিরে গিয়ে প্রথম রবীন্দ্রনাথের গান শোনানোর আয়োজন থেকে তাঁর জয়ন্তী পালনে সামিল হয়েছিলেন । তারপর অদম্য আগ্রহে গানশেখার পালা । দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান শোনা থেকে সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দলে ভেড়া সবেতেই তাঁর ঐকান্তিক আগ্রহ আন্তরিক করে তুলেছিল । সৌমেন্দ্রনাথের দলে থাকার সময় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কাছে তিনটি গান শেখার সুযোগ পেয়েছিলেন । সেই গান দিয়েই শৈলজারঞ্জন রবীন্দ্রনাথের মনে ঠাঁই পেতে চেয়েছিলেন এবং তা শুধু পাননি, পেয়েছিলেন কল্পনাতীত । অথচ তারপরেও তিনি রবীন্দ্রনাথের গানের ভেলায় প্রত্যাশিত জনপ্রিয়তা থেকে স্বেচ্ছায় সংগোপনে থেকেছেন । সেখানে নৈঃশব্দের আভিজাত্য তাঁকে অনন্য করে তুলেছে । তিনি যেন গানের ভাষাতেই কথা বলেছেন, জনকণ্ঠের হাতছানি তার অলক্ষ্যে থেকে গেছে ।
শৈলজারঞ্জন বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও তাঁর জীবনে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের যোগকে নিয়তি নির্ধারিত মনে করেছেন । তাঁর শান্তিনিকেতনমুখী জীবনের আকস্মিকতা সেকথা যেন প্রত্যয়সিদ্ধ করে তোলে । ওকালতির প্রয়োজনে কেনাকাটা জন্য কলকাতায় গিয়ে বন্ধু প্রভাত গুপ্তের খোঁজখবর নিতে গিয়ে শৈলজারঞ্জন নিজেই নতুন কাজের আমন্ত্রণ পেয়ে যান । ইতিমধ্যে তাঁর বন্ধুটি বিশ্বভারতীর অর্থনীতির অধ্যাপক হয়েছেন । তিনিই শৈলজারঞ্জনকে বিশ্বভারতীর রসায়নের অধ্যাপক হওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করে দেন । স্বাভাবিক ভাবেই এতে শৈলজারঞ্জনের রুদ্ধ পথ যেন আকস্মিক বানে মুক্ত হয়েই যায় না, উন্মুক্ত হয়ে পড়ে ।
১৯৩২-এ শৈলজারঞ্জন মজুমদার বিশ্বভারতীতে রসায়নের অধ্যাপনায় যোগ দিলেও তাঁর আত্মপরিচয়ের সোপানে সেই রবীন্দ্রসঙ্গীতই অগ্রজের ভূমিকা সক্রিয় হয়ে ওঠে । রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেও তাঁর গানের পরিচয়ে নিজেকে মেলে ধরার অবকাশে শৈলজারঞ্জনের ঐকান্তিকতা ফলপ্রসূও হয় । রবীন্দ্রনাথও তাঁর সুযোগ্য শিষ্যকে চিনে নিতে পেরেছিলেন প্রথম দর্শনেই । শৈলজারঞ্জনের পূর্বোক্ত সাক্ষাৎকারের ভাষ্য অনুযায়ী কবি তাঁকে দেখেই জানিয়েছেন, ‘দেখি দেখি, তোমাকে তো চিনি আমি, তুমি আমার গান করো ।’ শিষ্যের বিনম্র শ্রদ্ধায় সম্মতি লাভে গুরুর প্রত্যয়ী অভিব্যক্তিতে গানের ভেলায় জাহাজের স্বপ্ন নিবিড় হয়ে আসে, ‘ তুমি এখানেই থাক, তুমি আমার গান করো ।’ স্বাভাবিক ভাবেই সেই প্রস্তাবে গানঅন্তপ্রাণ শৈলজারঞ্জনের অন্তরাত্মা নেচে ওঠে । লক্ষণীয়, রবীন্দ্রনাথ তাঁকে রসায়নে মতি না দিয়ে তাঁর গানের রসে মগ্ন হওয়ার আজ্ঞা প্রদান করেন এবং শৈলজারঞ্জনও তাতে ‘খুব খুশি’তে নিমগ্ন হয়ে পড়েন । দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান শেখার আনন্দ তাঁকে যতই আন্তরিক করে তোলে, ততই গুরুদেবের কাছে নিজেকে নিবিড় করে তোলার অবকাশ মেলে । শিক্ষানবিশী থেকে শিক্ষকের আসনে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই তাঁকে সামিল করেন । ১৯৩৫-এ গুরুদেবের কথায় শৈলজারঞ্জন ছোটদের গানের ক্লাস নিতে শুরু করেন । শুধু তাই নয়, ১৯৩৪ থেকে সমানতালে চলতে থাকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপিকরণের কাজও । প্রসঙ্গত স্মরণীয়, ছাত্র হিসাবে শৈলজারঞ্জন বরাবরই মেধাবী ছিলেন । রবীন্দ্রসঙ্গীতকেও তিনি স্বভাবসুলভ ভাবেই আয়ত্ত করেছিলেন । শুধু তাই নয়, তাঁর বৈজ্ঞানিক মনটিও তাঁকে এ কাজে আরও পারঙ্গম করে তুলেছিল । বিশেষ করে স্বল্প দিনের মধ্যেই তাঁর পক্ষে রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপিকরণের বিশ্বাস অর্জন সহজসাধ্য হয়ে ওঠে । অন্যদিকে তাঁর বেশি বয়সে যেভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষা লাভ ও অনতিবিলম্বে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাসভাজন হয়ে ওঠাটার মধ্যে শৈলজারঞ্জনের সঙ্গীতের প্রতি আত্মনিবেদিত প্রকৃতিটি আপনাতেই সবুজ মনে হয় । এজন্য একের পর এক দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়া থেকে নিজেকে সেই সঙ্গীতের গুরু দায়িত্বে সামিল করা সবেতেই তাঁর তীব্র অনুরাগই তাঁকে সাধকের আসনে বসিয়েছে । রবীন্দ্রনাথও তাঁকে আপন করে নিয়েছিলেন । ১৯৩৯-এ সঙ্গীতভবন প্রতিষ্ঠিত হলে তাঁর প্রথম অধ্যক্ষের দায়িত্ব শৈলজারঞ্জনের উপরেই ন্যস্ত হয় । রসায়ন বিভাগের অধ্যাপককে সঙ্গীতের গুরুদায়িত্বে বসানোর মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের গভীর আস্থা ও নির্ভরতাই প্রতীয়মান । অন্যদিকে শৈলজারঞ্জন অন্য একটি কারণেও বিশেষ ভাবে স্মরণীয় মনে হয় । রবীন্দ্রনাথকে নতুন গানের সানুরোধ তাগাদা দিয়ে অসংখ্য গান রচনা করিয়ে নিয়েছিলেন । জীবনের অন্তিম পর্বে যেভাবে গুরুদেবকে নতুন গান রচনায় সক্রিয় করেছিলেন, তার জন্যও শৈলজারঞ্জনের সদর্থক ভূমিকা অনস্বীকার্য । সার্বিক ভাবে যাঁরা শৈলজারঞ্জনের রবীন্দ্রসান্নিধ্যের আট বছরকে তাঁর গান শিখতেই অতিবাহিত হয়েছে বলে মনে করেন, তাঁরা যে শুধু তাঁকে অবমূল্যায়ন করে থাকেন না, সত্যের অপলাপেও তন্নিষ্ঠ হন । ১৯৩৫-এ দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর পর তাঁর ভূমিকাই তাঁকে রবীন্দ্রসঙ্গীতে ভূমি দান করেছে । শৈলজারঞ্জন তাঁর স্বকীয় প্রতিভায় নিজস্ব ঘরানা তৈরি করায়ও সক্ষম হয়েছিলেন । রবীন্দ্রনাথও তাঁকে যোগ্য মর্যাদা দিয়েছিলেন । শুধু তাই নয়, সঙ্গীতভবনের অধ্যক্ষ হিসাবে শৈলজারঞ্জন একটানা দীর্ঘ ২১বছর স্বপদে ছিলেন । অথচ তারপরেও রবীন্দ্রসঙ্গীতে তাঁর অভিভাবকসুলভ গ্রহণযোগ্যতা জনমানসে নিবিড়তা লাভ করেনি । অবশ্য তার মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই । বিষয়টি একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায় ।
শৈলজারঞ্জন রবীন্দ্রসঙ্গীতের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথে পৌঁছেছিলেন । সেক্ষেত্রে তাঁর গানঅন্তপ্রাণ প্রকৃতি তাঁকে শুধু তাঁর কাছে উপনীত করেনি, রবীন্দ্রসঙ্গীতকে আত্মস্হ করায় ক্ষেত্রপ্রস্তুতেও সহায়তা করেছিল । এজন্য তাঁর পক্ষে স্বল্প সময়ের মধ্যে সেই গান আয়ত্ত করা সহজসাধ্য হয়েছিল । শৈলজারঞ্জন আকাঁড়া গ্রাম্য পরিবেশ থেকেই শুধু আসেননি, রবীন্দ্রবিরোধী পরিবার থেকেও শান্তিনিকেতনের পরিশীলিত পরিবেশে এসেছিলেন । তার উপরে গান বা সঙ্গীত নিয়ে প্রথাগত শিক্ষাও ছিল না তাঁর। শৈলজারঞ্জনের গানের শিক্ষা একান্তই ভালবেসে, অনেটাই স্বশিক্ষিত । সেদিক থেকে তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীতের উত্তরণ অস্বাভাবিক না হলেও রাবীন্দ্রিক পরিসরে বাইরের যোগে তার অন্তরায়কে আন্তরিক করে তোলে । শৈলজারঞ্জন তাঁর এই বাইরের যোগের কথা যেভাবে বারবার স্মৃতি কথায় উল্লেখ করেছেন, তা যেমন তাঁর উত্তরণের আভিজাত্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়, তেমনই তাতে সম্পর্কের ফাঁকও উঠে আসে । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৬০-এই তিনি অবসরের অব্যবহিত পরিসরে শান্তিনিকেতনে ছেড়ে কলকাতায় স্থায়ী হন । যিনি রবীন্দ্রনাথের গানে শান্তিনিকেতনী শুদ্ধতা বজায় রাখার পক্ষপাতী ছিলেন, তিনিই অবসর জীবনে শান্তিনিকেতন ছেড়েচেন, ভাবা যায় ! আসলে তাঁর মধ্যেও সেই বাইরে যোগ তাঁকে আত্মসচেতনে রেখেছিল । যে-কারণে প্রাপ্তিতেই তাঁর আত্মতৃপ্তি যেভাবে প্রকাশিত হয়েছে, অপ্রাপ্তিতে স্বভাবসুলভ আত্মসমীক্ষায় আত্মলীন থেকেছিলেন আজীবন । তাঁর অন্তর্মুখী সংযমী প্রকৃতিতে এজন্য আস্ফালনের আড়ম্বর নেই, নেই হীনমন্যতার আত্মম্ভরিতা । শৈলজারঞ্জনের নীরব সাধনাই সেক্ষেত্রে তাঁর আত্মসচেতনতার গভীরতা ও মননশীলতাকে আবেদনক্ষম করে তোলে । তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীতজ্ঞের বিশিষ্টতা রাবীন্দ্রিক পরিসরে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যক্তিত্বে উচ্চকিত হয়ে ওঠেনি, রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিক্ষক হিসাবেও মেলেনি বনেদি আভিজাত্য । অথচ তাঁর ছাত্রছাত্রীদের প্রাচুর্য ঈর্ষণীয় । সুবিনয় রায়, শুভ গুহ ঠাকুরতা, নীহারবিন্দু সেন, আশীষ ভট্টাচার্য, রাজেশ্বরী দত্ত, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন, সুচিত্রা মিত্র প্রমুখের শিক্ষক তিনি । অবশ্য সকলেই একাধিক জনের কাছে শিক্ষা লাভ করেছেন । সেখানে ছাত্রছাত্রীদের বিজ্ঞাপনে সমাদৃত হওয়ার অবকাশেও শৈলজারঞ্জনের ব্যাপ্তি বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেননি । অন্যদিকে হারমোনিয়ামের পরিবর্তে এস্রাজের প্রচলনে তাঁর স্বকীয়তার ছাপেই তাঁর পরিচয় উচ্চকিত হয়েছে ।
আসলে শৈলজারঞ্জন রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিক্ষকের ভাবমূর্তিতে যেভাবে সক্রিয় হয়েছিলেন, সেভাবে তার শিল্পী হিসাবে নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি । সেখানে শিল্পীর জনসমাদর যেভাবে শ্রীবৃদ্ধি লাভের অবকাশ মেলে, সেভাবে তার শিক্ষকের বিস্তার ঘটে না । শিক্ষকের ভূমিকা অন্তরালেই থেকে যায় যদি না সেই শিল্পী তা জনমানসে প্রকাশ করেন । সেদিক থেকে শৈলজারঞ্জনের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়ে ওঠেনি । উল্টে বিরৃপ অভিজ্ঞতার কথাও জানা যায় । তাছাড়া তাঁর শিক্ষাশোভন সংযমী প্রকৃতিকে আত্মস্হ করাও সকলের পক্ষে সম্ভব ছিল না । অন্যদিকে তিনি স্বকীয় বৃত্তের বাইরে এসে শিল্পী বা গায়কের জনপ্রিয় হাতছানিতে নিজেকে মেলে ধরার পন্থায় অগ্রসর হননি। অথচ সে সুযোগ তাঁর করায়ত্ত ছিল । আজীবন স্বরচিত বৃত্তে আবর্তিত হয়েছেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতের চর্চাকে প্রসারিত করার জন্য কলকাতায় ‘গীতবিতান’, ‘সুরঙ্গমা’, ‘দক্ষিণী’ প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশে বারবার ছুটে গিয়েছেন । সেখানে রবীন্দ্রসঙ্গীতের চর্চার শ্রীবৃদ্ধিতে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য । অথচ তাঁর শিক্ষকের ভূমিকা কখনোই প্রাতিষ্ঠানিক অভিভাবকত্ব লাভ করেনি । শুধু তাই নয়, সুদীর্ঘকাল প্রাতিষ্ঠানিক অভিভাবকের আসনে সমাসীন থেকেও তাঁর গানের সিদ্ধি দিয়ে ব্যক্তিগত ইমেজ তৈরি করার মানসিকতাকে ঠাঁই দেননি তিনি । সেখানে তাঁর রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রসঙ্গীতে নিজেকে আত্মলীন করাতেই জীবনের সার্থকতা খোঁজার আন্তরিক প্রয়াস আজীবন সচল ছিল । সেদিক থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের অতুলনীয় মহার্ঘ সম্ভারকে তুলে ধরার জন্য তাঁর পাণ্ডিত্য প্রকাশের তীব্রতা স্বাভাবিক ভাবে সক্রিয়তা লাভ করেনি । এজন্য তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে তাঁর বইপত্রের অপ্রতুলতাও তাঁকে যেমন বিশেষজ্ঞের বিশিষ্টতার আধারকে সংকুচিত করেছে, তেমনই তাঁর শিক্ষকের ভূমিকাকে নিবিড়তা প্রদান করেনি । সবদিক থেকেই শৈলজারঞ্জনের প্রকাশের আলোর রুদ্ধ গতিতে জনসংযোগের সদরে বিস্তারে বিমুখতা নেমে এসেছে । এজন্য দীর্ঘ জীবনের পরিসরও তাঁকে রাবীন্দ্রিক পরিমণ্ডলে কর্তৃত্বের আসনে জনসমাদরে উচ্চকিত করে তোলেনি । বরং অস্তিত্বের নির্লিপ্ততায় শেষে তাঁর আত্মলীন প্রকৃতি আরও বেশি সবুজ হয়ে উঠেছে । অন্যদিকে একের প্রাচুর্যে অন্যের অভাবকেই শুধু প্রকট করে না, তার উত্তরণের পথকেও সঙ্কীর্ণ করে তোলে । তার উপরে সে যদি প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে, তবে তো কথাই নেই, একের উত্থানে অন্যের অবনমন অনিবার্য হয়ে ওঠে । শৈলজারঞ্জনের ক্ষেত্রে শান্তিদেব ঘোষের(১৯১০-১৯৯৯) ভূমিকা অনেকটাই সেভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছে । দুজনের অসম বিস্তারেই তা সহজবোধ্য হয়ে ওঠে ।
শান্তিদেব ১৯৩০-এ মাত্র কুড়ি বছর বয়সে বিশ্বভারতীর শিক্ষকতায় আত্মনিয়োগ করেন । সেদিক থেকে আপাতভাবে শৈলজারঞ্জনের চেয়ে তাঁকে দুবছরের সিনিয়র মনে হলেও ব্যক্তিত্বে ছিলেন অভিভাবকতুল্য । অথচ বয়সে শান্তিদেব শৈলজারঞ্জনের চেয়ে বছরদশকের ছোট । আসলে শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক শিক্ষায় বেড়ে ওঠা শান্তিদেবকে রবীন্দ্রনাথ নিজের মতো করে গড়ে তুলেছিলেন । তাঁর নাম ‘শান্তিময়’কে ‘শান্তিদেব’-এ পরিবর্তন করেছিলেন তিনি । তাঁর সঙ্গীত ও নৃত্য শিক্ষার পূর্ণতায় রবীন্দ্রনাথ তাঁকে তাঁর শ্রীলঙ্কা, বার্মা, জাভা ও বালীর ভ্রমণসঙ্গী করেছিলেন । এছাড়া শান্তিদেব অভিনয়েও নিজেকে বিস্তার করেন। তিনি কৈশোরেই রবীন্দ্রনাথ ও দিনেন্দ্রনাথের কাছে গান শিখেছিলেন । রবীন্দ্রনাথের হাতে গড়া বহুমুখী শিক্ষায় শান্তিদেব অল্প বয়সেই রাবীন্দ্রিক পরিসরে সমীহ আদায় করে নেন । শৈলজারঞ্জনও তার পরিচয় পেয়েছিলেন । তিনি শান্তিনিকেতনে গিয়ে তাঁর অল্প বয়সেই রাশভারি ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আন্তরিক হতে না পারার কথা স্মরণ করেছেন । অন্যদিকে সঙ্গীতগীতভবনের রবীন্দ্রসঙ্গীত ও নৃত্যের অধ্যাপক হয়েও শান্তিদেব তাঁর আধিপত্য ক্রমশ বিভিন্নভাবে উৎকর্ষমুখর উত্তরণের মাধ্যমে আজীবন বজায় রেখেছিলেন । আকাশবাণী কলকাতার উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য (১৯৪৮), সঙ্গীত নাটক অকাদেমির প্রকাশনা সমিতির সদস্য (১৯৫৬-১৯৬০) থেকে প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন ও আসাম সাহিত্য সম্মেলনের সঙ্গীত বিভাগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি । প্রসঙ্গত স্মরণীয়, শান্তিদেব ঘোষ লেখক হিসাবেও সমধিক পরিচিতি লাভ করেন । সেক্ষেত্রে বিশেষ করে রবীন্দ্রসঙ্গীতের উপরে তাঁর অধিকার লেখনীর পরশে বইপত্রের মাধ্যমে মূর্ত হয়ে ওঠায় তাঁর শুধু বিশেষজ্ঞ হিসাবেই নয়, প্রাতিষ্ঠানিক অভিভাবকত্বও ক্রমশ আবেদনক্ষম হয়ে ওঠে । অন্যদিকে শৈলজারঞ্জনের পরবর্তী পরিসরে শান্তিদেব সঙ্গীতভবনের দুই বার ( ১৯৬৪-১৯৬৮ এবং ১৯৭১-৭৩) অধ্যক্ষের দায়িত্বে ছিলেন । তাঁর কাজের পরিধি যেমন শ্রীবৃদ্ধি লাভ করেছে, তেমনই প্রতিষ্ঠা ও সমাদর বিস্তার লাভ করে এবং রাবীন্দ্রিক পরিসরের প্রমুখ হিসাবে তাঁর পরিচিতি দেশময় ছড়িয়ে পড়ে । সঙ্গীত নাটক অকাদেমির ফেলোশিপ(১৯৭৭), আনন্দ পুরস্কার (১৯৮০), ‘পদ্মভূষণ'(১৯৮৪) সম্মানের পর ‘দেশিকোত্তম'(১৯৮৪) লাভ করেন । অথচ শৈলজারঞ্জন ‘দেশিকোত্তম’ পান তার পরের বছর (১৯৮৫) । সেদিক থেকে শান্তিদেবের স্বীকৃতি ও প্রতিষ্ঠার উত্তরণের আলোয় শৈলজারঞ্জনের প্রভাব আপনাতেই রুদ্ধ হয়ে পড়ে । অন্যদিকে তাঁর মৃত্যুর পরেও শান্তিদেব আরও বছরসাতেক রাজত্ব করেছেন এবং রাবীন্দ্রিক পরিসরে তাঁর আধিপত্যে একমেবাদ্বিতীয়ম প্রকৃতিকে সবুজ করে রেখেছিলেন । স্বাভাবিক ভাবেই শান্তিদেবের আলোকিত পরিসরে শৈলজারঞ্জনের আলোর বিস্তার আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি । তার মধ্যে তাঁর রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে উত্তরণের স্মৃতিকথাও বিস্মৃতির আধার হয়ে ওঠে । সেই বিরূপ অভিজ্ঞতাও তাঁর প্রতি বিমুখতাকে আন্তরিক করে তোলে । সেজন্য শান্তিদেবের ভূমিকা বর্তমান ।
শৈলজারঞ্জন জীবনের উপান্তে অপরিণত আত্মীয়ার অনুলিখনে তাঁর স্মৃতিকথা ‘যাত্রাপথের আনন্দগান’ প্রকাশ করেছিলেন । সেই স্মৃতিকথা ছিল তাঁর জীবনের মহার্ঘ সঞ্চয় । সেই সঞ্চয় দিয়েও তিনি শেষ জীবনে নিজেকে ভালো ভাবে সচল করে তুলতে পারেননি । কেননা শান্তিদেবের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের কলমের আঁচড়ে তা ‘মিথ্যে কথা’র আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়ে । ‘বিশ্ববীণা’ পত্রিকায় প্রকাশিত সেই লেখায় সমালোচক শৈলজারঞ্জনের স্মৃতিকথাকেই প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় । ফলে তার বিরূপতায় শৈলজারঞ্জনের স্মৃতিসুধাও তাঁর সপক্ষে প্রত্যাশা পথে অগ্রসর হতে পারেনি । তারপরেও শৈলজারঞ্জনের নীরবতা ভঙ্গ হয়নি । তাঁর এই নীরবতা সম্মতির লক্ষণে সম্প্রসারিত হবে জেনেও তিনি স্বকীয় আদর্শ ও ব্রত থেকে বিচ্যুত হননি তিনি । সেদিক থেকে জনমানসে বিমুখতায় তাঁর স্বরচিত জীবনাদর্শও যে সক্রিয় ছিল, তাও সহজে অনুমেয় । আসলে শৈলজারঞ্জন রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সঙ্গীতের নিবিড়তায় জীবনের পরম পরশ খুঁজে পেয়েছিলেন । সেখানে তিনি রবীন্দ্রসাগরে তীব্র মিলনাকাঙ্ক্ষী নদী । মিলনেই তার আনন্দ, তার পরম প্রাপ্তি । অন্যদিকে শান্তিদেব রবীন্দ্রসাগরের স্বকীয় দ্বীপ । প্রকাশে তার আভিজাত্য, তার সৌরভ । তা আপনাতেই প্রকাশমুখর । আধিপত্যকামী শক্তি তার সহজাত । অন্যদিকে সমুদ্রগামী নদী সমুদ্রে মিশে গেলেও তার অস্তিত্ব সমান সচল । মিলনের আনন্দের মধ্যে তার বৃহতের হাতছানি বর্তমান । শুধু তাই নয়, তার প্রবাহে থাকে নতুন জীবনের স্বাদ-স্বপ্ন । শৈলজারঞ্জন তা রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে এসে নিবিড় ভাবে আস্বাদন করেছেন আজীবন । তাঁর জীবননদী রবীন্দ্রসাগরের নিবিড় অস্তিত্বে আত্মলীন হয়ে থেকেছে । সমুদ্রের ঢেউ যে দ্বীপও পায়, নদীর মোহনাও লাভ করে । অন্যদিকে নদীর অস্তিত্ব দ্বীপের মতো প্রকট না হলেও তার দীর্ঘপথ অতিক্রম করে মিলনের অভিজ্ঞতা থেকে নতুন জীবনের পরশ তাকে বনেদি আভিজাত্যে সমুদ্রের কাছে শুধু আনত করে না, বৃহত্তর চেতনায় পরম আত্মীয় করে তোলে । সেই আত্মীয়তাবোধে শৈলজারঞ্জন নীরবে রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সঙ্গীতের সাধনায় নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন । যেকারণে জনমানসে নিবিড়তার চেয়ে রবীন্দ্রসাগরে আত্মলীন থাকার প্রতি সযত্ন প্রয়াস চালিয়ে গিয়েছেন আমৃত্যু । সেখানে তাঁর নীরব সাধনা আপনাতেই বিরল ইতিহাস রচনা করে চলে । শুধু তাই নয়, শান্তিদেবের বিখ্যাত হওয়ার পাশে শৈলজারঞ্জনের প্রখ্যাত প্রকৃতি আপনাতেই সবুজ সজীব হয়ে ওঠে ।