রাজু পারাল
জীবনের রূপ দেখতে দেখতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ‘রূপদর্শী’। তাঁর কথায় — ‘দিনরাত্রি সতর্ক চোখে ঘুরেছি, যা দেখেছি, যেটা ভালো লেগেছে, সেটা তুলে ধরেছি। ‘সমাজ, মানুষ ও সাহিত্য সব কিছুকেই যেন আত্মস্থ করে তিনি অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেছিলেন এক স্বতন্ত্র পথের। ইতিহাসবেত্তা সুগত বসুর কথায়, ‘গান্ধীজির পথ অবলম্বন করেই তিনি ভীরুতা ও কাপুরুষতাকে নির্দেশ করেছিলেন মনুষত্বের শত্রু হিসাবে।’ আজকের রাজনৈতিক ও সামাজিক পটভূমিতে তিনি অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। অন্যায়ের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার মাধ্যমেই শুরু করেছিলেন নিজের পেশাদারি জীবন। সংবাদ মঞ্চের নিজস্ব ভূমিতে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার পরও এক বিন্দু সরে আসেননি নিজের আদর্শ থেকে। বর্ণময়, নির্ভীক, দুর্দমনীয় ও অসম সাহসী মানুষটি হলেন বাংলা সংবাদপত্র জগতের কিংবদন্তি সাংবাদিক ও সাহিত্যিক গৌরকিশোর ঘোষ।
আপসহীন সংগ্রামী এই মানুষটির জন্ম ১৯২৩ সালের ২০ জুন অবিভক্ত বাংলাদেশের যশোর জেলার হাট গোপালপুরের মাতুলালয়ে। পিতা গিরিজাভূষণ ছিলেন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক। তিনি বৈষ্ণব দর্শনে বিশ্বাসী। গৌরকিশোর ঘোষের প্রাথমিক পর্বের পড়াশোনা শুরু হয় শ্রীহট্ট জেলার চা-বাগানে। পরে পরিবারের লোকজন চলে আসেন এপার বাংলায়। নবদ্বীপের ‘বকুলতলা উচ্চবিদ্যালয়’ থেকে পাশ করেন ম্যাট্রিক, পরে ইন্টারমিডিয়েট। প্রথাগত শিক্ষার সমাপ্ত ওখানেই। পেশা সূত্রে বিভিন্ন জায়গায় যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। যার উল্লেখ পাওয়া জায় তাঁর বাল্য স্মৃতিচারণে। তবে অল্প বয়স থেকে ভবঘুরে মানসিকতায় বড় হওয়ায় মানুষটি যখন যে কাজে যুক্ত হয়েছেন, সব সময়েই নিষ্ঠা ও আত্মবিশ্বাসকে সম্বল করে সার্থক হয়েছেন। এক সময় পিতা গিরিজাভূষণ নিজের চাকুরি ছেড়ে দিয়ে দুঃস্থদের পড়াশোনা শেখানোর কাজে নিয়োজিত হলে সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব এসে পড়ে গৌরকিশোরের কাঁধে। তখন থেকেই শুরু হয় তাঁর কর্মজীবন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরণের কাজের সঙ্গে যুক্ত থেকে অর্থ উপার্জনের তাগিদ সসম্মানে পালন করেছিলেন তিনি। কখনও ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, কখনও ফিটার মিস্ত্রি, কখনও রেস্তোরা কিংবা চা – বাগানের শ্রমিক, কখনো নাচের দলের ম্যানেজার, কখনো শিক্ষকতা – কত কি! শেষ পর্যন্ত সীমান্তে শুল্ক আদায় অফিসে কেরানির চাকরিতে। প্রবল আত্মসম্মানবোধ এবং লড়াইয়ের দুর্দমনীয় ক্ষমতা সম্ভবত গৌরকিশোর পেয়েছিলেন মায়ের কাছ থেকে।
১৯৪৭ সালে ‘নববাণী’ পত্রিকায় ‘প্রুফ রিডার’ হিসাবে প্রকাশনার জগতে পা রাখেন গৌরকিশোর। পরের বছর যোগ দেন ‘দৈনিক সত্যযুগ’ সংবাদপত্রে। দায়িত্ব পান ছোটদের সাপ্তাহিক পাতা সম্পাদনা করার। সেখানে সহকর্মী হিসাবে পান নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী – সহ অনেককেই। সেই সূত্রপাত। এরপর আমৃত্যু বাংলা সাংবাদিকতা ও তার পাশাপাশি সাহিত্যেও এক ভিন্ন ভাবনার পথ খুঁজেছিলেন। ১৯৫০ সালে প্রকাশ পায় তাঁর প্রথম বই — ‘এই কলকাতায়’। জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে ছদ্মনামে লেখা তাঁর কলাম – ‘রূপদর্শীর নকশা’, রূপদর্শীর সংবাদ ভাষ্য’ ইত্যাদি। এক সময় সাগরময় ঘোষের সূত্রে যুক্ত হন ‘দেশ’ পত্রিকাতেও। ১৯৫২ সালে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় সাংবাদিক হিসাবে যোগ দেন। একজন নির্ভীক সাংবাদিক হিসাবে তিনি অনুপ্রাণিত করতেন সতীর্থদেরও। সে সময়ে তাঁর সংগ্রামের নবরূপ দেখে উৎসাহিত হয়ে উঠতেন অনেকেই। আটের দশকের একেবারে গোড়াতেই গৌরকিশোর ‘আনন্দবাজার গোষ্ঠী’ ছেড়ে যোগ দেন সাংবাদপত্র জগতের সম্পূর্ণ নতুন এক আঙিনা ‘আজকাল’ কাগজে। বলা যেতে পারে, সেই সংবাদপত্রের হাল তিনি ধরেছিলেন একেবারে জন্মলগ্ন থেকেই। প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবেই নতুন সেই কাগজে অভিষেক ঘটে তাঁর। প্রথম থেকেই ভিন্নধর্মী সহজ, সরল লেখনী ও বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সমস্যার কথা সংবাদপত্রের পাতায় তুলে ধরে সাংবাদিক হিসাবে বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দেন যুবক অবস্থাতেই। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের লেখালেখি কর্তৃপক্ষের বিশেষ নজর কাড়ে। ‘রূপদর্শী’ ছদ্মনামে লিখেছিলেন অসংখ্য গল্প ও উপনাস। এছাড়াও ব্যবহার করেছেন একাধিক ছদ্মনাম – বেতলাভট্ট, গৌরানন্দ কবিভনে প্রভৃতি। ঐ সব ছদ্মনামে টানা পাঁচ দশক বহু ফিচার, উত্তর সম্পাদকীয় লিখে সাংবাদিকতার ইতিহাসে ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন গৌরকিশোর ঘোষ।
সাহিত্যের আঙিনায় গৌরকিশোর সৃষ্টি করেছিলেন ‘ব্রজদা’ নামে এক চরিত্রের। যা অসাধারণ এক রসসাহিত্য। তাঁর লেখা নানা গল্প, উপন্যাস আজও পাঠক মনকে বিশেষ আনন্দ দেয়। গৌরকিশোরের লেখা বিভিন্ন জনপ্রিয় উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে — ‘প্রেম নেই’, ‘মনের বাঘ’, ‘লোকটা’, ‘গড়িয়াহাট ব্রিজের ওপর থেকে’, ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ ইত্যাদি। ছোটরা তাঁর লেখা ‘মেঘনামতি’, ‘দুষ্টুর দুপুর’ ইত্যাদি সাহিত্যগুলি গোগ্রাসে গিলতো।
রাজনৈতিক ব্যাপারে গৌরকিশোর ছিলেন রাডিকাল হিউমানিস্ট। মানবতাবাদী, সংস্কার রহিত, উদারপন্থী। ধর্ম, সম্প্রদায়, আচার, নিয়ম কোনও কিছুতেই তাঁর গোঁড়ামি ছিল না। প্রচলিত রীতি- নিময়ের তোয়াক্কা করেননি নিজের জীবনে। গৌরকিশোরের পরিচিতির জগৎ স্বাভাবিকভাবেই ছিল বিস্তৃত। তাঁর ঘনিষ্ট যোগাযোগের বৃত্তে জোতি বসু, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, চারু মজুমদার, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, মমতা ব্যানার্জীরা যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন শিল্প সংস্কৃতির প্রসিদ্ধ মানুষেরা। সেখানে দল, মত, গোষ্ঠীর কোনও বিচার ছিল না। সাতের দশকের গোড়ায় নকশাল আন্দোলন তখন তুঙ্গে। আদর্শের দোহাই দিয়ে তখন তাঁদের খুনের রাজনীতি মানতে পারেননি গৌরকিশোর। তাঁর শাণিত কলম তীব্র আক্রমণ করেছিল ওই হঠকারিতার বিরুদ্ধে। নকশালরা ডাক দিলেন – ‘গৌরকিশোর ঘোষের মুন্ডু চাই’। তিনি কর্ণপাত করেননি সে সব কথায়। লেখাও থামান নি। সাংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার ক্ষুরধার লেখনীর জন্য ১৯৭৫ সালে সরকারি কাজের বিরোধিতা করায় জরুরি অবস্থা চলার সময় তাঁকে ‘মিসা’ আইনে গ্রেফতার করা হয়। এই ঘটনার প্রতিবাদে গণতন্ত্রের মৃত্যু হয়েছে বলে মাথা কামিয়ে অশৌচ পালন করেছিলেন গৌরকিশোর। প্রেসিডেন্সি জেলে তাঁকে প্রথমে সাধারণ কয়েদির মতো রাখা হলেও পরে তিনি রাজবন্দির মর্যাদা পান। ১৯৭৭ সালের জরুরি অবস্থার নানান অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখেন ‘আমাকে বলতে দাও’ বইটি। বিভিন্ন সময়ে ধর্মে ধর্মে বিভাজনের বিরুদ্ধেও তিনি সোচার হয়েছিলেন। সংসার জীবনে কিছুটা আগোছালো মনে হলেও সাংবাদিকতা ও সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সৎ ও আদর্শবান। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের লেখালেখিতে পুষ্ট করেছেন বাংলা সাহিত্যকে। সে সবের স্বীকৃতিতে পেয়েছিলেন একাধিক পুরস্কারও। ১৯৭০ সালে পান ‘ম্যাগসাইসাই’ পুরস্কার। জুনিয়র সাংবাদিকদের গৌরকিশোর বলতেন, ‘জ্যাক অফ অল ট্রেডস, মাস্টার অফ নান’ হতে। এই প্রবাদ পুরোপুরি ভুল প্রমাণিত হয়ে যায় গৌরকিশোর ঘোষের ক্ষেত্রে। তিনি ছিলেন ‘ — মাস্টার অফ এভরিথিং ——‘।
২০০০ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রয়াণ হয় এই কিংবদন্তি সাংবাদিক তথা সাহিত্যিকের। জন্ম তারিখে তাঁর প্রতি রইলো আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।