• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয়, দেশ বা জাতির সেবায় মঠ-মিশন ও সঙ্ঘ গড়ে উঠেছে

স্বপনকুমার মণ্ডল আধুনিক ভোগবাদী সমাজে ‘সেবা’র চেয়ে ‘পরিষেবা’র দড় আপনাতেই মুখর। সেবার করুণা পরিষেবায় নির্মম হয়ে ওঠে। যেখানে ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’ থেকে ‘কড়িতে বাঘের দুগ্ধ মেলে’, মায় ‘লাখ টাকা দেখলে কাঠের পুতুলও হাঁ করে’র সচলতা চরৈবেতি, সেখানে পরিষেবার মূল্যের কাছে সেবা যতই অমূল্য মনে হোক না কেন, অর্থের প্রাচুর্যে ও গরিমায় তার প্রতি সশ্রদ্ধ

স্বপনকুমার মণ্ডল

আধুনিক ভোগবাদী সমাজে ‘সেবা’র চেয়ে ‘পরিষেবা’র দড় আপনাতেই মুখর। সেবার করুণা পরিষেবায় নির্মম হয়ে ওঠে। যেখানে ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’ থেকে ‘কড়িতে বাঘের দুগ্ধ মেলে’, মায় ‘লাখ টাকা দেখলে কাঠের পুতুলও হাঁ করে’র সচলতা চরৈবেতি, সেখানে পরিষেবার মূল্যের কাছে সেবা যতই অমূল্য মনে হোক না কেন, অর্থের প্রাচুর্যে ও গরিমায় তার প্রতি সশ্রদ্ধ চেতনাও বিলুপ্তপ্রায়। আর সেখানেই সব চেয়ে বড় আঘাতটি নেমে আসে। আধুনিক ভোগবাদী জীবনে প্রত্যেক ব্যক্তিকে উপভোক্তা (Consumer) করে তোলা বা ভাবার বিষয়টি এতটাই উগ্রতা লাভ করে যেখানে পরিষেবা দিয়েই সেবার মহত্ত্বকে আত্মস্থ করার প্রয়াস সক্রিয় হয়ে ওঠে । যেন ইচ্ছে করলেই সেবা করা যায়। আসলে অর্থের আধিপত্য সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে দাতার বিধাতা হয়ে ওঠাটা সময়ের অপেক্ষামাত্র। ‘জগৎটা কার বশ’-এর প্রশ্নের উত্তর শুধু টাকায় থেমে থাকে না, সেই টাকাই আসলে জগতের বশ হয়ে ওঠে। সেজন্য অর্থের বাজারদরে পরিষেবার মান যেমন বেড়ে চলে, তেমনই তা আভিজাত্য লাভ করে। সেবা হয়ে ওঠে দীন-হীনদের প্রতি সামাজিক মর্যাদাবোধে দান-খয়রাতসর্বস্ব। অথচ অর্থের বিনিময়ে পরিষেবা উৎকর্ষমুখর হয়ে উঠলেও সেবার বুনিয়াদটি ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়। পরিষেবা প্রাপ্তিতে অর্থের প্রয়োজন আর সেবায় আবশ্যক জীবনের পরমার্থ। আধুনিক ভোগসর্বস্ব জীবনবোধেই যেখানে সেবার চেতনা দান-খয়রাতের মধ্যে আবর্তিত থেকে ত্যাগের সুউচ্চ সোপানটি ক্রমশ সুদূরপ্রসারিত মনে হয়, সেখানে পরিষেবার সহজলভ্য আভিজাত্যবোধটি আপনাতেই তীব্র আবেদনক্ষম হয়ে ওঠে। অন্যদিকে ভোগের হাতছানি যেখানে বিচ্ছিন্নতাবোধকে সক্রিয় করে তোলে, সেখানে সেবার আত্মত্যাগের মহৎ আদর্শটি সমষ্টি-চেতনায় ব্রাত্য মনে হয় । শুধু তাই নয়, যেখানে ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’-এর অপার মহিমা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের বনেদিয়ানাকে উজ্জ্বল করে তোলে, সেখানে সেবার চেয়ে আত্মসেবার সোপানটি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠাই দস্তুর। অথচ পরিষেবার স্বার্থপর প্রকৃতিটির সংকীর্ণতাবোধ আমাদের শুধু জনবিচ্ছিন্ন করে তোলেনি, সম্পর্কের বুনিয়াদি চেতনার মাঝে দেওয়াল তুলে দিয়েছে। নার্সিংহোম থেকে বৃদ্ধাশ্রম সবেতেই তার বিস্তার। সম্পর্কের সেই দেওয়াল ভাঙার কাজটি কত মহামানব কত ভাবেই না করতে চেয়েছেন,তার ইয়ত্তা নেই ! আমাদের দেশে গৌতমবুদ্ধ থেকে স্বামী বিবেকানন্দ প্রায় সব মহৎপ্রাণই নানাভাবে সেই দেওয়ালটি সমূলে উৎপাটনে ব্রতী হয়েছেন । এজন্য তাঁদের সংঘবদ্ধ প্রয়াস শুধু ইতিহাসবন্দিত হয়ে থাকেনি, উৎকর্ষের বনেদিয়ানায় নন্দিতও হয়েছে। সেই ধারায় স্বামী প্রণবানন্দের (১৮৯৬-১৯৪১) প্রতিষ্ঠিত সঙ্ঘের সদর্থক প্রয়াসের কথা নানাভাবে উঠে আসে। তাঁর ত্যাগ ও সেবার সেপানে গড়ে তোলা সংঘবদ্ধ মানবকল্যাণের ভূমিকায় উপনীত হওয়ার জন্য প্রথমে সেবা ও পরিষেবার অন্তরায়টি আন্তরিক করে তোলা জরুরি ।

মানবসমাজে পরিষেবার দাসত্ব কতভাবেই না বিস্তার লাভ করেছে। ক্রীতদাস, ভূমিদাস থেকে বেতনদাস, দলদাস প্রভৃতি দাসবংশের সমৃদ্ধিলাভ উপচীয়মান। অথচ সেই দাসত্বের হেয় মানসিকতাই আধুনিক ভোগবাদী সমাজে পরিষেবার আভিজাত্যে আত্মগোপন করে আত্মতৃপ্তি লাভ করে। শুধু তাই নয়, বিত্তের আভিজাত্যে চিত্তের সংকীর্ণতা নেমে আসে। সেখানে পেশাগত উৎকর্ষে পরিষেবার মানোন্নয়নের নেপথ্যে ভোগবাদী চেতনার বিস্তার সহজসাধ্য হয়ে ওঠে। যেখানে ভোগের আরতি সুরভিত হয়, সেখানে পরিষেরার বনেদিয়ানা সক্রিয় হয়ে ওঠে। অন্যদিকে ভোগের আগ্রাসী চেতনায় চিত্তের পরিসর শুধু সংকীর্ণ হয়ে পড়ে না, সেইসঙ্গে আত্মসর্বস্ব দৈত্যের রূপ লাভ করে। শুধু তাই নয়, পরিষেবার ক্রয়ক্ষমতার মাত্রাধিক্যে যখন সুখানুভূতির ডানা ঝাপটানো স্বাভাবিক মনে হয়, তখন তার সেবার চেতনা বাহুল্য হয়ে ওঠে। ‘চাচা আপন জান বাঁচা’র সক্রিয়তায় ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’-এর উৎকট ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের পরিসরে পরিষেবা আর সেবার পার্থক্যই শুধু নয়, আত্মসেবার আদিমতায় আত্মীয়তাবোধও অন্তর্হিত হয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়, মানবসেবার নেপথ্যে আত্মসেবার পরিসর বৃদ্ধির পরিকল্পনা বর্তমান। সেখানে ‘বাঁচো আর বাঁচাও’-এর মহৎ আদর্শ আপনাতেই উবে যায়। অথচ পরিষেবার কেতাদুরস্ত চেতনার সংকীর্ণ পরিসরের পাশে সেবার আত্মীয়তা বোধের অপার বিস্তৃতি কতভাবেই না মহৎপ্রাণেরা ব্যক্ত করে গিয়েছেন! অবশ্য সেই ব্যক্ততার পরিসরটি ধর্মীয় আবর্তে আবর্তিত হলেও তার মানবিক আবেদনটি নানাভাবে বিকশিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে সেই মানবতামুখী চেতনার বিস্তার ধর্মীয় গণ্ডি অতিক্রম করে অত্যন্ত সহজে সাধারণ্যে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে হিন্দু-বৌদ্ধ, খ্রিস্টান-মুসলমান প্রভৃতির ধর্মীয় প্রাচীর মানবতার আদর্শকে আড়াল করতে পারেনি। সাধারণত সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মভীরু মানুষের কাছে ধর্মের আধারে মানবসেবার বার্তা আবেদনক্ষম হয়ে ওঠে। সেখানে জ্ঞান অপেক্ষা ভক্তির জোর অনেক বেশি। একুশ শতকে দাঁড়িয়েও দেশের প্রধানমন্ত্রীকে গঙ্গাদূষণ প্রতিরোধে নারকেল মাটিয়ে গঙ্গাপূজা করতে হয়। অন্যদিকে ধর্মের দেশ হিসাবে ভারতের গুরুবাদী সমাজে নানাভবে ধর্মীয় আবেদনে মানবসেবার বার্তা বিঘোষিত। সেখানে বুদ্ধদেবের ধর্মবোধের মধ্যে মানবসেবায় সংঘবদ্ধ প্রয়াস বিদ্যমান। অথচ সেকালেও পরিষেবা ও সেবার মধ্যে ব্যবধানটি অত্যন্ত প্রকট ও স্পষ্টবাক্। এবিষয়ে যিনি আমাদের ‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া’লে ‘বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া’র অমৃতপথের দিশারি সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই তাঁর ‘কথা’ (১৯০০)কাব্যের ‘নগরলক্ষ্মী’ কবিতায় তা গল্পের ছলে আলোকপাত করেছেন। পরিষেবার দৈন্য সেবার বদান্যতায় কীভাবে ভেঙে পড়ে, তার পরিচয় কবিতাটিতে উপাদেয় হয়ে উঠেছে।

দুর্ভিক্ষপীড়িত শ্রাবস্তীপুরের হাহাকার নিরসনে বুদ্ধদেব তাঁর ভক্তদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তাতে রত্নাকর শেঠ, সামন্ত জয়সেন, ধর্মপাল প্রমুখ সমাজের প্রতিপত্তিশালী ধনীদের বিপুল সংখ্যক জনগণের পরিষেবার সীমাবদ্ধতায় অপরাগতার কথা শোনার পর নগণ্যা ভিখারিণীর দায়িত্ব গ্রহণ স্বাভাবিক ভাবেই বিস্ময় উৎপাদন করে। অথচ সেই ভিখারিণী অবনত চিত্তে সেবার ব্রতে অবিচল: ‘কাঁদে যারা খাদ্যহারা আমার সন্তান তারা,/ নগরীর অন্ন বিলাবার/ আমি আজি লইলাম ভার।’ দীন-হীনা হয়েও তাঁর এরূপ দুঃসাহসে বিস্মিত সকলে। অথচ ‘শুধু এই ভিক্ষাপাত্র আছে’র সম্বলে বলশালিনী ভিখারিণীর আত্মত্যাগী সেবার চেতনায় বিত্তশালীদের পরিষেবার দুর্ভাবনা নিঃস্ব হয়ে পড়ে। সেখানে আত্মীয়তার বাঁধনে মানুষের সমষ্টি-চেতনা কত বর্ণরঙিন হয়ে ওঠে, তা ভাবলে একালেও বিস্ময় জাগে : ‘আমার ভাণ্ডার আছে ভরে/ তোমা-সবাকার ঘরে ঘরে ।/ তোমরা চাহিলে সবে এ পাত্র অক্ষয় হবে।/ ভিক্ষা-অন্নে বাঁচাব বসুধা—/ মিটাইব দুর্ভিক্ষের ক্ষুধা।’ সেদিক থেকে শুধু সেকালে নয়, একালেও সেবার বড় দায়। আর তার মূলে রয়েছে সেবার সমষ্টি-চেতনার অভাববোধ। অধুনিক ভোগবাদী সমাজে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রবল প্রতাপে জনবিচ্ছিন্ন প্রকৃতি অত্যন্ত সজীব ও সবুজ। তাতে অবশ্য পরিষেবার আভিজাত্য যেমন বেড়েছে, সেবার মানসিকতা তেমনই উৎকর্ষমুখর হয়েছে। তার ফলে খাঁটির উপমায় ঘরে তৈরি বা দেশজ উৎপন্নের মতো পরিচর্যার উৎকর্ষে সেবার সৌরভ রপ্তানির প্রয়াস সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সেখানে অর্থের বিনিময়ে পরিষেবা প্রদান করা হলেও নামকরণে তার ‘সেবা সদন’ থেকে ‘সেবানিকেতনে’র পরিসরটি বিজ্ঞাপিত হয়ে থাকে। অথচ তাতে সেবার বনেদিয়ানা স্বীকৃত হলেও তার অপরিহার্যতা সক্রিয় হয়ে ওঠেনি। বরং সেক্ষেত্রে অর্থের বিনিময়ে পরিষেবা ক্রয়ে সেবার মানসিকতাকে দেউলিয়া করার তৎপরতা ভোগবাদী সমাজের বিশেষত্বে উৎকর্ষ লাভ করে। শুধু তাই নয়, সেখানে সম্পর্কের ভিত শেষে অর্থের সীমায় আবদ্ধ হয়ে পড়ে। টাকা থাকলেই বাঁচার অধিকার ও তার মান সুলভ হয়ে ওঠার প্রবণতায় পরিষেবার সমাদরে সেবার আত্মীয়তাবোধ আপনাতেই ব্রাতা হয়ে ওঠে। সেখানে জনসেবার মহত্ত্ব আত্মসেবার সোপানে শুধু প্রান্তিক হয়ে পড়েনি, দীন-হীন প্রকৃতিতে নিঃস্ব মনে হয়। স্বাধীনতা-উত্তর পরিসরে সরকারিভাবে জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের দিকে তাকালেই বিষয়টি সহজবোধ্য হয়ে ওঠে। সেখানে সরকারি জনসেবার চেয়ে বেসরকারি পরিষেবার চাহিদা অনন্ত। অথচ এই পরিষেবার উৎকর্ষ অর্থে নয়, তা সেবায় রয়েছে জেনেও আমরা অর্থের বিনিময়ে সেই সেবাকে আয়ত্ব করতে আগ্রাসী হয়ে উঠি। সেই আগ্রাসনে জনবিচ্ছিন্ন প্রকৃতি শুধু সবুজ হয়ে ওঠেনি, জনমানসে তার একাত্মবোধের অভাবকেও আরও নিবিড় করে তুলেছে। তার ফলে ভোগবাদী সমাজজীবনে সম্পর্কের বুনিয়াদি চেতনাতেই শুধু সংকট তৈরি করেনি, তার মানবিক অভিমুখটি ক্রমশ অমানবিকতায় আত্মগোপন করে। একদিকে জনবিচ্ছিন্ন প্রকৃতিতে বৈষম্যবোধের তীব্রতা গতি লাভ করে, অন্যদিকে পারস্পারিক মানবিক সম্পর্কের সংকট অনিবার্য হয়ে ওঠে। দেশের বৈষম্যপীড়িত সমাজমানসে মানবিক সংকটের সুরাহায় আধুনিক পরিসরেও ধর্মীয় সংগঠন থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক সংগঠনের সেবামুখী উদ্যোগ উনিশ শতক থেকেই নানাভাবে বিকশিত হয়। সেক্ষেত্রে সেবার মাধ্যামে ধর্মের বিস্তার যেমন স্বাভাবিক হয়ে ওঠে, তেমনই দেশগঠনের সোপানও তাতে সক্রিয়তা লাভ করে ।

আসলে জনসেবায় মানবধর্মের উৎকর্ষের পাশাপাশি দেশসেবার পরিসরটি আপনাতেই বিস্তার লাভ করে। শুধু তাই নয়, উনিশ শতকে এদেশে জনসেবার চেতনায় বিদেশি প্রভাবও বর্তমান। ইংল্যান্ডের জেরেমি বেন্থামের (১৭৪৮-১৮৩২) হিতবাদী দর্শনের প্রচার এদেশেও সক্রিয় হয়ে ওঠে । ‘হিতবাদ’-এর ‘সর্বাধিক মানুষের সর্বাধিক পরিমাণ হিত বা মঙ্গল সাধন’ (‘Greatest good of the greatest number’)-এর বার্তা নব্য শিক্ষিতদের মাধ্যমে বিকশিত হয়। স্বয়ং বন্ধিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাঁর ধর্মতত্ত্বেও তার ক্ষীণ হায়া বর্তমান। অন্যদিকে ধর্মীয় চেতনায় জনকল্যাণের পরিসরে হিতবাদী আদর্শের ছায়া কায়ারূপ লাভ করে। সেখানে আধুনিকতার সোপানে ধর্মীয় আদর্শবোধে শ্রীরামকৃষ্ণের শিবজ্ঞানে জীবসেবায় ‘নর রূপে নারায়ণ’-এর চেতনা যেমন সক্রিয় হয়ে ওঠে, তেমনই স্বামী বিবেকানন্দের মাধ্যমে ‘বহুজনহিতায় চ, বহুজনসুখায় চ’-এর আদর্শ আবেদনক্ষম মনে হয় । সেক্ষেত্রে দেশ বা জাতিগঠনে সেবার মানবিক অভিমুখটি শুধু জনসেবার বার্তাতেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েনি, জনসেবক তৈরিতেও সক্রিয়তা লাভ করে। স্বামী বিবেকানন্দের মানুষ গড়ার লক্ষা (‘Man making is my mission’) সেপথে ধারিত হয়েছিল। সেদিক থেকে পরাধীন দেশে সেবার উৎকর্ষে শিক্ষার সোপানটি ধর্মীয় পরিসরে নবদিগন্তের সূচনা করে । আশ্রম-মঠের আধ্যাত্মিক শিক্ষার সঙ্গে আধুনিক শিক্ষা সংযোগসাধনের মাধ্যমে শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের আদর্শে সেবার পরিসর শুধু বিস্তার লাভ করেনি, সেইসঙ্গে তার প্রতিষ্ঠা হয়েছে উৎকর্ষমুখর। দেশ বা জাতিগঠনে স্বামীজির সেই আদর্শ জনসেবা থেকে দেশসেবার সোপানে উন্নীত হয়। তাঁর আকস্মিক প্রয়াণের (১৯০২) পর পরাধীন দেশে স্বাধীনতা আন্দোলনের সক্রিয়তায় ধর্মীয় চেতনার পরিসরটি নানাভাবে বিকাশ লাভ করে। সেখানে দেশমাতার মুক্তিসাধনে একহাতে গীতা অন্য হাতে বোমা নেওয়ার বিষয়টি ধর্মীয় আবর্তে আবেদনক্ষম হয়ে ওঠে। দেশোদ্ধারের ব্রতই সেক্ষেত্রে দেশসেবার আনুকূল্যে ধর্মীয় সংগঠনের প্রশ্রয় পাওয়াটা স্বাভাবিক মনে হয়। সেদিক থেকে স্বামী বিবেকানন্দের পরবর্তী পরিসরে স্বামী প্রণবানন্দের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা হিন্দু সংগঠনের জাতিগঠনের দায়ে যেমন ত্যাগ ও সেবার আদর্শে ধর্মীয় সংস্কারের প্রয়াস সক্রিয় হয়ে ওঠে, তেমনই দেশোদ্ধারে সক্রিয় বিপ্লবীদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়াও স্বাভাবিকতা লাভ করে । আপাতভাবে ধর্মীয় বাতাবরণের মধ্যে এরূপ সংগঠনের সক্রিয়তা প্রতীয়মান হলেও তার সেবামূলক কর্মতৎপরতা বিশেষভাবে উল্লেখনীয়। শুধু তাই নয়, এরূপ সংগঠনের মাধ্যমে শুধু ধর্মীয়

চেতনার বিস্তারই ঘটেনি, সেইসঙ্গে মানবসেবার নবধারাও বিকশিত হয় । সেক্ষেত্রে স্বামী প্রণবানন্দ মহারাজের গড়ে তোলা সঙ্ঘের (১৯২৩-এ প্রতিষ্ঠিত ‘ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ’) কর্মধারা শুধুমাত্র ধর্মীয় বৃত্তে আবর্তিত হয়নি, দেশ বা জাতিগঠনে সফলকাম উদ্যোগে সামিল হয়েছিল।