• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির প্রাথমিকতা ছিল পরিবেশ রক্ষা ও এ বিষয়ে সচেতনতা

তাপস চট্টোপাধ্যায় গীতার ৩/১৯-এ উল্লেখ আছে, ‘অন্নাদ ভবন্তি ভূতানি পর্জন্যাদন্নসম্ভবঃ / যজ্ঞাদ্ ভবতি পর্জন্যো যজ্ঞ কর্মসমুদ্ভবঃ৷’ অর্থাৎ প্রাণিসকল অন্ন হইতে উৎপন্ন হয়, মেঘ হইতে অন্ন জন্মে, কর্ম হইতে যজ্ঞের উৎপত্তি, কর্ম বেদ হইতে উৎপন্ন জানিও৷ পরিবেশ রক্ষা এবং পরিবেশ সচেতনতা এখন আর শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তকের সূচিতে নয়, বরং আধুনিক সভ্যতার টিকে থাকার বিষয়বস্ত্ত হয়ে উঠেছে৷ বিশ্বজুড়ে

তাপস চট্টোপাধ্যায়

গীতার ৩/১৯-এ উল্লেখ আছে, ‘অন্নাদ ভবন্তি ভূতানি পর্জন্যাদন্নসম্ভবঃ / যজ্ঞাদ্ ভবতি পর্জন্যো যজ্ঞ কর্মসমুদ্ভবঃ৷’ অর্থাৎ প্রাণিসকল অন্ন হইতে উৎপন্ন হয়, মেঘ হইতে অন্ন জন্মে, কর্ম হইতে যজ্ঞের উৎপত্তি, কর্ম বেদ হইতে উৎপন্ন জানিও৷

পরিবেশ রক্ষা এবং পরিবেশ সচেতনতা এখন আর শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তকের সূচিতে নয়, বরং আধুনিক সভ্যতার টিকে থাকার বিষয়বস্ত্ত হয়ে উঠেছে৷ বিশ্বজুড়ে বাজার অর্থনীতির অন্ধগতিতে পথ হারিয়ে, চাহিদা আর জোগানের টানাপোড়েনে ক্লান্ত ভারতবাসী ভুলতে বসেছে তার প্রাচীন ঐতিহ্যগত নৈতিকতাকে৷
‘পরিয়াবরণম’ (paryavaranam) হাজারো বছর আগে প্রাচীন ভারতের এই সংস্কৃত শব্দের মূল আঙ্গিক ছিল পরিবেশ রক্ষা৷ ভারতীয় সভ্যতার মূল আধার ছিল মানুষ এবং পরিবেশের সুষ্ঠু এবং স্থায়ী সন্তোলন৷ বিশ্বাস ছিল, জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে, সৌরমণ্ডলের গ্রহ-গ্রহান্তরে অহরহ আকর্ষণ-বিকর্ষণ, বিকিরণ, প্রতিফলন, সবকিছুই ঈশ্বর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত৷ সেই কারণেই জীবজগতের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদেই প্রাচীন ভারতে পরিবেশ এবং ঈশ্বরকে একাসনে বসানো হতো৷

ঐতিহাসিকদের মতে ভারতীয় ভূখণ্ডে পরিবেশ সচেতনতার ঐতিহ্য বৈদিক যুগের অনেক আগেই৷ প্রায় ৫০০০ বছর আগে উত্তর ভারতের সিন্ধু নদের অববাাহিকায় প্রায় ২৮৮০ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে উঠেছিল সিন্ধু সভ্যতা৷ বিশ্বের ইতিহাসে ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম ভাগে গড়ে ওঠা এই সভ্যতাকেই প্রথম ভারতীয় সভ্যতা হিসাবে গণ্য করা হতো৷ বিস্তীর্ণ সেই জনপদে বসবাসকারী অধিবাসীদের জীবনযাত্রায় নির্ণায়ক ভূমিকায় ছিল সঠিক বাস্ত্ততন্ত্র এবং পরিবেশবান্ধব সহাবস্থান৷ ঐতিহাসিকদের মতে, বিশ্বজুড়ে যখন একাধিক সভ্যতার পত্তনে মানুষ রাজপ্রাসাদ, মিনার অথবা সুউচ্চ মন্দির নির্মাণে ব্যস্ত তখনই সিন্ধু প্রদেশের অধিবাসীদের মনোযোগ ছিল নিজেদের বাসস্থানকে উন্নতমানের বসবাসযোগ্য হিসেবে গড়ে তোলা৷

পরবর্তীকালে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে হরপ্পা এবং মহেঞ্জদাড়োর মতো দু’টি প্রাচীন সভ্যতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে আবিষ্কৃত হয় একাধিক উন্নতমানের জীবনশৈলীর অজস্র নিদর্শন৷ যথেষ্ট আলোবাতাস যুক্ত ঘর, প্রশস্ত পথ, পর্যাপ্ত কূপ এবং জলাধার, স্নানঘর, সার্বজনীন স্নানঘর, ভূগর্ভস্থ ঢাকা নিকাশি ব্যবস্থা, সুরক্ষিত শস্য ভফাণ্ডার, পরিবেশ রক্ষা এবং পরিচ্ছন্নতা বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধির উক্তি সম্বলিত একাধিক ফলক, এমন অনেক নিদর্শন যা আজও আধুনিক ভারতবাসীর কাছে যতটা বিস্ময়কর ততটাই বোধহয় প্রাসঙ্গিক৷ হরপ্পার নদীমাতৃক এই সভ্যতা শুধুমাত্রএতটুকুতেই থেমে থাকেনি, বিস্তীর্ণ এই জলপথকে পরিবহণ এবং বাণিজ্যের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে গুজরাতের লোথালে পেশাদারি দক্ষতায় গড়ে উঠেছিল বিশ্বে প্রথম টাইডাল ডকইয়ার্ড (জোয়ার নির্ভর জাহাজ মেরামতি কেন্দ্র)৷ প্রাচীন ভারতের অর্থশাস্ত্রের মতে জল হল সার্বজনীন সম্পত্তি, ব্যক্তিগত মালিকানাধীন নয়৷ তেমনই হরপ্পা সংস্কৃতিরও প্রাথমিকতা ছিল জল সংলরক্ষণের মাধ্যমে তাকে সেচযোগ্য করা৷ প্রত্নতাত্ত্বিক খননের পরবর্তী সময়ে গুজরাতের ধোলাভীরায় মাটির নীচে আাবিষ্কৃত হয় বিশাল আকারের জলাধারএবং উন্নতমানের প্রযুক্তির মাধ্যমে তাকে সেচযোগ্য করার অভূতপূর্ব প্রয়াস৷ ১৮০ সি.ই.-র কাছাকাছি সময়ে চোল রাজা কারিকালা নর্দমা নদীর ওপর যে বিশাল বাঁধ নির্মাণ করেছিলেন তার দ্বারা নদীর মূল ধারা সামান্যতম ব্যাহত হয়নি বরং প্রায় ৩০ হাজার হেক্টর চাষযোগ্য জমিকে সেচযোগ্য করা সম্ভব হয়েছিল৷

আর্য সভ্যতার মুখ্য ধারায় বাস্ত্তজ্ঞানবিষয়ক সচেতনতা ছিল এক উর্বর সভ্যতার সর্বাত্মক বিকাশ৷ সংস্কৃত শব্দ ‘অরণ্যানী অর্থাৎ অরণ্যের রাণী’, আর্যসভ্যতায় যাঁকে দেবী হিসেবে চিহ্নিত করা হতো৷ বৈদিক পর্যালোচনায় বারংবার অরণ্যানী মহিমান্বিত করে কখনও বলা হয়েছে শক্তির উৎস, আবার কখনও উদ্ভিজ্জ এবং প্রাণীজগতের পরিত্রাতা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে৷

ঋকবেদে বৃক্ষকে ‘বনস্পতি’ হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়েছে৷ বলা হয়েছে, ‘হাজারও শাখা-প্রশাখায় অরণ্যের এই বৃক্ষরাজকে পূজা করলে সমগ্র সৃষ্টির পূজা সাধিত হয়৷’ সেই কারণেই হিন্দু শাস্ত্রে যে কোনও পূজাপার্বণ অথবা ধর্মীয় আচার আচরণের মুখ্য উপাচারে থাকে বৃক্ষ৷

বৃক্ষ শুধুমাত্র হিন্দুদের আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের আঙ্গিক ছিল না, একাধিক ধর্মীয় আচার-আচরণে বিস্তৃত ছিল৷ বটবক্ষক্ষকে কল্পতরু হিসাবে মান্যতা দেওয়া হতো, অনেক রাজ্যে নারকেল গাছকেও কল্পতরু হিসেবে দেখা হত৷ ডুমুর গাছকে ব্রহ্মার বাসস্থান হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়৷ আদিবাসী এবং জনজাতি অধু্যষিত অঞ্চলে মহুয়া গাছ, মরুভূমিতে শামি গাছ, উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলে চিউর গাছ, উত্তরাখণ্ডের যোশিমঠে তুঁত গাছ, এমন অনেক গাছকে স্থানীয় বাসিন্দারা কল্পতরু হিসাবে মান্যতা দিয়ে থাকেন৷

অথর্ববেদ মুখ্যত ওষধি বিষয়ক জ্ঞান সমন্বিত বিধান দ্বারা পুষ্ট, যেখানে রোগ নিরাময়ের যাবতীয় ভেষজের উৎস হল প্রকৃতি৷ এই বেদে প্রধানত পাঁচটি উদ্ভিদ, গাঁজা, তুলসী, চন্দন, জুঁই এবং নিমকে রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে অপরিহার্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে৷ এছাড়াও অথর্ব বেদে আরও বহু উদ্ভিদজাত ফল, ফুল, পাতা, গাছের ছাল, কাণ্ড শিকড়ের অজস্র গুণাগুণের বর্ণনা আছে৷

প্রকৃতি এবং পরিবেশের উপযোগিতা শুধুমাত্র বৈদিক আচার-আচরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, সে যুগে সুশাসন এবং রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রেও পরিবেশবান্ধব ভাবনাচিন্তা অর্থনীতির আঙ্গিক হয়ে উঠেছিল৷ অর্থশাস্ত্রে কৌটিল্যের পরামর্শ ছিল ‘অভয়ারণ্য বা অভয়াবন’ নির্মাণের পক্ষে৷ যেখানে বৃক্ষ এবং পশুরা নির্ভয়ে বিচরণ করতে পারে৷ এই অঞ্চলের যাবতীয় দায়িত্বভার থাকবে বনঅধিক্ষকের দায়িত্বে৷ এমনকি অভয়ারণ্যের বৃক্ষ এবং পশুপাখিদের যে কোনও ক্ষতিসাধনের জন্য কঠোর সাজারও সংস্থান ছিল৷
যজুর্বেদের ৬/২২-এ আছে, ‘ওওম মাপো মৌষধীর্হংসীর্ধাম্নো ধাম্নো রাজোঁস্তুতো বরুণ নো মুঞ৷ / যদাহুরঘ্নাংইয়ি বরুণেতি শপামহে ততো বরুণ নো মুঞ৷ / সুমিত্রিয়া ন আপ ওষধয়ঃ সনতু দুর্মিত্রিয়াস্তস্মৌ সনতু যৌস্নান দ্বেষ্টি যং চ বয়ং দ্বিষ্মঃ৷৷’ অর্থাৎ, হে প্রজাগণের প্রতিপালক, জলকে কখনও দূষিত করো না, বৃক্ষ এবং বনভূমি কখনও ধ্বংস করো না৷ পানীয় এবং পুষ্টিবর্ধক উপাদানসমূহ সর্বদা সর্বত্র সহজলভ্য হউক৷ হে ন্যায়ের প্রতিপালক! পানীয়, বৃক্ষ এবং বনভূমি এবং গাভীসমূহ পবিত্র৷ তাহাদেরকে নষ্ট করো না৷ আমরা সকলে ইহাতে কৃত সংকল্প হইতেছি, তুমিও সেইরূপ হও৷ তোমার অনুগ্রহে পানীয় এবং বৃক্ষসমূহ আমাদের মিত্রের ন্যায় সুখদায়ক হউক৷ কিন্ত্ত যাহারা আমাদের উপর আঘাত হানে এবং আমাদের পবিত্রতাকে বিনষ্ট করে সেই সকল শত্রুদের নিকট বৃক্ষ এবং জল শত্রুবৎ প্রকটিত হউক৷

প্রাচীন ভারত সামাজিক, অর্থনৈতিকভাবে সম্পূর্ণরূপে ছিল কৃষিনির্ভর, ফলে স্বভাবতই দৈনন্দিন জীবনযাপনের মূল ধারায় যুক্ত হয়েছিল প্রকৃতি এবং পরিবেশের সাথে গভীর একাত্মতা৷ জীবন-জীবিকার সুরক্ষা এবং উন্নতমানের জীবনযাত্রার পক্ষে প্রকৃতি এবং পরিবেশের যাবতীয় অনুসঙ্গ একসময় আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের অঙ্গ হয়ে উঠেছিল৷ প্রাকৃতিক আইন (বৎসায়ন ১৯৯৫:২২৭)-এর অঙ্গ হিসেবে বিশেষ বৃক্ষ এবং উদ্ভিজ্জ যেমন, বট, অশ্বত্থ, বেল, নিম, শাল, কলাগাছ ইত্যাদি ঈশ্বরিক আরাধনার মূল উপাদান হয়ে ওঠে৷ পাহাড়-পর্বত থেকে নদ-নদী, উপনদীকে দেবদেবীর রূপ হিসাবে বিবেচিত হয়৷ সিন্ধু, গঙ্গা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, নর্দমা, তাপ্তি, গোদাবরী, কৃষ্ণা কাবেরী, এমন একাধিক নদী হিন্দুদের কাছে দেবীর মর্যাদায় পূজিত হয়৷ মহাভারতে ‘গিরি গোবর্ধন’-এর উল্লেখ অথবা উত্তর-পূর্ব ভারতের বিস্তৃত হিমালয় পর্বতমালায় অবস্থিত কৈলাশকে স্বয়ং মহাদেব এবং তাঁর পরিবারের বাসস্থান হিসাবে কল্পনা করা হয়৷

প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার সেই মূল আঙ্গিক পরিবেশ সচেতনতা আজকের প্রজন্মের কাছে ভাবনার বিষয়বস্ত্ত নয়৷ অরণ্যনিধনে ব্যস্ত আধুনিক সভ্যতা নগরায়ন পত্তনে ব্যস্ত৷ একদিকে বৃক্ষ কেটে জলাশয় বুজিয়ে তৈরি হচ্ছে আকাশছোঁয়া বহুতল, অন্যদিকে তারই ব্যালকনি আর ড্রইংরুমে প্লাস্টিকের টবে চলছে বৃক্ষরোপণ৷ বনাঞ্চল এখন পরিবেশের অঙ্গ নয় বরং অর্থনীতির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ বিপন্ন সভ্যতার গলায় কবিগুরুর আর্তনাদ, হে নবসভ্যতা, হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী, / দাও সেই তপোবন পুণ্যাচ্ছায়ারাশি…৷’