রুণা চৌধুরী (রায়)
প্রায় ছোটবেলায় ভারত স্কাউটস অ্যান্ড গাইডের তরফ থেকে প্রথম দার্জিলিং যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল৷ তখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী৷ শিয়ালদা স্টেশন থেকে সকাল ন’টায় ট্রেনে চড়ে প্রায় দশ ঘণ্টার জার্নির পর সুন্দরী হিলঘাট থেকে স্টিমারে চড়ে আধঘণ্টা গঙ্গার সৌন্দর্য দেখতে দেখতে রামপুরহাট ঘাটে উপনীত হলাম৷ ওখান থেকে এক্সপ্রেস ট্রেনে এক রাতের অ্যাডভেঞ্চারপূর্ণ জার্নির পর শিলিগুড়ি নামতেই রিজার্ভেশনে গিয়ে বসলাম গয়াবাড়ির উদ্দেশ্যে৷ এই এক্সপ্রেস ট্রেনে চারজন ডাকাতের পাল্লায় আমাদের পড়তে হয়েছিল৷ কম্পার্টমেন্টের দরজাটা ভাঙা ছিল৷ আামরা নিজেদের সু্যটকেশ, হ্যান্ডল দিয়ে ভিতর থেকে বন্ধ করে ঠাকুরের নাম জপতে জপতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম৷ আমাদের গাইডের টিচার অর্চনা দিদিমণি আর আমার দিদির পরাক্রমে ওই ডাকাতদের দল বিধ্বস্ত হয়৷ ওরা দরজায় ধাক্কা মেরে বারেবারে খুলতে বলছিল৷ নীচে গঙ্গার স্রোত বয়ে যাচ্ছে, ওদের হাতেও ছোরা ছিল৷ কিন্ত্ত অসীম স্পর্ধা আমার দিদিও পিছুপা হয় না৷ কিছুদূরে গিয়ে অন্ধকার নির্জন এক স্থানে ট্রেন দাঁড়িয়ে পড়ল আর সেই অবসরে ডাকাতের দল ছুটে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল৷ ট্রেনের গার্ডরা, ইনচার্জ, অফিসাররা সব ছুটে এসে অর্চনাদির কাছে বৃত্তান্ত শুনে মেকানিক দিয়ে দরজার পাল্লাটি রিপেয়ার করে আমাদের আশ্বস্ত করে চলে গেলেন৷ আমরা ছোট ছোট গাইড, বুলবুলেরা যেন থরথর করে কাঁপছিলাম৷ সে যাত্রা ভগবানের কৃপায় বেঁচে গেলাম৷ শিলিগুড়ি থেকে রিজার্ভেশনে আমাদের নিয়ে ছুটে চলল উঁচু পাহাড়ের শৈলশিখরে৷ এমএলএ ইলা পাল চৌধুরির বাংলোতে যেখানে আমাদের একশ দিনের ক্যাম্প বসেছিল৷ একদিন নীল রংয়ের ছোট ছোট টয়ট্রেনে চড়ে দার্জিলিং ঘুরে এলাম৷ অাঁকাবাঁকা সর্পিল পথ কেটে দু’ধারের পাহাড়ের সৌন্দর্যাবলী দেখতে দেখতে টয়ট্রেন দার্জিলিং স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে একসময় অদৃশ্য হয়ে গেল৷ ম্যালের চত্বরে ঘুরে বেড়ালাম৷ স্টেশনে পাশে নেপালি কাঞ্চীদের থেকে পাথরের মালা, আংটির পাথর, দার্জিলিং স্টোন সামান্য কেনাকাটা করলাম৷ ফেরার পথে টয়ট্রেনে ফিরলাম৷
প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলায় ক্যাম্পফায়ারে নাচ, গান,কবিতা পাঠ করে একেবারে ডিনার সেরে নীচে নামতাম আমাদের বাংলোতে৷ টিচাররা ওপরের বাংলোতে থাকতেন৷ আমার দিদির হাতে ফাইভ ব্যাটারির টর্চ দেওয়া হয়েছিল সবাইকে গাইড করার উদ্দেশ্য্যে৷
একদিন সদলে পাহাড়ের সিঁড়ির ধাপ বেয়ে গীদ্দাপাহাড়ের উচ্চশিখরে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর দাদা ব্যারিস্টার শরৎ বোসের সাদা কাঁচে ঘেরা বাংলোটি পরিক্রমা করে মন জুড়িয়ে গেল৷ রঙিন ফুলের কেয়ারীতে সবুজবনানীর সমারোহে দুধসাদা বাংলাটি দূর থেকেই দৃষ্টি কাড়ে৷ অতি সন্তর্পণে পাহাড়ের কার্নিশ বেয়ে নীচে নামতে থাকি, এরপর জাপানিস প্যাগোডা, বুদ্ধমন্দির, দিগন্ত বিস্তৃর্ণ টী-গার্ডেন, সিপাহী ঝোরা, পাগলা ঝোড়া, মন তৃপ্তিতে ভরে যায়৷ ‘ঝোরা’- অর্থাৎ ঝরনা৷ খরস্রোতা ঝরণা সেপি ফোয়ারা, জলের দাপটে সব ধুলিসাৎ হয়ে যাবে মনে হল৷ শুনলাম, বাঘ কখনও এসব ঝরনায় এসে জল খায়৷ এক পাহাড়ে দাঁড়িয়ে অদূরের পাহাড়ের এই নৈসর্গিক গাম্ভীর্য দেখলে গা শিউরে ওঠে৷
এরপরও আরও দু’বার দার্জিলিং যাবার সুযোগ ঘটে৷ সেবার আমার মেয়ে এবং দিদি সঙ্গে ছিল৷ দার্জিলিং স্টেশনের পাদদেশেই স্নো ভিউ হোটেলের অতিথি হয়ে রঙিন কাঠের সিড়ি বেয়ে দোতলার একটা রুমে প্রবেশ করি৷ সেই রাত্রে এই হোটেলের ডাইনিং রুমে বাঙালি কায়দাকে ডিনার সারি৷ ভোর হতেই হোটেলের সংলগ্ন ব্যালকনির পাশে দাঁড়িয়ে টাইগার হিলের অবর্ণনীয় সৌন্দর্যের মাঝে সূর্যোদয় দেখে পুলকিত হয়েছি৷ বিস্তৃত টি-গার্ডেন স্থানীয় নেপালিদের পোশাক পরে অনেক ফটো ক্যামেরা বন্দি করে নিই৷ আমার মেয়ের উৎসাহ, আনন্দ আমাকে মাধুর্যে ভরিয়ে দিল৷ দু’দিন দার্জিলিংয়ের অনাবিল সৌন্দর্যকে মগ্ন রূপে পান করে জিপ ভাড়া করে ছুটলাম গ্যাংটক অভিমুখে৷ এবড়ো খেবড়ো রাস্তা পেড়িয়ে নীচে সমানতালে তিস্তানদীর র্যাট রেস দেখার মতো৷ সবুজ বনানীর ঘেরাটোপে পাহাড়ের আস্তরণ ভেদ করে গ্যাংটকে যাবার সময় মিলিাটরিদের ক্যাম্প, দেবদেবীর সুন্দর সব মন্দির দৃষ্টিগোচর হল৷ নেপালিদের সরাইখানায় গরম দার্জিলিং টি, চাউমিন খেয়ে ভাড়া করা গামবুট, গ্লাভস, টুপি পরে ছাঙ্গু লেকের পাশে উপনীত হলাম৷ বিশাল হ্রদ বরফে আচ্ছন্ন৷ পাশ দিয়ে উঠে গেছে বিশাল ছাঙ্গু পাহাড়ে, যা সম্পূর্ণ বরফাবৃত৷ লাচেন দিয়ে অপেক্ষামনে ইয়াক অর্থাৎ চমরী গাইতে চড়ে পাহানের কোলে থেকে ওপরে ক্রমে উঠতে লাগলাম৷ অতিকষ্টে বারংবার ফিসলে যাওয়ার আচম্ভিকতাকে কাটিয়ে বরফ হাতড়ে হাতড়ে পাহাড়ের মধ্যস্থলে গিয়ে এই বরফের মধ্যে বসেই হাঁফিয়ে উঠলাম৷ এই বরফলী ঠান্ডার মধ্যে একে অন্যকে বরফ ছুঁড়ে মারার কোনও ঘামতি ছিল না৷ মনের ভাবাবেগ পিচনে ফেলে অতি সন্তর্পণে পাহাড় থেকে নেমে পূর্ব নির্দিষ্ট হোটেলে ফ্রেশ হয়ে স্ন্যাকস, চা খেলাম৷ পরের দিন ভোর ৪টার সময় হোটেলের গ্যালারি থেকে হিমালয়ের কাঞ্চনজঙ্ঘার শিখরের ধবল চূড়ার দর্শনে জীবনধন্য হয়ে গেল৷ রুপোলি আলোয় ঝলমলে হিমালয়ের শ্বেতশুভ্র প্রাকৃতিক অনাবিল সৌন্দর্য অবর্ণনীয়৷ কত সুখদুঃখের সংমিস্রিত ইতিহাসের সাক্ষ্য৷ হিমালয়ের কিঞ্চিৎ দর্শনে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠি৷ ধন্য এডমন্ড হিলারী, তেনজিং নোরগে এবং আরও অনেকে যাঁরা পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গে ‘এভারেস্টে’ স্বদেশের পতাকা উত্তোলন করেছেন৷ ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’ গানের কলি গুনগুনিয়ে সেদিনই শিলিগুড়ি যাত্রা করলাম কলকাতা ফেরার উদ্দেশ্যে৷
যাতায়াত ব্যবস্থা: ধর্মতলা টু্যরিস্ট বাস গুমটি থেকে ভিডিও কোচ লাক্সারি বাসে আট ঘণ্টা জার্নির পর শিলিগুড়ি স্টেশনে পৌঁছনো৷ ওখান থেকে ট্যাক্সি, বাসত জিব, প্রাইভেট গানির ব্যবস্থা আছে দার্জিলিং পর্যন্ত৷ ভাড়া ন্যায্য এবং ফিক্সডই থাকে৷ দার্জিলিংয়ে ছোট-বড় হোটেল, টু্যরিস্ট লজ, গেস্ট হাউস সুলভে পাওয়া যায়, যদিও গরমের সিজনে পর্যটকদের ভিড় বলাই বাহুল্য৷ সাইট সিইং দেখার জন্যও যানবাহন মুখিয়ে থাকে৷ গ্যাংটকে যাবার জন্যও সঠিক মূল্যে গাড়ি, জিপ ভাড়া পাওয়া যায়৷ দূরদূরান্ত থেকে পর্যটকরা প্রায় সারা মাসই ভিড় জমায় এই বিখ্যাত শৈলশহরটি পরিদর্শনের জন্য৷