• facebook
  • twitter
Thursday, 19 September, 2024

জয় হলো গণতন্ত্রের, শেষ কথা বলল মানুষ

স্নেহাশিস সুর জয় হলো গণতন্ত্রের, শেষ কথা বলল মানুষ৷ এবারের ভোটের ফল দেখে এই কথাটাই সবচেয়ে আগে বলতে হয়৷ নির্বাচনে ভোট সমীক্ষাই যে শেষ কথা বলে না তা আবার প্রমাণিত হল৷ অতীতেও ভোট সমীক্ষা, সে ভোটের আগেই হোক আর বুথ ফেরত সমীক্ষাই হোক, বহুবার ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে৷ এবারেও তাই হলো৷ সারা দেশে ভারতীয় জনতা

স্নেহাশিস সুর

জয় হলো গণতন্ত্রের, শেষ কথা বলল মানুষ৷ এবারের ভোটের ফল দেখে এই কথাটাই সবচেয়ে আগে বলতে হয়৷ নির্বাচনে ভোট সমীক্ষাই যে শেষ কথা বলে না তা আবার প্রমাণিত হল৷ অতীতেও ভোট সমীক্ষা, সে ভোটের আগেই হোক আর বুথ ফেরত সমীক্ষাই হোক, বহুবার ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে৷ এবারেও তাই হলো৷ সারা দেশে ভারতীয় জনতা পার্টির পক্ষে ব্যাপক হাওয়া আছে বলে ঐদল চারদিক জুড়ে যে তুমুল প্রচার করেছিল, বাস্তবে ভোটের ফলে তা কিন্ত্ত দেখা গেল না৷ সে সারা দেশেই হোক আর পশ্চিমবঙ্গেই হোক৷

‘এইবার চারশ পার’ প্রধানমন্ত্রীর এই আহ্বান, বাস্তবে কোনভাবেই কাজ করল না৷ বিজেপির আসন আগের বারের চেয়ে বেশ কমল৷ তার লড়াইটা শেষে গিয়ে দাঁড়ালো মূলতঃ ম্যাজিক সংখ্যা ২৭২ পেরনোর ৷ এটা বিজেপি ভাবতেও পারেনি৷ এমনকি নির্বাচনের পরে প্রকাশিত একাধিক ভোট সমীক্ষার অঙ্ক তো বিজেপির ঝোলায় প্রাণভরে আসন দিয়েছিল৷ রাম মন্দির নির্মাণ ভারতীয় জনতা পার্টিকে ভোটে বাড়তি সুবিধা দিতে ব্যর্থ হলো৷ এটা নির্বাচনের আগেই কিছুটা বোঝা গেছিল, সেই অনুমান ভোটে বাস্তবের রূপ পেল৷ যে কেন্দ্রে অযোধ্যা অবস্থিত, সেই ফৈজাবাদ লোকসভা কেন্দ্রেও বিজেপির ফল আশানরূপ নয়৷তাছাড়া সংখ্যার জোরে শাসক দলের লাগামহীন একাধিপত্য, যার ফলে যে কোনও আইন পাশ করিয়ে নেওয়া – তা জনগণের পক্ষেই হোক আর বিপক্ষেই হোক, যে কোনও নীতি-নিয়ম জোর করে কার্যকর করা তা মানুষ মেনে নেয়নি৷ প্রতিবাদ করেছে ধর্মীয় মেরুকরণের যে কোনও প্রচেষ্টার৷

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নিজের ব্যক্তিত্ব বা ক্যারিশমার ওপর বিজেপি বরাবরই জোর দিয়েছে৷ কেন্দ্রে বিজেপি সরকার নয়, এনডিএ সরকার নয়, সে পরিচিত হয়েছে মোদি সরকার হিসেবে৷ আর কেউ নয় নরেন্দ্র মোদি আর অমিত শাহই হয়ে উঠেছেন বিজেপির একমাত্র মুখ৷ আর মোদিজির কথাবার্তা, আচার আচরণ, পোষাক আসাক সবকিছুরই একটা প্রভাব বা আবেদন রয়েছে৷ এবার সেই প্রভাব কতটা ইতিবাচক বা সদর্থক হয়েছে নাকি তা জনগনের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে তার বিশ্লেশণ হবে ভোটের ফলেই৷ মোদি পশ্চিমবঙ্গে কুড়িটির মত রাজনৈতিক সভা করেছেন, করেছেন রোড শো ৷ কিন্ত্ত তাতেও বিজেপি বাংলার নিজস্ব দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারেনি৷ তাছাড়া এই রাজ্যে বিজেপির নেতৃত্বের বিভাজন সুস্পস্ট৷ নেতৃত্বের ভরকেন্দ্রের একদিকে রজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার, অন্যদিকে প্রক্তন সভাপতি দিলীপ ঘোষ এবং অপর দিকে বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী৷ এদের সমন্বয়ের অভাব বিজেপির খারাপ ফলের অন্যতম কারণ৷ অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী , অমিত শাহকে এনে জনসভায় বক্তব্য রাখালেও বুথ পর্যায়ে সংগঠন সুদৃঢ় করতে দল কার্যত ব্যর্থ হয়েছে৷ দলীয় প্রার্থী বাছার ক্ষেত্রে হটকারী সিদ্ধান্তও একটা বড় কথা৷ মেদিনীপুরের প্রার্থী বদল করে ওই আসন এবং সেখানকার সাংসদ দিলীপ ঘোষকে যে আসনে পাঠানো হলো সেই দুটোই হারালো বিজেপি৷

সুইং স্টেট হিসেবে সবচেয়ে আগে উঠে এসেছে উত্তর প্রদেশ৷ এবার সেখানে কংগ্রেস ও অখিলেশ যাদবের নেতৃত্বে ইন্ডিয়া জোট অনেক আসন বিজেপির থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে৷ সমাজবাদী পার্টি লোকসভায় তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে৷ গতবারে ইউপির আসনের জোরেই বিজেপির লোকসভায় এত আসনের সমাহার হয়েছিল৷ এবারে তার অনেকটাই ছিনিয়ে নিয়েছে ইণ্ডিয়া জোট৷ হয়ত বহুজন সমাজবাদী পার্টির ভোটটা ছিনিয়ে নিয়েছে এনডিএ৷ আর যে দুটো রাজ্য এনডিএ’র প্রতি আংশিক মুখ ফিরিয়েছে তার মধ্যে বিহার এবং মহারাষ্ট্র ৷ বিহারে চল্লিশটি আসনের মধ্যে গতবার বিজেপি পেয়েছিল উনচল্লিশটি৷ এবারের চিত্রটি আলাদা৷ নীতীশ কুমারের জোট বদলে করে এনডিএতে যোগ দেবার ফলে বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ বিহারে খারাপ করেছে৷ আসলে বিজেপি চারশ আসনের কথা বললেও কেন জানি না ওরা কিছুতেই একটা হিসেব খেয়াল করেনি যে গতবারেই ওরা সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় আসন পেয়েই ছিল; তার থেকে আসন আর বাড়ানোর সুযোগ বিশেষ কোথাও ছিলই না৷ অন্যদিকে দিল্লিতে ভোট সমীক্ষা মিলে গিয়েয়ে সাতটা আসনের সাতটাই বিজেপি পেল এবং অরবিন্দ কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তার সেখানকার ভোটে কোনও প্রভাব ফেলল না৷ পার্শ্ববর্তী রাজ্য ওডিশায় বিজু জনতা দলে বেশ খারাপ ফল করল৷ সেখানে ২১ আসনে বিজেপি পেল ১৯৷ আর বিধানসভাতে ভোট হয়েছিল ওডিশায়৷ সেখানেও ক্ষমতা হারালো বিজু জনতা দল৷ নিরঙ্কুষ গরিষ্ঠতা অর্জন করল বিজেপি৷

অন্যদিকে কংগ্রেস আগের লোকসভা ভোটে মোট ৫২টি আসন পেয়েছিল, এবার সেটা প্রায় দ্বিগুণ করার চেষ্টা করেছে৷ কংগ্রেস কিন্ত্ত কিছুটা হলেও জমি ফিরে পেল আর সেটা কংগ্রেসের একটা বড় প্রাপ্তি৷ ভবিষ্যতে রাহুল গান্ধি, সোনিয়া গান্ধি, মল্লিকার্জুন খাড়গে, জয়রাম রমেশ, পি চিদাম্বরম কিভাবে নেতৃত্ব দেন সংসদের ভেতরে ও বাইরে, সেটাই বড় কথা৷ ইন্ডিয়া জোটের সর্ববৃহৎ দল হিসেবে জোট সঙ্গীদের নিয়ে কিভাবে এগোতে পারে কংগ্রেস সেটাই এখন দেখার৷ তবে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস দলের যে কী হবে সেটা বলা শক্ত৷ অবশ্য এমনিতেই কিই বা ছিল?

বাম কংগ্রেসের এবারের বক্তব্য ছিল দ্বিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয় তৃতীয় পক্ষ হিসেবে উঠে আসছে বাম কংগ্রেস জোট৷ সিপিআইএম-এর রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম ভোটে দাঁড়ান৷ তাঁর জয়ের সম্ভাবনার কথাও বলা হয়েছিল৷ কিন্ত্ত কার্যত তা হয়নি৷ আসলে বামেদের ভোট জোটসঙ্গী কংগ্রেসের কাছে গেলেও এর উল্টোটা অর্থাৎ কংগ্রেসের ভোট বামে ঠিকমত যায় না, এটা বিগত কয়েকটি ভোটে প্রমাণিত হয়েছে৷ এর কারণ অতীতে বাম কংগ্রেসের রাজনৈতিক বিরোধিতা, যে পরম্পরা এখনও বজায় রয়েছে৷ শুরু থেকেই একটা বিজেপি হাওয়ার প্রচার করা হয়েছিল ওই দলের পক্ষ থেকে৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের উত্তর থেকে দক্ষিণে আলাদা করে ১০৭টির মত সভা বা রোড শো করেছেন৷ অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন৷ ফল হিসেবে সামগ্রিক জয় পেলেন৷ নিজেদের আসন ধরে রাখলেনই শুধু নয় সঙ্গে পরপর অন্যদের জেতা আসন দখল করে নিলেন৷ যার মানে পুনরায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি সার্বিক জনসমর্থন৷ সঙ্গে পরপর দু দুটো ভোট পরিচালনায় বড় ভূমিকা পালন করে দলের ভেতরে সর্বময় নেত্রীর পর সেনাপতির দ্বিতীয় স্থান কার্যত আরও অনেকটাই সুদৃঢ় করলেন দলের সর্ব ভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়৷ ডায়মন্ডহারবার কেন্দ্রে এবার তিনি জিতলেন প্রায় ৭ লক্ষেরও বেশি ভোটে৷ এটা স্বাধীন ভারতের লোকসভা নির্বাচনের সর্বকালীন রেকর্ড৷ ২০১৯ এর নির্বাচনে গুজ্রাটে সি আর পাতিল, ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, এবং ২০০৪ -এ পশ্চিমবঙ্গের আরামবাগে অনিল বসু, এরা সকলেই পাঁচ হাজারেরও বেশি ভোটে জিতে রেকর্ড করেছিলেন৷ অভিষেক এবার সেই সব রেকর্ড ভাঙলেন৷

এবারের ভোটে তৃণমূলের সাফল্যের অন্যতম কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে লক্ষ্মীর ভান্ডার, প্রকল্পকে৷ এই প্রকল্পের সুবিধাভোগীর সংখ্যা ২কোটি ১৮ লক্ষ৷ এছাড়াও আরও অনেক প্রকল্পের সুবিধা সরাসরি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছয়৷ এর একটা প্রতিদান নিশ্চয়ই তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে৷ আর এবার অনেক ক্ষেত্রে পুরুষদের থেকে মহিলা ভোটদাতার সংখ্যা ছিল বেশি৷ আর কোনও পরিবারে পুরুষের ভোট অন্য কোথাও গেলেও মহিলাদের ভোট তৃণমূলেই গেছে বলে ফলাফলে বোঝা যাচ্ছে৷ অর্থনীতিবিদ বা সমাজতাত্বিকরা একে পাইয়ে দেবার রাজনীতি হিসেবে আখ্যা দিয়ে এই নিয়ে চর্চা করলেও বাস্তব হচ্ছে এটাই যে এইসব প্রকল্প ভোট নিশ্চিন্ত করেছে তৃণমূলকে৷ বিগত কয়েকটি পঞ্চায়েত, বিধানসভা, লোকসভা নির্বাচনে দুর্নীতি কোনও নির্ণায়ক হয়নি, এটা এই নির্বাচনেও আবার প্রমাণিত হল৷ সন্দেশখালির ঘটনা ও তা নিয়ে দেশজু্ড়ে বিজেপির প্রচার কার্যত এরাজ্যে ভোটের ফলে কোনই প্রভাব ফেলল না৷ এই কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী আগেও জিতেছিলেন এবারে আরও বেশি ভোট পেলেন৷ এমন কি সন্দেশখালি বিধানসভা এলাকাতেও তৃণমূলই এগিয়ে রইল৷ এর কারণ শুরুর অভিযোগ জোরদার হলেও পরের দিকে নানা বিষয় উঠে আসায় এইরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ তার ধার হারিয়ে ফেলে৷ আর এই কেন্দ্রে আগেও তৃণমূলের অনেক লিড ছিল৷
নির্বাচনে ধর্মীয় বিভাজন এখন স্পষ্ট৷ তা অভিপ্রেত বা অনভিপ্রেত সে পরের কথা৷

তাই ধর্মীয় মেরুকরণের সুবিধা পশ্চিমবঙ্গের মত রাজ্যে যেখানে প্রায় ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘুর বাস, বা অনেক কেন্দ্রে সংখ্যালঘুর উপস্থিতি যেখানে আরও বেশি, সেখানে এরাজ্যে সহজেই তার সুফল তৃণমূল ঘরে তুলতে সক্ষম হয়েছে৷ আর সংখ্যালঘুরা ভোট দেয় অনেক বেশি সংখ্যায় আর তাদের ভোট পড়ে একই দিকে৷ তৃণমুলই যে সংখ্যালঘুদের প্রথম পছন্দের ও আস্থার দল তা তাদের বোঝাতে তৃণমূল সমর্থ হয়েছে এবং তার সুফলও যে পেয়েছে তা ভোটের ফলেই পরিষ্কার৷ অন্যদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভোট এককাট্টা হয় না এবং এবারও তা হয়নি তো বটেই, বরঞ্চ তার বিভাজনই হয়েছে৷ এই আইডেন্টিটি পলিটিক্স-এর বিষয়টি যথেষ্ট ভাবার৷ প্রাথমিক খবর পাওয়া পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে ভোটের শতকরা হারের হিসেবে দেখা যাচ্ছে তৃণমূল ৪৭ শতাংশ, বিজেপি ৩৮ শতাংশ, বাম ৬ এবং কংগ্রেস ৫ শতাংশ ভোট পেয়েছে৷ এই ভোটের এই অনুপাত নিসন্দেহে আগামী ২০২৬-এর বিধানসভার নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের ক্ষমতায় থাকার ক্ষেত্রে একটা বড় ভিত্তি হিসেবে এই ভোটেই আত্মপ্রকাশ করল৷