এতদিন আমরা ভারতের বিদেশনীতির প্রশংসাই করে এসেছি৷ আমেরিকা বা রাশিয়া তো পরের কথা, প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্কের কথা আমরা জানতাম৷ চিন, পাকিস্তানের সঙ্গে অম্লমধুর সম্পর্কের কথা বাদ দিলে শ্রীলঙ্কা, ভুটান, নেপাল ও বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের বন্ধন ছিল অটুট৷ কিন্ত্ত এখন ভারতের বিদেশনীতির ক্ষেত্রে মোদি সরকারের অসংহত, অদক্ষ এবং অনভিজ্ঞ পদক্ষেপের ফলেই নিকট প্রতিবেশী সবগুলি দেশের সঙ্গেই ভারতের সম্পর্ক এবং দেশের সুরক্ষা দুই-ই আজ তলানিতে এসে ঠেকেছে৷ সবচেয়ে খারাপ সম্পর্ক নিকটতম তিন প্রতিবেশী— চিন, নেপাল এবং পাকিস্তানর সঙ্গে যাদের সঙ্গে আমরা সীমানা ভাগ করে নিই৷ আয়তনে ভারতের তুলনায় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র শ্রীলঙ্কা, ভুটান ও মালদ্বীপও আর পাত্তা দিচ্ছে না দিল্লিকে, উল্টে রীতিমতো চোখ রাঙাচ্ছে৷
এমন কেন হল শেষ দশ বছরে? আমাদের দেশের সরকার ও সরকার প্রধান দেশবাসীর সামনে নিজেকে ‘বিশ্বগুরু’ বলে প্রচার করেছেন আর এদিকে বাস্তব পরিস্থিতি অন্য কথা বলছে৷ মোদি তাঁর ক্ষমতায় বসার সময় শপথ গ্রহণের দিন প্রতিবেশী সব রাষ্ট্রপ্রধানকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন৷ ঠিক তার পরেই চিনের প্রেসিডেন্টের ভারত সফরে দেশবাসী ভারত-চিন মৈত্রীর ছবি দেখেছিল৷ দুই দেশের ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের উপকৃত হওয়ার আশা জেগেছিল৷ শি জিনপিং তাঁর গুজরাত সফরে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন দুই দেশের সীমান্ত সমস্যা দূর করতে আলোচনা শুরু হবে, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আরও ঘনিষ্ঠতা বাড়বে৷ কিন্ত্ত মোদির নেতৃত্বে ভারত সেই পথে গেল না, কারণ আমেরিকা৷ গত দু’দশকের পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে সামরিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বেড়ে ওঠা চিন যখন সবচেয়ে শক্তিমান আমেরিকার ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে, তখন উদ্বিগ্ন আমেরিকার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে নতুন কিছু সহযোগী দেশের সাহায্য যারা আমেরিকার শিখণ্ডি হয়ে চিনের মোকাবিলায় সামনের সারিতে থাকতে পারে৷ এক্ষেত্রে আমেরিকার প্রথম এবং প্রধান পছন্দ ভারত৷ বলা ভালো, আমেরিকার আরও বেশি সুবিধা হয়ে গিয়েছে মোদির নেতৃত্বে ভারতে আরএসএস-বিজেপি ক্ষমতায় আসার ফলে৷ উগ্র জাতীয়তাবাদী ও অতি দক্ষিণপন্থী এই শক্তি ভারতকে জনকল্যাণকামী উদার গণতান্ত্রিক দেশ থেকে সামরিক শক্তি নির্ভর আগ্রাসী দেশে রূপান্তরিত করতে চায়৷ মোদি জমানায় তাই ভারতকে সামরিক শক্তিতে শক্তিধর করা অগ্রাধিকার পেয়েছে৷ বিদেশ নীতিতেও গুরুত্ব পেয়েছে সামরিক সম্পর্ক ও লেনদেন এবং সামরিক জোট গঠন৷ বাণিজ্য নীতিতে জোর দেওয়া হয়েছে সামরিক পণ্য আমদানি-রফতানিতে৷
ভারত যে চিনের বিরুদ্ধে কদম ফেলতে ইচ্ছুক, মোদির এই ইচ্ছে বুঝতে কোনও অসুবিধাই হয়নি আমেরিকার৷ তাই পরবর্তী সময়ে চিনকে চাপে ফেলতে গঠন হয়ে গেছে চার দেশের ‘কোয়াড’— আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারত৷ আগে থেকেই জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইনস মার্কিন সহযোগী থাকলেও চিনের মোকাবিলায় তারা যথেষ্ট ছিল না৷ দরকার ছিল ভারতের মতো সম্ভাবনাময় বিকাশমান শক্তির৷ মোদি ক্ষমতায় আসার পর নানা কৌশলে ভারতকে চিনের বিরুদ্ধে তাতিয়ে দু’দেশের সম্পর্ককে তলানিতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে৷ এখন চিন-মার্কিন সম্পর্কের থেকেও চিন-ভারত সম্পর্ক বেশি খারাপ৷ আমেরিকা নির্দেশিত বিদেশনীতির দ্বারা আমরা চিনকে দূরে ঠেলে দিয়েছি৷
এই মুহূর্তে সবচেয়ে হাস্যকর দেশের বিদেশমন্ত্রী ও বিদেশ মন্ত্রকের বক্তব্য, ‘এটাই ভারতের চিরায়ত জোট নিরপেক্ষ নীতি৷’ হাস্যকর এই কারণে যে, জন্ম থেকে ভারত কোনওদিনই পশ্চিমের আমেরিকা-ব্রিটেন-ইজরায়েলের অক্ষের সঙ্গে ছিল না, শেষ দশ বছরে ভারত নিজেকে তাদের ‘স্বাভাবিক মিত্র’ হিসেবে তুলে ধরেছে৷ ১০৫০ সালে ভারত যে জোট নিরপেক্ষতার বিদেশনীতি গ্রহণ করেছিল তা থেকে এখন সম্পূর্ণ সরে এসেছে৷ আসলে আরএসএসের তৈরি করা যে কোনও নীতিই হলো বিভাজনের, সেটা দেশের ভেতরে হোক বা বাইরে৷ তাই আজ শুধু পাকিস্তান নয়, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, মালদ্বীপও ভারতকে সরাসরি না বলে দেয়৷ যে শ্রীলঙ্কা, ভুটান, মালদ্বীপের জন্য ভারত ছাড়া কিছু ছিল না, তারা এখন নির্দিষ্ট দিন ও তারিখ বেঁধে দিয়ে সেখান থেকে ভারতীয় সেনা সরাতে বলে, বন্দর ব্যবহার করার অনুমতি প্রত্যাহার করে, আমদানি ও রফতানির পরিমাণ হ্রাস করে৷ নেপালের মতো ছোট দেশও সীমানা নিয়ে ভারতের সঙ্গে বিবাদ করে৷ একসময়ের পুরোটা ভারত-নির্ভর দেশ ভুটান আজ চিন-নির্ভর হয়ে গেছে৷
এদেশের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, বাইরে বিদেশনীতিরও একই অবস্থা৷ প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করেছে এই মোদি সরকারই৷