মনে পড়ে কি আমায়?
স্নেহাশিস চট্টোপাধ্যায়: এ কী! এত কম উচ্চতা, পায়ে প্লাস্টিকের চটি! এ নাকি মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহামেডানকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে? কাকে ধরে এনেছ তোমরা? বক্তা সৈয়দ নঈমুদ্দিন৷ স্থান কোয়েম্বাটোর৷ আন্ডার টোয়েন্টি ওয়ান ভারতীয় দলের ক্যাম্প৷ টিম ম্যানেজারকে প্রশ্ন নঈমের৷ ম্যানেজার এ. খান বললেন ট্রায়ালে দেখো, পছন্দ না হলে নিও না৷ রাতে একটু ভাত, একটা রুটি আর সব খাবারেই টক৷ দক্ষিণ ভারতীয় প্রথা মেনে৷ রাতে দুধ৷ রাতে এলেন নঈমুদ্দিনও৷ কাল সকালে প্র্যাক্টিস করতে পারবে? এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন পাঁচ ফুট ছ ইঞ্চি উচ্চতার সেই ছেলেটি, গাঙ্গুলীবাগানের নীহার দেব৷ পরের দিন কোয়েম্বাটোরের জঘন্য মাঠে ট্রায়ালে মাত্র পনের কুড়ি মিনিটেই কোচকে এতটাই মুগ্ধ করেন নীহার যে ক্ষত বিক্ষত তাঁকে হোটেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়৷ পরের দিন স্থানীয় এক ক্লাবের সঙ্গে ম্যাচ৷ সে ম্যাচেও অনবদ্য খেললেন নীহার৷ গোল বাঁচালেন অগুনতি৷ তাঁর নিখুঁত থ্রো গেল স্যাভিও মেডিরার কাছে৷ তিনি দিলেন জনকে৷ এবং সেখান থেকে গোল৷
প্লাস্টিকের চটি পরা, পাঁচ ফুট ছ ইঞ্চি উচ্চতার গোলকিপার পাকিস্তান গেলেন, সব ম্যাচ খেললেন সেখানে৷ সেখান থেকে কয়েকমাস পরে সৌদি আরবে মূল টুর্নামেন্ট৷ সেই টিমে তাঁর সঙ্গে সুখেন সেনগুপ্ত, তরুণ নাহা, শ্যামল দাসরাও ছিলেন৷ প্রথম ম্যাচে হারল ভারত৷ গোলে খেলেছিলেন মুস্তাফা বলে একজন৷ দ্বিতীয় ম্যাচে সেই মুস্তাফা প্রথম পাঁচ সাত মিনিটেই গোল খেলেন৷ কোচ নঈম বাধ্য হয়ে নীহারকে নামালেন৷ সঙ্গে তরুণ নাহা এবং সুখেন সেনগুপ্তকেও৷ প্রতিপক্ষ ছিল কাতার৷ তরুণ নাহা সেদিন দেখিয়েছিলেন তিনি কী! নাস্তানাবুদ হয়ে গিয়েছিল কাতার, সেদিন তাঁর স্কিলের কাছে৷ ওই এক গোলেই হারে যদিও ভারত৷
ছোটবেলায় বড়রা ওপরে উঠে খেলতে দিত না তাই গোলকিপিং শুরু তাঁর৷ ক্রিকেটে, মানে পাড়ার ক্রিকেটে করতেন অনবদ্য কিপিং৷ উইকেট কিপার৷ অনবদ্য সব ক্যাচ তুলে নিতেন৷ সেই উইকেট কিপিং দেখেই আজাদগড়ের হরিদা তাঁকে নিয়ে নিলেন৷ আন্ডারহাইট টুর্নামেন্টে হরিদার টিমের তখন খুব নামডাক৷ বুট নেই তাঁর, জেনে বুটও কিনে দিয়েছিলেন হরিদা৷ এবং শুরু হল তাঁর কাছে তালিম৷ আন্ডার হাইট খেলার মেয়াদ ফুরলো একদিন৷ কারণ পাঁচ ফুট পেরিয়ে গেছেন ততদিনে৷ অতএব পাড়ার অরুণাচল সংঘ৷ কোচ দীপুদা৷ অমিত মজুমদার, প্রদীপ দত্ত, শম্ভু মৈত্র — এঁরা উঠে এসেছেন তাঁর হাত দিয়ে৷ সেই দীপুদা৷ সেখানে কিছুদিন খেলার পর দীপুদা পাঠালেন মোহনবাগান জুনিয়র টিমের ট্রায়ালে৷ চান্স পেলেন৷ কিন্ত্ত দীপুদাই খেলতে দিলেন না৷ বললেন, দাঁড়া, সোজা ময়দানেই খেলাব তোকে৷ এর মধ্যেই লক্ষীকান্তপুরে একটা টুর্নামেন্টে অনবদ্য খেলে এলেন নীহার৷ খেলে ফেরার পথে, তখনকার নামকরা প্লেয়ার মানিক বসু জানতে চাইলেন, কোথায় খেলিস তুই? কোথাওই খেলেন না জানতে পেরে তিনিই ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন সেকেন্ড ডিভিশনের সিটি ক্লাবে খেলার৷ সিটির কোচ তখন নির্মল মুখার্জী৷ ট্রায়ালে নীহারকে দেখেই কর্মকর্তাদের বলে সই করালেন নির্মল মুখার্জী৷ সেটা আশি সাল৷ সিনিয়র ডিভিশন বন্ধ আছে তখন অভিশপ্ত ষোলোই আগস্টের কারণে৷ তাই সেকেন্ড ডিভিশনের খেলাও তখন বড় মাঠে হচ্ছে৷ সে বছর সব কটা ম্যাচই খেলেছিলেন৷ গ্রিয়ারের সঙ্গে মোহনবাগান মাঠে ম্যাচটা তার মধ্যে অনবদ্য ছিল৷
একাশি সালে টালিগঞ্জ অগ্রগামী৷ কোচ প্রদীপ দত্ত এবং শঙ্কর ব্যানার্জী৷ একটা ম্যাচেও খেলানো হয়নি তাঁকে৷ তপন দাস আর সুমিত মুখার্জি– ই খেলেছিলেন সব ম্যাচ৷ অতএব পরের বছর তালতলা একতা৷ আঠারোটা ম্যাচ খেলে মাত্র একটা গোল খেয়েছিলেন৷ সেকেন্ড ডিভিশন চ্যাম্পিয়ন হয় একতা৷ ছিয়াশি সালে সিনিয়র ডিভিশনে একতার হয়ে অনবদ্য খেললেন৷ ম্যাচটা এক গোলে হারে ক্লাব কিন্ত্ত নীহারের অকুতোভয় ফুটবল নজর কেড়েছিল৷ এমেকার মাথার উপর থেকে একাধিক বল নামিয়েছিলেন তিনি৷ পরের ম্যাচ বনাম মহামেডান৷ ফরোয়ার্ড লাইন প্রায় অবিশ্বাস্য৷ সাব্বির — জামশিদ — চিমা — প্রদীপ তালুকদার৷ ম্যাচটা ড্র হয়৷ সেদিন গাঙ্গুলীবাগানের নীহার দেবের উপর মনে হয় ফুটবল ঈশ্বর ভর করেছিলেন৷ একটা গোলও দিতে পারেনি সাদা — কালো জামার দল৷ এবং এই ম্যাচটাই তাঁকে ওই আন্ডার টোয়েন্টি ওয়ান ভারতীয় দলে চান্স পাইয়ে দেয়৷
১৯৮৭ তে ইস্টবেঙ্গল৷ কিন্ত্ত নিঃসন্দেহে অভিশপ্ত বছর৷ কারণ সারা বছর মাত্র চার — পাঁচটা ম্যাচ খেলতে পেয়েছিলেন৷ তবে ভাস্কর গাঙ্গুলী তাঁকে অনেক ‘গাইড’ করেছিলেন যে তা আজও ভোলেননি নীহার৷ ইস্টবেঙ্গল থেকে ১৯৮৮ তে মহামেডান৷ কিন্ত্ত দুর্ভাগ্য তাড়া করছিল নীহারকে৷ লিগামেন্ট ছিঁড়ল তাঁর৷ খেলাই হল না তেমন সে বছর৷ ১৯৮৯ এ এরিয়ানে গেলেন৷ মহামেডানকে ড্র করতে বাধ্য করালেন অবিশ্বাস্য সব সেভ করে৷ কিন্ত্ত ইস্টবেঙ্গল ম্যাচে কর্মকর্তারা বললেন সিনিয়র শেখর সাহাকে খেলানো হবে গোলে৷ সে ম্যাচে সিনিয়রকে যোগ্য সম্মান দিয়ে সরে দাঁড়ালেন তিনি৷ ম্যাচটা শূন্য– দুইয়ে হারে এরিয়ান৷ এর পর মোহনবাগান৷ ঘটনাবহুল মোহনবাগান ম্যাচ৷ সুদীপ চ্যাটার্জী, সত্যজিৎ চ্যাটার্জী, অমিত ভদ্র, শিশির ঘোষ, সুব্রত ভট্টাচার্য…. কে নেই সে বছরের মোহনবাগান টিমে? কিন্ত্ত কিছুতেই গোল পাচ্ছে না সবুজ মেরুন৷ একের পর এক সেন্টার শিশির আর সুব্রতর উদ্দেশ্যে কিন্ত্ত রূপক সেদিন পণ করেছেন গোল খাবেন না৷ বল ধরেই পড়ে যাচ্ছেন সময় নষ্টের অছিলায়৷ তিতিবিরক্ত শিশির আর সুব্রত৷
এই সব৷ সময়েই ঘটল ঘটনাটা৷ অলোক মুখার্জী ওয়ান ইজ টু ওয়ানে পেয়ে গেলেন৷ অলোকের শুটিং পাওয়ার জানা ছিল নীহারের৷ অলোককে শট নিতে দেওয়া চলবে না৷ অতএব তিনি ঝাঁপালেন৷ এবং জোরালো সংঘর্ষে অজ্ঞান হয়ে গেলেন৷ তারপর আগুন জ্বললো মাঠে৷ অশান্তির আগুন৷ সুব্রত ভাবলেন সময় নষ্ট করছেন নীহার৷ লাথি চালালেন তিনি৷ প্রদীপ নাগ রেড কার্ড দেখালেন তাঁকে৷ তারপর অশান্তি আরোই বাড়ল৷ ঘোড়সওয়ার পুলিশকে নামতে হল মাঠে৷ কোনোরকমে খেলা শুরু হল৷ প্রদীপ নাগ বেশিক্ষন খেলাচ্ছেন এই অভিযোগে নীহার ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন তাঁকে৷ অতএব রেড কার্ড৷ তার সঙ্গে সাসপেন্ড করা হল তাঁকে এবং সুব্রতকে৷ সঙ্গে জরিমানা৷ অভিশপ্ত সময় নীহার দেবের জন্য৷জরিমানা দেওয়া এবং রেফারির কাছে ক্ষমা চাওয়া দুটোই করেছিলেন নীহার৷ সেই সময় সুভাষ চক্রবর্তী, কমল বসু বা কান্তি গাঙ্গুলীরা পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর৷
এরিয়ান থেকে টালিগঞ্জ৷ সেখান থেকে কুমারটুলি৷ তারপর এফ সি আই৷ কোথাও থিতু হওয়া হয়নি নীহারের৷ শ্যামল ঘোষ নিয়ে গিয়েছিলেন রাজস্থানে৷ সেখান থেকে তালতলা ইনস্টিটিউট৷ সেখান থেকেই ১৯৯৫ এ ময়দান ছাড়ার সিদ্ধান্ত৷ সে বছর তালতলা ইনস্টিটিউট এ দুটি নতুন ছেলে এসেছিল — অর্চিস্মান বিশ্বাস, যিনি এখন ইস্টবেঙ্গল রিজার্ভ টিমের সহকারী কোচ৷ অর্চিস প্রতিষ্ঠাও পান ইস্টার্ন রেল খেলে৷ কিন্ত্ত অন্য ছেলেটি, অমিত মুখার্জী, গোলকিপার, কোথায় যেন হারিয়ে গেল৷ বোধহয় কম উচ্চতার জন্য৷ নিজে না খেলে অমিতকেই খেলাতে বলতেন নীহার৷ নিজের এত দূর পৌঁছনোর জন্য সোমকুমার দেবের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবেন গাঙ্গুলীবাগানের নীহার দেব ওরফে রূপক৷ বিভিন্ন ছোট ক্লাবে চুটিয়ে খেলেছিলেন গোল কিপার সোমকুমার৷ বড় দলেরও অফার ছিল৷ তিনিই হাতে ধরে টেকনিকাল ব্যাপারগুলো শেখান৷
নীহার দেব৷ পাঁচ ফুট ছ ইঞ্চির এক গোলি৷ স্পর্ধায় আকাশ ছুঁতেন৷ অবিশ্বাস্য সব ম্যাচ খেলেছেন৷ ইস্টবেঙ্গল বা মহামেডান — কোথাওই থিতু হওয়া হয়নি৷ কিন্ত্ত তাতে তাঁর প্রতিভায়,তাঁর কৃতিত্বে কোথাও এতটুকু দাগ লাগে না৷ আট আর নয়ের দশকে বড় দলের ঘুম কাড়তেন যেসব গোলকিপাররা নীহার দেব তাঁদের মধ্যে একজন৷