• facebook
  • twitter
Monday, 16 September, 2024

অর্থনীতি এবং জনসংখ্যার দিক থেকে চিন আমেরিকাকে ছুঁতে চলেছে— মানুষ সুখে আছে কি?

পঙ্কজকুমার চট্টোপাধ্যায় অদূর ভবিষ্যতে চিন আমেরিকাকে ছুঁতে চলেছে দুই দিক দিয়ে, অর্থনীতিতে এবং জনসংখ্যায়৷ ২০২৩-এর শেষে আমেরিকার জিডিপি ২৬,৯৫০ বিলিয়ন ডলার আর চিনের সেখানে ১৭,৭০০ বিলিয়ন ডলার (আইএমএফ-এর অনুমান অনুযায়ী)৷ ২০০০ সালে আমেরিকার জিডিপি ছিল ১০,২৫১ বিলিয়ন ডলার আর চিনের ১,২১১বিলিয়ন ডলার৷ চিনের অবিশ্বাস্য দ্রুতগতির বৃদ্ধির থেকে বোঝা যাচ্ছে হয়তো একদিন চিন অর্থনীতিতে আমেরিকাকে ছুঁতে

পঙ্কজকুমার চট্টোপাধ্যায়

অদূর ভবিষ্যতে চিন আমেরিকাকে ছুঁতে চলেছে দুই দিক দিয়ে, অর্থনীতিতে এবং জনসংখ্যায়৷ ২০২৩-এর শেষে আমেরিকার জিডিপি ২৬,৯৫০ বিলিয়ন ডলার আর চিনের সেখানে ১৭,৭০০ বিলিয়ন ডলার (আইএমএফ-এর অনুমান অনুযায়ী)৷ ২০০০ সালে আমেরিকার জিডিপি ছিল ১০,২৫১ বিলিয়ন ডলার আর চিনের ১,২১১বিলিয়ন ডলার৷ চিনের অবিশ্বাস্য দ্রুতগতির বৃদ্ধির থেকে বোঝা যাচ্ছে হয়তো একদিন চিন অর্থনীতিতে আমেরিকাকে ছুঁতে পারে৷

অন্যদিকে চিনের জনসংখ্যা ক্রমাগত কমে চলেছে৷ রাষ্ট্রসংঘের অনুমান অনুযায়ী চিনের জনসংখ্যা ২০২২ সালের ১৪২.৬০ কোটি থেকে ২০৫০ সালে ১৩১.৩০ কোটি এবং ২১০০ সালে ৮০ কোটি হতে চলেছে৷ এটা অবশ্য অনুমানকারী সংস্থার মাঝারি প্রবণতা অনুযায়ী৷ এই অনুমানে ধরে নেওয়া হয়েছে চিনের নারীপ্রতি টিএফআর (টোটাল ফার্টিলিটি রেট) ২০২২ সালের ১.১৮ থেকে ১০০ সালে ১.৪৮ হবে৷ টিএফআর ০.৫ বেশি হলে ২১০০ সালে চিনের জনসংখ্যা ১১৫.৩০ কোটি হবে৷ আর টিএফআর ০.৫ কম হলে ২১০০ সালে জনসংখ্যা দাঁড়াবে ৪৮.৮০ কোটিতে৷

তুলনায়, আমেরিকার জনসংখ্যা ২০২১ সালে ৩৩.৭০ কোটি থেকে ২১০০ সালে বেড়ে ৩৯.৪০ কোটি হতে পারে৷ আর তা মাঝারি প্রবণতা অনুযায়ী৷ উচ্চ এবং নিম্ন প্রবণতা অনুযায়ী ২১০০ সালে আমেরিকার জনসংখ্যা যথাক্রমে ৫৪.৩০ কোটি এবং ২৮.১০ কোটি হতে পারে৷ চিনের জনসংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ ২০২২ সালের টিএফআর ১.১৮ জনসংখ্যা স্থিতিশীল রাখার জন্য প্রয়োজনীয় হার ২.১০ থেকে অনেক নীচে৷ জন্মাহার কমার জন্য দায়ী ১৯৮০ সালে প্রণীত সরকারের এক-সন্তান নীতি৷ ২০১৬ সালে এই কঠোর নীতি থেকে সরকার সরে এসে প্রণয়ন করে দুই-সন্তান নীতি এবং ২০২১ সালে গৃহীত হয় তিন সন্তান নীতি৷

চিন সরকার হয়তো এটা লক্ষ্য করেনি যে এক সন্তান নীতির আগে থেকেই চিনের জন্মহার কমে আসছিল, যা ইন্ধন জোগায় এক সন্তান নীতির প্রণয়নে৷ সরকারি নীতি নির্বিশেষে কেন চিনের জনসংখ্যা কমছে, তার কারণগুলি অনুসন্ধান করা যাক৷

এক, চিনে সন্তানপালনের খরচ বিশ্বের সবচেয়ে খরচসাপেক্ষ দেশগুলির মধ্যে পড়ে৷ দুই, চিনের নারী অনেক দেরিতে সন্তান ধারণ করতে চায়৷ বিগত তিন বছরে গড় সন্তান ধারণের বয়স ২৬ থেকে বেড়ে ২৯ হয়েছে৷ তিন, প্রথম বিবাহের গড় বয়স একই প্রবণতায় বেড়েছে— ২০১০ সালে ২৪ থেকে বেড়ে ২০২০ সালে ২৮ হয়েছে৷ অনেকে বলছেন সরকারের শূন্য-কোভিড নীতি এই বৃদ্ধির কারণ৷ চার, প্রসূত শিশুর লিঙ্গ হার চিনে নারীর দিকে ব্যতিক্রমী ভাবে ভারী৷ বর্তমানে প্রতি ১০০ নারীসন্তান জন্ম নিলে পুরুষসন্তান জন্ম নেয় ১১২ জন৷ তাই চিনে জনসংখ্যায় পুরুষের জনসংখ্যা নারীর থেকে ৩ কোটি বেশি৷ পাঁচ, প্রতি বছর চিন থেকে বিদেশে অভিবাসীর সংখ্যা বিদেশ থেকে চিনে আগমনকারী অভিবাসীর থেকে বেশি৷

ষষ্ঠ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো চিনের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বিবাহের প্রবণতা কমে যাওয়া৷ বিগত নয় বছর ধরে বিবাহের হার ক্রমাগত কমে যাওয়া ফলে অর্ধ দশকের মধ্যে বিবাহের হার অর্ধেক হয়ে গেছে৷ ২০২২ সালে পঞ্জীকৃত বিবাহের সংখ্যা ছিল ৬৮ লক্ষ, যা ১৯৮৬ সালের পরে সবচেয়ে কম৷ ২০১৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৩৫ লক্ষ৷ ২০২৩ সালের প্রথম তিন মাসে আগের বছরের তুলনায় ৪০ হাজারের বেশি বিবাহ হলেও বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা ১,২৭,০০০ বেড়েছে৷ শহরাঞ্চলে শিক্ষা এবং আর্থিক স্বাধীনতা পাওয়ার ফলে নারীদের মধ্যে বিবাহকে তারা কম আর্থিক প্রয়োজনীয়তা মনে করছে৷ আর পুরুষেরা বলছে তারা বৈবাহিক জীবন নির্বাহ করতে পারবে না৷ তাদের বক্তব্য, বিহাহের প্রস্তাব দেওয়া সময়ে চিনের সাংস্কৃতিক রীতি অনুযায়ী একটি বাড়ি এবং একটি গাড়ি থাকতে হবে৷ বিগত তিন বছরের আর্থসামাজিক অনিশ্চয়তা এই প্রবণতাতে ইন্ধন জুগিয়েছে৷

১৯৬০ সালের পরে চিনের জনসংখ্যা প্রথম বারের মতো হ্রাস পেয়েছে৷ সরকার এক অভিনব প্রয়াস নিয়েছে চিনের কুড়িটি শহরে৷ সেই প্রকল্প অনুযায়ী সন্তানপালনে দায়িত্ব স্বামী এবং স্ত্রী উভয়কেই সমানভাবে নিতে হবে, যেখানে বর্তমানে স্ত্রীকেই বেশি দায়িত্ব পালন করতে হয়৷ পূর্ব চিনের এক স্থানীয় সরকার এক ঘটকালির অ্যাপ চালু করেছ৷

চিনের জন্মহার কমার মূল কারণ সেখানে সন্তানপালনের ব্যয় বিশ্বের দেশগুলির মধ্যে দ্বিতীয় উচ্চতম৷ চিনে ১৮ বছর পর্যন্ত একটি সন্তান পালনের ব্যয় জনপ্রতি জিডিপি’র ৬.৯ গুণ, যা জার্মানির তুলনায় দ্বিগুণ এবং ফ্রান্সের তুলনায় তিনগুণ৷ শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে সন্তানপালনের খরচ প্রায় অর্ধেক হলেও তা বহনযোগ্য নয়৷ বেজিং এবং সাংহাইতে একটি সন্তানপালনের খরচ যথাক্রমে ৯,৬৯,০০০ ইউয়ান এবং ১০,২৬,০০০ ইউয়ান যেখানে তিব্বতে তা মাত্র ২,৯৩,০০০ ইউয়ান৷ কিন্ত্ত চিনে জনপ্রতি শ্রমিকের গড় আয় মাত্র ১,০৫,০০০ ইউয়ান৷ তাই একমাত্র সরকার যদি সংশোধনমূলক পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে জন্মহার বৃদ্ধি সম্ভব নয়৷ চিনের এক মধ্যম আয়ের যুবকের কথায়, দেশের আপাত সমৃদ্ধির অর্থ এই নয় যে তার জনগণের জীবনযাপনের নিরাপত্তার উন্নতি হয়েছে৷ বিশ্বায়ন এই এক ভ্রান্তির মধ্যে বিশ্বের অনেক দেশকেই ফেলেছে, বিশেষ করে যে দেশগুলি দারিদ্রতা থেকে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়েছে৷ এই আর্থসামাজিক ভারসাম্যহীনতাই এখন নবসমৃদ্ধ দেশগুলির কাছে প্রধান সমস্যা৷