• facebook
  • twitter
Friday, 20 September, 2024

‘অলুক্ষণে’ স্ট্যাম্প পাওয়া অভিনেতাও জহুরী ঋতুপর্ণর ছোঁয়ায় পরশপাথর

সুনীতা দাস ‘উৎসব’, ‘শুভ মহরত’ থেকে ‘চোখের বালি’, বাংলা সিনেমার এক আলাদা জগৎ চিনিয়েছেন চলচ্চিত্রকার ঋতুপর্ণ ঘোষে৷ ৩০ মে তাঁর মৃতু্যদিন৷ ঋতুপর্ণর ছবিতে অভিনয় করে কষ্টিপাথরও হয়ে উঠত পরশমণি৷ কারণ কোন অভিনেতাকে কোন চরিত্রে কিভাবে ব্যবহার করা যায় তাঁর থেকে ভালো কেউ জানত না৷ ঋতুপর্ণকে কোনওদিন নিজেকে প্রমাণ করতে হয়নি৷ তাঁর কাজই ছিল তাঁর উদাহরণ৷

সুনীতা দাস
‘উৎসব’, ‘শুভ মহরত’ থেকে ‘চোখের বালি’, বাংলা সিনেমার এক আলাদা জগৎ চিনিয়েছেন চলচ্চিত্রকার ঋতুপর্ণ ঘোষে৷ ৩০ মে তাঁর মৃতু্যদিন৷ ঋতুপর্ণর ছবিতে অভিনয় করে কষ্টিপাথরও হয়ে উঠত পরশমণি৷ কারণ কোন অভিনেতাকে কোন চরিত্রে কিভাবে ব্যবহার করা যায় তাঁর থেকে ভালো কেউ জানত না৷ ঋতুপর্ণকে কোনওদিন নিজেকে প্রমাণ করতে হয়নি৷ তাঁর কাজই ছিল তাঁর উদাহরণ৷
যদিও তাঁর কাজ বাদ রেখেও শুধুমাত্র ব্যক্তিসত্ত্বা ঋতুপর্ণকে নিয়ে অনেক আরলোচনা-সমালোচনার ঝড় বয়েছে তার গোটা জীবন জুড়ে৷ একসময় তাঁর অসাধারণ কাজের থেকে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁর লিঙ্গ পরিচয়৷ কিন্তু ঋতুপর্ণ এমনই এক মানুষ ছিলেন যিনি তাঁকে নিয়ে যেকোন সমালোচনাকে হাসিমুখে টপকে তারপরই দিয়েছেন এক একটি অসাধারণ চলচ্চিত্র৷
যে সময়ে বানিজ্যিক সিনেমায় যে নায়ক ৪০এর কোটাতেও কলেজের বই হাতে নিয়ে কলেজ স্টুডেন্টের অভিনয় করে অনেকের কাছে হাস্যরসে পরিণত হয়েছেন সেই নায়ককেও ঋতুপর্ণ তাঁর ছবিতে এমন এক অন্য ধারায় ফুটিয়ে তুলেছেন যে দর্শক ভাবতে শুরু করেছে অন্যভাবে৷
ঋতুপর্ণ ঘোষের অন্যতম গুণ ছিল, বাণিজ্যিক ছবির তারকাদের নিজের ছবিতে অন্যভাবে হাজির করা৷ তাঁর হাত ধরেই প্রচলিত বাণিজ্যিক ছবির বাইরে নিজেকে অন্যভাবে চিনিয়েছেন যিশু সেনগুপ্ত, টোটা রায়চৌধুরীর মতো জাত অভিনেতারা৷ প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় তাঁর হিরো সুলভ-এনগ্রিম্যান চরিত্র থেকে বেরিয়ে দর্শকদের কাছে হয়ে উঠেছেন ‘উনিশে এপ্রিলে’-র অভিনেতা৷ যাকে দেখে দর্শক মুগ্ধ৷
১৯৮০ দশকের মাঝামাঝিতে নায়ক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরুর পর একের পর এক বহু সফল বাণিজ্যিক ছবিতে অভিনয় করছিলেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়৷ ‘অমর প্রেম’–এর পর দর্শককুল ভেবেই নিয়েছিল প্রসেনজিৎ নাচ ও অ্যাকশনে দক্ষ বাণিজ্যিক ছবির ভবিষ্যৎ ‘কান্ডারি’৷
কিন্তু এখানে ঋতুপর্ণের সঙ্গে অন্যদের ফারাক৷ ১৯৯৪ সালে তাঁর ‘উনিশে এপ্রিল’ ছবিতে সুযোগ দেন প্রসেনজিৎকে৷ এবার অবাক হওয়ার পালা৷ এত দিনের চেনা প্রসেনজিৎ যেন মুহূর্তেই অচেনা হয়ে ধরা দিলেন৷ সমাজের আর দশটা চেনা চরিত্রের মতোই পর্দায় পাওয়া গেল তাঁকে৷ এরপর ঋতুপর্ণ ঘোষের পরিচালনায় একে একে ‘চোখের বালি’, ‘খেলা’, ‘দোসর’, ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’, ‘নৌকাডুবি’র মতো ছবিতে দেখা যায় অভিনেতাকে৷ তবে এই প্রসেনজিৎ এক অন্য প্রসেনজিৎ৷
বানিজ্যিক সিনেমা ছাড়াও প্রসেনজিৎ যে এ ধরনের ছবিতেও  অসাধারণ অভিনয় করতে পারেন, সেটা প্রথম চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন ঋতুপর্ণই৷ প্রসেনজিৎ ও ঋতুপর্ণ একসঙ্গে সাতটি সিনেমায় অভিনয় করেছেন৷
তবে এটা শুধু দর্শকরাই নয় স্বয়ং প্রসেনজিৎ, যিশু থেকে শুরু করে টোটা উভয়ে শিকার করেছেন অকপটে৷ পরিচালকের মৃতু্যর পর এক সাক্ষাৎকারে প্রসেনজিৎ বলেছিলেন, ‘আমি অনেক বাণিজ্যিক ছবি করেছি৷ কিন্ত্ত ঋতু আমার মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা অভিনেতাকে খুঁজে বের করেছে৷ এমন একজন অভিনেতা বানিয়েছে, যে প্রচলিত নাচ, গান আর অ্যাকশন দৃশ্যের বাইরে নিজের চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে পারে৷ এটা আর কারুর পক্ষে সম্ভব নয়৷’
শুধুমাত্র পার্শ্বঅভিনেতা হয়ে থেকে যাওয়া থেকে আরেক অভিনেতার উত্থান ঘটিয়েছেন ঋতুপর্ণ৷ তাঁর নাম টোটা রায়চৌধুরী৷ ১৯৯৬ সাল থেকে অভিনয় করছিলেন৷ কিন্ত্ত তেমনভাবে দর্শকদের মন কাড়তে পারেননি৷ কিন্তু অবার করার মতো ঋতুপর্ণর ‘চোখের বালি’র পর রাতারাতি তাকে দর্শকরা এক ভিন্ন ধারার জাত অভিনেতা হিসেবে চিনে ফেলেছে৷ ছবিতে বিহারী চরিত্রে ঐশ্বরিয়া রাইয়ের সঙ্গে তাঁর অভিনয় অনেকেই টোটার ক্যারিয়ার–সেরা বলে মনে করেন৷
টোটা এখন সৃজিত মুখার্জির ওয়েব সিরিজে ফেলুদার ভূমিকায় অভিনয় করছেন৷ নিয়মিত কাজ করছেন বলিউডেও৷ যার পেছনে ঋতুকেই কৃতিত্ব দেন টোটা, ‘আমি ঋতুপর্ণের সঙ্গে কাজ করেছি, এটা সব সময় আত্মবিশ্বাস জোগায়৷ অকালে হারিয়ে না গেলে একসঙ্গে আরও কাজ করা যেত৷’
তবে ঋতুপর্ণর অভিনেতা চেনার গুণ সবথেকে বেশি যাঁর ক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় তিনি হলেন যিশু সেনগুপ্ত৷ এককথায় বলতে গেলে নায়কের চরিত্র থেকে পার্শ্বঅভিনেতা৷ তারপর প্রায় হারিয়ে যাওয়ার পথে যিশুর ক্যারিয়ারকে টেনে নিজের সাফল্যের নৌকায় বসিয়েছিলেন ঋতুপর্ণ৷ যীশুর ‘অলুক্ষণে’ অপবাদ ঘুচিয়ে তাঁকে হিট নায়কের আসনে বসান তিনি৷
২০১০ সালে মুক্তি পাওয়া যিশুর সেই ছবি ‘আবহমান’ পরে চারটি শাখায় ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়৷ এরপর যীশু রাতারাতি হয়ে ওঠেন পশ্চিমবঙ্গের অনেক পরিচালকের প্রথম পছন্দ৷  ‘আবহমান’ ছাড়াও ঋতুপর্ণের পরিচালনায় ‘নৌকাডুবি’তে অভিনয় করেন যীশু৷
এখন তো তিনি বাংলার সঙ্গে হিন্দি ও তেলেগুতে নিয়মিত কাজ করছেন৷ তবে ঋতুর প্রসঙ্গ উঠলেই আফসোস হয় যীশুর, ‘আমার আজকের এই অবস্থান পুরোপুরি ঋতুর জন্য৷ ও আমাকে হাতে–কলমে অভিনেতা হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে৷ একটাই আফফোস, আমার আজকের এই ব্যস্ততা, সাফল্য ও দেখে যেতে পারল না৷’