ড. কুমারেশ চক্রবর্তী
ইরানের অত্যন্ত ক্ষমতাশালী জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি গত ১৯ মে আজারবাইজান সীমান্তের কাছে এক কপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন, তাঁর সঙ্গে মারা গেছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেন আলী আব্দুল্লাহ হিয়ান, কয়েকজন উচ্চ পদস্ত আধিকারিক, আজারবাইজানের এক গভর্নর সহ সমস্ত যাত্রী ও বিমান কর্মী৷ এই ঘটনা মধ্যপ্রাচ্য সহ সারা বিশ্বের এক গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে৷ খুব স্বাভাবিকভাবেই ছডি়য়ে পডে়ছে নানা সন্দেহ৷ অনেকেই বলছেন এটা দুর্ঘটনা নয়, পরিকল্পিত হত্যা, এই ব্যাপারে প্রথম অভিযোগের আঙ্গুল উঠছে ইরানের চিরশত্রু ইসরাইলের বিরুদ্ধে৷ বলা হচ্ছে ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে এই দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে৷ দ্বিতীয়তঃ সন্দেহের তালিকায় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র৷ কারণ এই বিমান তাদেরই তৈরি এবং দীর্ঘদিন তারা আধুনিক যন্ত্র সরবরাহ করেনা৷ সুতরাং চর মারফত বিমানের যন্ত্রপাতি বিকল করে দেওয়া খুব একটা কঠিন নয়৷ তাছাড়া ইরানের ঘোষিত শত্রু আমেরিকা এবং আমেরিকাও ইরানকে তাদের পয়লা নম্বর শত্রু বলেই মনে করে৷ তৃতীয় সন্দেহভাজন দেশ হল আজারবাইজান৷ এর প্রধান কারণ আজারবাইজানের সঙ্গে ইসরাইলের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক৷ যাকে বলে গলায় গলায় ভাব৷ আজারবাইজান অনেক ব্যাপারেই ইসরাইলের উপর নির্ভরশীল তাই আজারবাইজানের কাঁধে বন্দুক রেখে ইসরাইল গুলি চালাতেই পারে৷
ইরানের আভ্যন্তরীণ ক্ষমতার লড়াইও এক্ষেত্রে একটা কারণ হয়ে দাঁডি়য়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন৷ অর্থাৎ সন্দহের তীর রইসের নিজের দেশের দিকেও আছে৷ প্রেসিডেন্ট রাইসি অত্যন্ত কট্টরপন্থী মৌলবাদী নেতা ছিলেন৷ ফলে দেশের মধ্যে অনেকেই তার বিরুদ্ধে ছিলেন৷ তাছাড়া একদল ক্ষমতালোভী মৌলবাদী ধর্মীয় নেতা আছেন যারা সুযোগ খুজছিলেন রইসিকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য৷ এই পরিস্থিতিতে দেশের আভ্যন্তরীণ অন্তর্ঘাতের কথা একটি সংবাদ মাধ্যম খুব স্পষ্ট করে জানিয়েছে৷ এই সংবাদমাধ্যম আয়াতুল্লাহ আলী খোমেনি– ইরানের সর্বোচ্চ শক্তিশালী ধর্মগুরু আয়াতুল্লাহ আলী খোমেইনির ছেলে মুস্তাফাকে সরাসরি দায়ী করেছেন৷ তাদের মতে রাইসীর যোগ্যতা প্রমাণিত হয়েছে৷ তাই ইরানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এবং নেতা ধরেই নিয়েছেন সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লা আলী খোমেইনির এর স্থলাভিষিক্ত হবেন ইব্রাহিম রাইসি৷ তার কারণ আয়াতুল্লাহর বয়স এখন ৮৬৷ তার ওপর তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত৷ এই অবস্থায় ইব্রাহিম রাইসি ছিলেন ইরানের মানুষের প্রথম পছন্দ৷ কিন্ত্ত কয়েক বছর ধরেই খোমেনীর বড় ছেলের মুস্তাফা এই পদের জন্য পরিকল্পনা করে চলেছেন৷ যদিও তিনি কোন প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় গুরু নন৷ কিন্ত্ত তার প্রতি একটা দুর্বলতা মোল্লাদের আছে, কারণ তিনি খোমেনীর ছেলে৷ এটাই সবচেয়ে বড় যোগ্যতা৷ তাই ইরানের মোল্লারা সকলেই চাইছেন মুস্তাফাই তার পিতার আসন দখল করুন৷ সুতরাং এক্ষেত্রে মুস্তাফাকে সন্দেহ করার যথেষ্ট যুক্তি আছে৷
কিন্ত্ত এইসব কল্পনা, অনুমান এবং সন্দেহে জল ঢেলে দিয়েছেন ইরানের সরকারি মুখপাত্র৷ তিনি এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া জন্যই কপ্টার দুর্ঘটনা ঘটেছে, এর পেছনে অন্য কোন কারণ নেই, কোন ব্যক্তি কিংবা দেশ পরিকল্পিতভাবে প্রেসিডেন্ট রাইসিকে হত্যা করেনি৷ ইরানের এই সরকারি বিবৃতি ঘিরেও বিতর্ক তৈরি হয়েছে৷ ইরানের অভ্যন্তরেই বলা হচ্ছে, এই তথ্য সত্য নয়, সরকার নিজেদের দুর্বলতা এবং ভুল ঢাকতে এইসব মিথ্যা বিবৃতি দিচ্ছেন৷
ইতিমধ্যে ইরানের ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন৷ বলাবাহুল্য আপাতত অস্থায়ীভাবে তিনি প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, স্থায়ী প্রেসিডেন্ট হবেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে৷ কারণ অনেকেই এই পদের দাবিদার, যার অন্যতম হলেন প্রয়াত প্রেসিডেন্ট রাইসির অত্যন্ত প্রিয় সুন্দরী বিধবা পত্নী৷ ইরানের সাধারণ মানুষের কাছে তার একটা ভাবমূর্তি আছে এবং তিনি যথেষ্ট জনপ্রিয়ও বটে৷
রাইসির মৃতু্যর প্রভাব
প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃতু্যর পরে মনে করা হয় যে গাজায় শ্মশানের শান্তি স্থাপিত হবে৷ সাময়িক হলেও এই মর্মান্তিক ঘটনার পরে উভয় পক্ষই একটু সংযত হবেন, এই অনুমান অনেকাংশেই সঠিক ছিল৷ কারণ ইরান এবং তার সাহায্যপুষ্ট হামাস এই মুহূর্তে পাল্টা আঘাত করার মতন অবস্থায় নেই৷ বাস্তব পরিস্থিতি হল তারা একটা বড় ধাক্কা খেয়েছে, এটা সামলে ওঠার জন্য তাদের একটু সময় লাগবেই৷ সেই কারণে তারা এখন কোন যুদ্ধের মধ্যে যাবে না বলেই মনে হয়৷ অপরদিকে ইসরাইল, ইরানের
প্রেসিডেন্টের মৃতু্যর পরে কিছুটা সংযত থাকবে কারণ আন্তর্জাতিক জনমত এই মুহূর্তে ইসরাইলের বিরুদ্ধে৷ তাই কোন বড় ধরনের আঘাত হানার পরিকল্পনা ইসরাইল নেবেনা৷ তাছাড়া এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক রাজনীতির হঠাৎ পরিবর্তন ঘটেছে৷ তিনটি ইউরোপীয় দেশ পালেসটাইনকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দান করেছেন, স্বীকৃতি দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইওরোপীয় ইউনিয়ন৷ সুতরাং এই পরিস্থিতিতে ইসরাইল কোন হঠকারী সিদ্ধান্ত নেবে বলে মনে করা হয় না৷
কোন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারের প্রধানের দুর্ঘটনাজনিত মর্মান্তিক মৃতু্য হলে তার প্রতি সম্মান ও সমবেদনা জানানোটাই আন্তর্জাতিক সৌজন্য এবং রীতি৷ কিন্ত্ত রাইসির মৃতু্যর পরেই ইরানের দুই ঘোষিত শত্রু দেশ আমেরিকা এবং ইসরাইল কু মন্তব্য করে বসলেন৷ যেমন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন বললেন, রইসের মৃতু্যতে দুঃখ প্রকাশের কোন স্থান নেই, কারণ প্রেসিডেন্ট রইসের হাত রক্তাক্ত৷ প্রায় একই সুরে কথা বললেন ইসরাইল সরকারের প্রধান নেতা নেতানিয়াহুর বললেন, ‘‘ইরান প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃতু্য মোটেই দুঃখজনক নয়, কারণ তিনি বহু হত্যার অন্যতম নায়ক তাই শোক প্রকাশের কোনো কারণ নেই বরং যা হয়েছে ভালই হয়েছে৷’’ এই দুটি দেশ এবং ব্রিটেন ছাড়া প্রায় সব রাষ্ট্রই প্রয়াত প্রেসিডেন্ট এর জন্য শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করেছেন৷ ভারত তো একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে এবং শেষকৃত্যের উপস্থিত থাকার জন্য ভারতের উপরাষ্ট্রপতি ধনকর তেহরানে পৌঁছে গিয়েছিলেন৷
পশ্চিমি রাষ্ট্রগুলির বিরুদ্ধে চীন, রাশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্র এককাট্টা হয়েছে৷ চীন রাশিয়া তো প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছে তারা ইরানের পাশে আছে এবং ইরানকে তারা সব ধরনের সাহায্য করতে প্রস্তুত৷ একইসঙ্গে তারা আমেরিকা, ইসরাইল সহ পশ্চিমের রাষ্ট্রগুলির আচরণের নিন্দা করেছে৷ চীন, রাশিয়া হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, যদি ইসরাইল যুদ্ধ বন্ধ না করে তাহলে তারা আর চুপ করে বসে থাকবে না৷ অর্থাৎ রাইসির মৃতু্য আবার একটা বড় ধরনের যুদ্ধ তৈরি করতে পারে৷ আবার বিশ্ব শান্তি বিনষ্ট হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে৷ অর্থাৎ যুদ্ধের হাত থেকে বিশ্বের আপাতত মুক্তির সম্ভাবনা নেই৷
ধর্ম সংকটে ভারত
আরব ইসরাইল যুদ্ধ নিয়ে ভারত এত দিন দু’নৌকায় পা দিয়েই চলছিল৷ কোনো পক্ষকে সমর্থন কিংবা বিরোধিতা সে করেনি, আপাত দৃষ্টিতে ভারত নিরপেক্ষ ছিল এটা বলাই যেতে পারে৷ কিন্ত্ত প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃতু্যর পরে সব অঙ্কটাই গন্ডগোল হয়ে গেল৷ পাকিস্তানের শত প্ররোচনা সত্ত্বেও ইরান আজও ভারতের বন্ধু হিসেবেই আছে৷ ইরানের থেকে ভারত বহু ধরনের সাহায্য সহযোগিতা পায়৷ সুতরাং ইরানকে চটানো ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়৷ তাছাড়া সম্প্রতি ইরান তাদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চাবাহার বন্দর ভারত কে লিজ দিয়েছে৷ ভারত বন্দরটি সংস্কার করবে এবং দশ বছরের জন্য ব্যবহার করবে৷
পাকিস্তানের নাকের ডগায় এই বন্দর ভারতের হাতে থাকা মানে পাকিস্তানকে খুব চাপে রাখা৷ তাছাড়া মধ্যপ্রাচ্য সহ পূর্ব ইউরোপে যাতায়াতের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রস্থল হচ্ছে এই চাবাহার বন্দর৷ এই বন্দরটি ভারত পাওয়ায় রাশিয়া থেকে তেল আনা এবং ইরান তেল সহ থেকে বিভিন্ন দ্রব্য দেওয়া-নেওয়া, মধ্যপ্রচ্যর সঙ্গে সহজে যোগাযোগ রাখতে পারবে৷ বাণিজ্যিক দিক থেকে এই বন্দর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ রাজনৈতিক দিক থেকেও খুবই তাৎপর্যপূর্ণ৷ তাই ইরানের সঙ্গে চাবাহার বন্দর চুক্তির পরে আমেরিকা অত্যন্ত রুষ্ট হয়েছিল, প্রকাশ্যে সে তার ক্ষোভের কথা জানিয়েও ছিল৷ ভারতের ড্যামেজ কন্ট্রোল ম্যানেজার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর বাইডেন প্রশাসনকে বুঝিয়ে সুজিয়ে ঠান্ডা করেছেন৷ যাই হোক ভারতের আশঙ্কা ইরানের নতুন সরকার যদি এই চুক্তি বাতিল করে কিংবা এর ওপর নানা ধরনের শর্ত আরোপ করে তাহলে ভারতের পক্ষে তা অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং বিপদজনক হবে বলেই মনে করা হচ্ছে৷ তাই ভারত প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃতু্যর পরে শুধু শোক বা সমবেদনা জানিয়ে থেমে থাকেনি তারা একদিন রাষ্ট্রীয় শোক পালন করেছে এবং উপরাষ্ট্রপতিকে ইরানে পাঠিয়ে দিয়েছে শেষকৃত্যে উপস্থিত থাকার জন্য৷ তাছাড়া প্রকাশ্যে ভারত ঘোষণা করেছে যে, এই দুর্দিনে ভারত ইরানের পাশে আছে৷ অপরদিকে ইসরাইলের সঙ্গেও ভারতের সুসম্পর্ক রয়েছে৷ অস্ত্র, ওষুধ, যন্ত্রাংশ, প্রযুক্তি প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে ভারত ইসরাইলের উপর নির্ভর করে৷ দুই দেশের বাণিজ্য অত্যন্ত লাভজনক ভারতের কাছে৷ তাই ভারত অত্যন্ত সতর্কভাবে পা ফেলছে যাতে ইসরাইলের সঙ্গে তার সম্পর্ক নষ্ট না হয়৷ ইতিমধ্যেই ইসরাইল রাইসিকে নিয়ে ভারতের বাড়াবাডি় ভালো চোখে দেখেনি৷ তাই বলা যায় মোদি সরকার এখন ধর্ম সংকটে পরেছে, কূল রাখি না মান রাখি অবস্থা৷
তারওপর আবার দেশ জুডে় নির্বাচন চলছে৷ বেফাঁস কিছু বলে ফেললে বা করলে তার প্রভাব পড়তে পারে নির্বাচনে৷ সুতরাং ভোটের বাজারে মোদী এখন ঘরে বাইরে অত্যন্ত দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন৷ এই সংকটে জয় শ্রীরাম নয়, জয়শঙ্কর এখন তাঁর একমাত্র ভরসা৷