কলকাতা, ২৭ মে: গতকাল রবিবার ভোর থেকে ঝিরঝিরে বৃষ্টি হলেও মাঝরাতে শুরু হয় রেমালের দাপট। তাঁর সঙ্গী ছিল ভারী বৃষ্টি। গভীর রাতে ঝড়ের চূড়ান্ত মুহূর্তে সাগরদ্বীপে ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ১২০ কিমি। দমদমে সেই গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ৯০ কিলোমিটার। ফলে রেমালের দাপটে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রাজ্যের বহু ঘরবাড়ি, গাছপালা ও বিদ্যুৎ পরিষেবা। সুন্দরবন এলাকায় বহু কাঁচা বাড়ি, গাছপালা ও বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে গিয়েছে। কলকাতা শহর ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকাতেও ভেঙে পড়েছে গাছপালা ও বিদ্যুতের খুঁটি। এমনকি শহরে অনেক পুরনো বাড়ির অংশও ভেঙে পড়েছে।
রেমালের তান্ডবে রাজ্যে এখনও পর্যন্ত ছয়জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। বাংলাদেশে নিহতের সংখ্যা ১০। কারও মাথায় গাছ ভেঙে পড়েছে, কেউ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েছেন, কারও মাথায় বাড়ির কার্নিশ ভেঙে পড়েছে। আহতও হয়েছেন আরও বেশ কয়েকজন। এন্টালিতে ঝড়ের সময় বাড়ির কার্নিশ ভেঙে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় প্রবল ঝড় শুরু হতেই তিনি ওই বাড়ির নিচে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আচমকা মাথার ওপর বাড়ির কার্নিশ ভেঙে পড়তেই তাঁর মৃত্যু হয়। জানা গিয়েছে, ওই ব্যক্তির ছেলে পাড়ায় কোনও এক জায়গায় আইপিএল খেলা দেখতে গিয়েছিল। ঝড় শুরু হতেই চিন্তিত হয়ে পড়েন তার বাবা। তিনি ঝড়ের মাথায় তাঁকে আনতে গিয়েই মৃত্যুর মুখে পড়েন।
প্রসঙ্গত রাজ্য সরকারের বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের সর্বশেষ দেওয়া তথ্য অনুযায়ী জানা গিয়েছে, কলকাতায় ১৪০ মিমি বৃষ্টি হয়েছে। হলদিয়াতে বৃষ্টি হয়েছে ১১০ মিমি। এছাড়াও অন্যান্য বহু জায়গায় ৬০ মিমি-র বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। প্রশাসন সম্পূর্ণভাবে সতর্ক রয়েছে। সমস্ত পরিষেবা স্বাভাবিক রাখার জন্য প্রশাসন দিনরাত ২৪ ঘন্টা কাজ করে চলেছে। দুর্গতদের ত্রাণ পরিষেবার ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। রেমালের জেরে রাজ্যে ১৭০০ বিদ্যুতের খুঁটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঝড়ের প্রবল দাপটে বহু গাছ উপড়ে গিয়েছে। মূলত উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণায় এই ঘটনা বেশি ঘটেছে। বহু জায়গায় রাস্তায় গাছ পড়ে রাস্তা অবরুদ্ধ হয়ে গেলেও দ্রুত সেটা সরিয়ে ফেলে যান চলাচল স্বাভাবিক করা হয়। কলকাতা শহরের বহু জায়গা জলমগ্ন হয়ে পড়ে। ফলে যান চলাচল অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। প্রশাসন দ্রুত সেই জল পাম্পের সাহায্যে সরিয়ে যান চলাচল স্বাভাবিক করে। এপর্যন্ত রাজ্যে প্রায় দুই লক্ষ মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দুর্যোগ প্রভাবিত জেলাগুলিতে ১৪৩৮টি ত্রাণ শিবির খোলা হয়েছে। তাঁদেরকে তিনবেলা রান্না করা খাবার দেওয়া হয়েছে। বেশকিছু লোককে নিরাপদে তাঁদের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
রেমালের দাপটে এখনও পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২৪টি ব্লক। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৭৯টি ওয়ার্ডও। যার মধ্যে ২৫০০ বাড়ি সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়েছে। গাছ পড়েছে ২১৪০ টি। ১৭০০ বিদ্যুতের খুঁটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ত্রাণ শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ২০৭০৬০ জনকে। যার মধ্যে বর্তমানে ত্রাণ শিবিরে রয়েছেন ৭৭২৮৮ জন। রাজ্যে মোট ১৪৩৮টি ত্রাণ শিবির চলছে। গ্রুয়েল কিচেন চলছে ৩৪১টি। এখনও পর্যন্ত ত্রিপল বিলি হয়েছে ১৭৭৩৯ টি। দুর্গতদের পোশাকও বিতরণ করা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, যেসব বাড়ি সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানা গিয়েছে, এসডিআরএফ বিষয়টি খতিয়ে দেখার পর তাঁদের গৃহ পুনর্নির্মাণের জন্য ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। এছাড়া আরও ২৭ হাজার বাড়ি, যেগুলি আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, খতিয়ে দেখার পর তাঁদেরকেও আংশিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।
এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব আগামীকাল ২৮ মে মঙ্গলবার পর্যন্ত থাকবে। যার ফলে দক্ষিণবঙ্গ সহ রাজ্যের অন্যান্য জেলাতেও ভারী বৃষ্টি, বজ্রপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এইসব এলাকায় ত্রাণ ও উদ্ধারকাজে প্রশাসন তৎপর রয়েছে।
গোটা পরিস্থিতি নিয়ে রাজ্যের মুখ্যসচিবের সঙ্গে কথা বলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। উপকূল এলাকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তিনি। রেমালের প্রভাবে রাজ্যের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলিকে সমবেদনা জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি তাঁর এক্স হ্যান্ডেলে লেখেন,‘‘পশ্চিমবঙ্গ নদীমাতৃক রাজ্য, বঙ্গোপসাগরের উপকূলে। প্রতিবছরই তাই আমাদের নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হতে হয়। এবারও সাইক্লোন ‘রেমালে’র প্রভাবে আমাদের রাজ্যে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হল ও হচ্ছে। কিন্তু সবার উপরে মানুষের জীবন। সৌভাগ্যক্রমে এবং অবশ্যই রাজ্য প্রশাসনের তৎপরতায় এবার জীবনহানি তুলনামূলকভাবে অনেক কম। নিহতদের পরিবারবর্গকে আমার আন্তরিক সমবেদনা জানাই, তাঁদের নিকটজনের হাতে অবিলম্বে আর্থিক সহায়তা পৌঁছাবে। ফসলের ও বাড়িঘরের যা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার ক্ষতিপূরণের বন্টন আইন-মোতাবেক প্রশাসন এখনই দেখে নেবে এবং নির্বাচনের আচরণবিধি উঠে গেলে আমরা এইসব বিষয় আরও গুরুত্ব দিয়ে পুরোটা বিবেচনা করব।
নির্বাচনী বন্দোবস্তের ব্যস্ততা সত্ত্বেও সর্বস্তরে আমাদের প্রশাসন দুর্যোগ মোকাবিলায় এবার প্রস্তুত ছিল। মুখ্যসচিব থেকে শুরু করে আমার রাজ্যের সম্পূর্ণ সচিবালয়, জেলা প্রশাসন থেকে ব্লক প্রশাসন – দুর্যোগের মোকাবিলায় সকলে সংহতভাবে সবসময় মানুষের পাশে রয়েছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। দু’লক্ষ মানুষকে নিরাপদ জায়গায় ১৪০০ শিবিরে সরানোর কৃতিত্ব আমাদের পুরসভা – পঞ্চায়েতগুলিরও। এজন্য আমি রাজ্য ও স্থানীয় প্রশাসনের সকলকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
আমি বিশ্বাস রাখি, সকলের সহযোগিতায় এই ঝড়ও আমরা কাটিয়ে উঠব। আমি জানি, এই দুর্যোগে আপনারা চিন্তিত। আমরাও চিন্তিত। কিন্তু ভয় পাবেন না, চিন্তা করবেন না। পরিস্থিতির মোকাবিলায় যা যা করণীয়, আমরা সবটাই করবো।’’