• facebook
  • twitter
Thursday, 19 September, 2024

পাহাড় থেকে মেয়ে পাচার

দার্জিলিঙের পথে যেসব সবুজ চা বাগানকে পেছনে রেখে টু্যরিস্টরা ছবি তোলে সেই চা বাগানের ভেতর থেকে মেয়েরা উধাও হয়ে যেত৷ আজও যায়৷ কোথায় যায় তারা! উত্তর ছিল না বাড়ির লোকের কাছে৷ জানা ছিল না পুলিশেরও৷ খোঁজ চালিয়েছিলেন দার্জিলিঙের সাহসী মেয়েটি— রঙ্গু সউরিয়া৷ আশপাশের ছেলেদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন কাঞ্চনজঙ্ঘা উদ্ধার কেন্দ্র৷ ফিরিয়ে এনেছেন নকশালবাড়ি, কালিম্পং, বিজনবাড়ি,

দার্জিলিঙের পথে যেসব সবুজ চা বাগানকে পেছনে রেখে টু্যরিস্টরা ছবি তোলে সেই চা বাগানের ভেতর থেকে মেয়েরা উধাও হয়ে যেত৷ আজও যায়৷ কোথায় যায় তারা! উত্তর ছিল না বাড়ির লোকের কাছে৷ জানা ছিল না পুলিশেরও৷ খোঁজ চালিয়েছিলেন দার্জিলিঙের সাহসী মেয়েটি— রঙ্গু সউরিয়া৷ আশপাশের ছেলেদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন কাঞ্চনজঙ্ঘা উদ্ধার কেন্দ্র৷ ফিরিয়ে এনেছেন নকশালবাড়ি, কালিম্পং, বিজনবাড়ি, মিরিকের হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের৷ হয়তো-বা পারেননি কখনও পাচার হওয়া মেয়েটাকে ফিরিয়ে আনতে৷ কিন্ত্ত কীভাবে ফিরিয়ে এনেছেন এ নিয়েই ধারাবাহিক ‘পাহাড় থেকে মেয়ে পাচার’৷ লিখছেন মঞ্জীরা সাহা

দ্বিতীয় পর্ব

মাঞ্ধা টি এস্টেটের মেয়েটা
গাড়ি চলেছে ওই দূরের গাঢ় সবুজ পাহাড়গুলোর দিকে৷ উঠছে রাস্তাটা৷ ইঞ্জিনে শব্দ বাড়ছে৷ ডানে বাঁয়ে ঘন সবুজ চা বাগান৷ মাঝে মাঝে লম্বা লম্বা শিশু গাছ৷ হাল্কা রোদ এসে পড়ছে৷ মাঝে মাঝে উঁকিঝঁুকি দিয়ে সরে যাচ্ছে মেঘ৷ পিচের রাস্তা থেকে দেখা যাচ্ছে চা বাগানের সামনের দিকে একটি মেয়ের বুক থেকে মাথা অবধি৷ মাথার উপর গিঁট বাঁধা কাপড়ের ঝোলা৷ পিঠের উপর ঝুলছে বিশাল সাইজের ঝোলাটা৷ গায়ে চুড়িদারের উপর শার্ট চাপানো৷ তার উপর বুক অবধি কাপড় বাঁধা৷ ওরা ওটাকে বলে ত্রিপল৷ সাদা ত্রিপলের রঙ বদলে গেছে৷ কালচে লালচে দাগে ভরা৷ চা পাতার দাগ শুকিয়ে ছোপ ছোপ পড়ে গেছে৷ হাতের আঙুল পাতার রঙ লালচে৷ ফাটা ফাটা চামড়ায় ভরা৷ ফাটা ফাটা দাগগুলো কালো হয়ে আছে৷ নখগুলো কালচে লাল৷ চা পাতার কষ লেগে হাতগুলোর রঙ এমন হয়ে গেছে৷ একটি মেয়ে না৷ বাগানে আরও একটু সামনে তাকালে ডানে বাঁয়ে আগে পিছে এরকম কত মেয়ে দেখা যাচ্ছে৷ জানা ছিল না ওই চা তুলতে থাকা মেয়েগুলো যে হঠাৎ হারিয়ে যায়! যাদের আর দেখতে পাওয়া যায় না কোনওদিন! তারা কোথায় যায়?
এ এলাকায় সবাই জানত নেপাল-বাংলাদেশ থেকে মেয়েরা পাচার হয়ে যায়৷ কিন্ত্ত শিলিগুড়ির আশেপাশে দার্জিলিং জলপাইগুড়ি কোচবিহার এসব জেলার মেয়েরাও যে পাচার হয়ে যায়, জানা ছিল না কারুরই৷ সময়টা ২০০২-০৩ সাল৷ সে সময় শিলিগুড়িতে এক সমাজসেবামূলক সংস্থা ছিল৷ শিলিগুড়ির সাংবাদিক প্রভাত পাঠক, কৃষ্ণা লামা, চেতন গুরুং এঁরা ছিলেন যুক্ত সেই সংস্থার সঙ্গে৷ ভানুভক্তের জন্মদিন পালন, রক্তদান শিবির, কম্বলদান, বৃক্ষরোপণ এরকম কাজকর্ম করে আসছিল সেই সংস্থা৷ প্রভাত পাঠকের সঙ্গে আলাপ হয় মাইতি নেপালের কর্ণধার অনুরাধা কোয়েরালার সঙ্গে৷ নেপাল থেকে যে সমস্ত মেয়ে পাচার হয়ে দিল্লি পুনা মুম্বাই বিক্রি হয়ে যায় তাদের উদ্ধার করার অন্যতম সংস্থা মাইতি নেপাল৷ এই মাইতি নেপালের কর্ণধার অনুরাধা কোয়েরালার থেকেই প্রভাত পাঠক জানতে পারেন যে মুম্বাই পুনা দিল্লির রেড লাইট এরিয়া থেকে নেপালের মেয়েদের উদ্ধার করার সময় দার্জিলিং মিরিক নকশালবাড়ি জলপাইগুড়ি কালিম্পং এলাকার বহু মেয়েকে ওই সব রেড লাইট এরিয়াতে দেখা যায়৷ এই পাহাড়ি এলাকার অসংখ্য মেয়ে ওখানে বিক্রি হয়ে গেছে৷ তারা অসহায়ভাবে তার কাছে আকুতি করে৷ বাঁচানোর প্রবল আর্তি জানায় বারবার৷ তাদের কেউ বার করে নিয়ে আসার নেই৷ বিদেশের এইসব মেয়েদের উদ্ধার করা সম্ভব হয় না মাইতি নেপালের পক্ষে৷

মনে হতে শুরু হল ঘন সবুজ চা বাগানের আশে পাশের এই হারিয়ে যাওয়া মেয়েরা কোথায় যেতে পারে৷
রঙ্গুর সাহস আর অদম্য ইচ্ছেগুলো প্রভাত পাঠকের জানা ছিল৷ মিটিং শুরু হল রঙ্গুর সঙ্গে৷ রঙ্গু আর রঙ্গুর বাড়ির আশপাশের আরও কিছু ছেলে একজোট হল৷ আস্তে আস্তে জন্ম নিল ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা উদ্ধার কেন্দ্র’৷
এই কাঞ্চনজঙ্ঘা উদ্ধার কেন্দ্র তৈরি হওয়ার আগেই অন্যান্য মিসিং কেস রঙ্গু নিজেই খুঁজে বার করছিলেন চা বাগানগুলো থেকে৷ কাঞ্চনজঙ্ঘা উদ্ধার কেন্দ্র নামটা সরকারি অফিসের খাতায় প্রথম লেখা হয়েছিল রঙ্গুর বি এড কলেজ থেকে বেরনোর পরেই৷

রঙ্গু সউরিয়ার বাড়িতে পৌঁছে গেছি সকাল বেলাতেই৷ শীতটা এ পাহাড়ি পাড়াটাতে যেন সেদিন জাঁকিয়ে বসেছে৷ রঙ্গু কথা শুরু করলেন গরম চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে, ‘তখন ঘুরছি খুব টি গার্ডেনগুলায়৷ চা বাগানে বাগানে গিয়া ওয়ার্কারদের সঙ্গে গিয়া মিটিং করছি৷ গিয়া গিয়া বলছি, দেখো তোমাদের কেউ বাইরে নিয়ে যেতে চাইলে যাবে না৷ শুনছি বাড়ি বাড়ি ডোমেস্টিক ভাওলেন্স হয়৷ পিটাপিটি হয়৷ আবার মাঝেমাঝে খবরটাও পাচ্ছি কী কোনও কোনও মেয়ে মিসিং হয়ে গেছে৷

হঠাৎ একদিন একটা মেয়ের বাবা মা আমার বাড়িতে এসে হাজির৷ তখন এই সব এলাকার মানুষগুলো একটু একটু জানত কী আমি এইসব মেয়েদের খোঁজ নেই৷’

এই কেসটার কথা বলতে বলতে উনি বারান্দা থেকে ঘরের ভেতর নিয়ে এলেন আমাকে৷ খাটের উপর পা তুলে বসলেন৷ শীতের কম আলোয় পাহাড়ে ঘেরা গলির ওই ঘরটা অন্ধকার অন্ধকার লাগছিল আমার৷ কোলের উপর বালিশটা টেনে নিয়ে দু-হাতে চেপে ধরে বলে চলেছেন, ‘ফাস্ট কেস… ফাস্ট কেস… জানেন ওটাই আমার ফাস্ট কেসটা ছিল৷’

ইংরাজি শব্দটাকে ওঁর নিজের ভাষার মতোন করে উচ্চারণ করে চলেছেন৷ মাঝের রেফ চিহ্নটুকু বাদ চলে গেছে৷ অন্ধকারেও দেখতে পাচ্ছি, কথা বলতে বলতে চোখ দুটো চকচক করে উঠছে৷ জানালার বাইরে কোথাও তাকিয়ে বলে চলেছেন—

‘ভাবিই নাই তখন পারবো৷ তখন তো ভালোমত জানিই না আমাদের এইসব এরিয়া থেকে এত্তো এত্তো মেয়ে এইভাবে ট্রাফিকিং হয়ে যায়৷ ট্রাফিকিং যে আসলে কী সেটাই জানি না৷’
—কোথাকার মেয়ের কথা বলতে এসেছিল?

‘মাঞ্ঝা টি-এস্টেটের ভিতর থাকত মেয়েটা৷ নেপাল বর্ডারের পাশেই ওই টি-এস্টেট৷ ওই এস্টেটে কাজ করত ওর মা৷ প্লাকার ছিল৷ মানে চা পাতা তোলার কাজ করত৷’
—মেয়েটাও কাজ করত?
‘না না মেয়েটাতো ছোট ছিল৷ থার্টিন ইয়ারস৷ বাবাটা দিন রাত ড্রিংক করে পড়ে থাকত৷ তিনটা বোন ছিল, ও ছিল বড়৷’
—নাম কী ছিল?
কিছুক্ষণ চুপ৷
আবার প্রশ্ন— মেয়েটির নাম কী ছিল মনে আছে?
‘কোনও একটা ফেক নাম লিখে দিন৷’
হঠাৎ চমকে উঠলাম৷
—কেন? নামটা বলবেন না কেন?
‘কোনও মেয়ের অরিজিনাল নামটা বলি না৷’
—কেন…?
‘ওদের অনেক অনেক প্রবলেম হয় জানেন৷ পরে ঘরে ফিরে আসার পর এইসব নাম ঠিকানা জানাজানি হলে ওরা থাকতে পারে না৷

ওর পেরেন্টস যখন আমার কাছে এসেছে তখন একবচ্ছর হয়ে গেছে মেয়েটা হারিয়ে গেছে৷ ওর বাবা মাটা কিছুই জানেনা বড় লেড়কিটা কোথায় চলে গেল৷ পুলিশের কাছে গেছে৷ ঘুরে এসেছে কয়বার৷ খোঁজ পায় নাই৷ খুব অবস্থাটা খারাপ ছিল ওদের৷ মাটির ঘরটা ছিল৷ ওই একখানা ঘরে ওরা থাকত সবাই মিলে৷ কতদিন ওই চা বাগানের ডিউটি থেকে ছুটি নিয়ে ওর মা খুঁজবে মেয়েকে? খাওয়াবে কে? বাবাতো সারা দিন ড্রিংক করে পড়ে থাকে৷ এত্তোগুলো ফ্যামেলি মেম্বার৷

সেই থার্টিন ইয়ার্সের মেয়েটা বলে একদিন আর নাই৷ বাড়ি থেকে, ওই টি এস্টেট থেকে হাওয়া হয়ে গেছে৷ মেয়েটার বাড়ি গেলাম৷ বারবার জিজ্ঞাসা করছি ওদের কেউ রিলেটিভ এসেছিল? কোনও ফ্রেন্ড এসেছিল? অন্য কেউ এসেছিল বাইরে থেকে? ওরা চুপ৷ কিছুই বলতে পারে না৷’
ওই মাটির ঘরের ভেতর রহস্য সমাধানের কোনও ক্লু মেলেনি রঙ্গুর৷ সামান্য কিছু সূত্র মিলেছিল অন্য পাড়া থেকে৷

‘ওদের ওই টি এস্টেটের পাড়ায় পাড়ায় বাড়ি বাড়ি ঘুরতে শুরু করলাম৷ কেউ দেখেছে মেয়েটাকে বাইরের কারুর সাথে কথা বলতে? বাইরের লোক কে এসেছিল এইখানে? কোনও বাড়ির কোনও রিলেটিভস! কোনও ফ্রেন্ড! কোনও বাড়ির লোক বাইরে কাজ করে? কেউ রিসেন্টলি বাইরে কাজ করতে গেল নাকি! এই ডেল্লি মুম্বাই৷ সেই খুঁজছি খুঁজছি৷ হঠাৎ একজন বলল, হ্যাঁ একটা মোটা লেডি আর একটা ছেলের সাথে মেয়েটা চলে যাচ্ছিল৷ সেই ছেলেটাকে তো দেখি নাই কোনওদিন আগে৷ কিন্ত্ত লেডিটাকে দেখেছি আগেও৷ দু-তিনবার দেখেছি এখানে৷ খুব মোটা৷ স্মার্ট লেডিটা৷ মেয়েটা দেখি চলে যাচ্ছে ওই দুইজনের সাথে৷ আমরা ভাবলাম কী কোনও রিলেটিভ আছে তাই যাচ্ছে ওদের সাথে৷

এইরকম বলল জানেন৷ তো আমি ভাবছি কত্ত তো মোটা লেডি আছে! কত্ত পুরুষটা আছে! বুঝব কীভাবে? একটা কথা মাথায় এলো৷ এই টি এস্টেটে যখন লেডিটাকে দুই তিন বার দেখা গেছে হতে পারে কী লেডিটা এইখানেই কোথাও থাকে৷ সেই আবার জিজ্ঞাসা করছি আবার জিজ্ঞাসা করছি কোনও বাড়ি থেকে কোনও লেডি বাইরে কাজ করে কিনা! কারুর বাড়িতে বাইরে থেকে লোক আসে কিনা৷ এইরকম এইরকম ফেস৷ এইরকম ফিগার৷ এইসব বলে খুঁজছি শুধু৷

একজন বলল এইরকম একটা লেডিকে সে চেনে যার বাড়িতে বাইরে থেকে লোক আসে৷ সে দেখেছে লেডিটাকে মাঞ্ঝা টি এস্টেটে আসতে৷ ওর থেকেই শুনলাম ওই লেডিটার বাড়ি পুটুং৷ একটা ছেলের বাইকে চড়ে সেইদিনেই গেলাম পুটুং৷’
—পুটুং কোথায়?
‘এই এরিয়াতেই৷ দার্জিলিং ডিস্ট্রিকটেই৷’
—পাহাড়ে?

‘হ্যাঁ৷ পাহাড়েই৷ খুঁজতে খুঁজতে লেডিটাকে গিয়ে ধরলাম৷ কিছুতেই স্বীকার করে না৷ বলে না, এইরকম কোনও মেয়েকে চিনি না৷ আমি যাই নাই ওইখানে কোনওদিন৷

আমিও ছাড়ি না৷ পাকড়িয়ে রাখলাম৷ বললাম তোমার ছবি আছে মেয়েটার সাথে৷ ওই সব ফোটো পুলিশকে দেখিয়ে তোমার নামে এমন কেস দেবো যে কোনোদিন ছাড়া পাবে না৷’
—সত্যিই এইরকম ছবি পেয়েছিলেন? একটু থামিয়ে প্রশ্নটা করে বসলাম৷

‘না, না৷’ রঙ্গু হেসে ফেলে বললেন, ‘কোথায় কোন ফোটো? ফোটো বোটো কিচ্ছু নাই৷ মিথ্যা বলেছি৷’
রঙ্গুর সঙ্গে তখনও কোনও পুলিশ নেই৷ ট্র্যাফিকিং এর কী কেস, কী আইন কিছুই জানেন না৷ ট্রাফিকিং ব্যাপারটা আসলে কীরকম, কীভাবে হয়, এসব সবে জানতে শুরু করেছেন মাঞ্ঝা টি এস্টেটের সেই তেরো বছরের মেয়েটাকে খুঁজতে খুঁজতে৷

‘ওইসব বলে ভয় দেখিয়ে লাস্টে স্বীকার করল৷ ওই মেয়েটার সঙ্গে লেডিটা দেখা করতে গেছিল মাঞ্ঝা টি এস্টেটে৷ বাড়ির বাইরে কোথাও মেয়েটাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে কথা বলেছিল৷ প্রথমে ওই ছেলেটার কথা স্বীকার করছিল না৷ আবার চেপে ধরলাম৷ বললাম ঠিক করে বোলো কে ছেলে ছিল তোমার সাথে? কোথায় পাঠিয়েছ ওকে?
বলল, একটা ছেলের সাথে কাজে পাঠিয়েছি মেয়েটাকে৷
কে ছেলে? কী নাম?
ছেলেটা এইখানের না৷ নেপালের৷ করণ নাম ওর৷ ডেল্লি নিয়ে গেছে ওকে৷ মেয়েটা কাম করবে বলল৷’
—ওই মহিলাও গিয়েছিল মেয়েটির সঙ্গে?
‘না উনি যায়নি৷ এন জি পি স্টেশন অবধি ছিল সাথে৷ তারপর এন জি পি থেকে ট্রেনে উঠে ওই ছেলেটার সাথে মেয়েটা চলে গেল৷’

কনকনে ঠাণ্ডা সেই দুপুরে চোখের সামনে ভেসে উঠছিল— কোনও ঘন সবুজ চা বাগানের ভেতর মেয়েরা চা তুলছে৷ টু্যরিস্টরা ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলছে৷ ছেলে মেয়েরা ব্যাগ পিঠে ইস্কুল যাচ্ছে হাত ধরাধরি করে৷ এঁটো বাসন ধোয়া চলছে কোথাও৷ রাস্তার ট্যাপের জলে স্নান করছে কেউ৷ জলের কলে লাইন পড়ছে৷ দুপুরের ঘুমটা সবে গাঢ় হচ্ছে কারও, সেইরকম কোনও এক সময়ে এক কিশোরী অচেনা দু’জন মানুষের সঙ্গে ওই সবুজ চা বাগান ছেড়ে উঁচু নীচু ঢালু জমি ছেড়ে রওনা দিচ্ছে রুক্ষ শুষ্ক জলহাওয়ার অচেনা অজানা কোনও এক দূর শহরে৷ কাজের খোঁজে৷
রঙ্গুর বাগানের ফুলগুলি থেকে ক্ষীণ রোদের রশ্মিটা ঘরের জানালা দিয়ে টবের উপর কাঁটা কাঁটা ক্যাকটাসের উপর এসে পড়েছে৷

যেদিন মেয়েটি রওনা দিচ্ছিল নকশালবাড়ি ব্লকের মাঞ্ধা টি গার্ডেন থেকে, গ্রামে সকাল দুপুর রাত আর পাঁচটা দিনের মতোই ছিল৷ ওই সবুজ চা পাতার উপর বড় বড় শিশু গাছের নীচে হয়ত-বা তখন রোদ-ছায়ার খেলা চলছিল বা এক পশলা বৃষ্টি হয়ত ওদের মাটির দেয়াল বেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছিল কাদা হয়ে৷ ওই চা বাগানের কিছু দূর দিয়ে ইন্ডিয়া নেপাল সীমান্তের গা মাখামাখি করে মেচি নদী বয়ে চলেছিল অন্য দিনের মতোই৷ ওর ট্রেনটা হুইসিল দিচ্ছিল৷ মা বাবা ভাই বোন কারুর জানা ছিল না, ওর ট্রেনের চাকা গড়াচ্ছে পাথরের উপর পাতা ধাতুর লাইনের উপর দিয়ে ঘষে ঘষে দিল্লির দিকে৷ সামান্য কিছু ইনকামের আশায়৷ মা আর পাঁচজন চা বাগানের প্লাকারের মতোই নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছিল দিনের শেষে চা পাতা বাইদারের কাছে মাপ করিয়ে দিনের মজুরিটুকুর৷ হিসেব করছিল চাল আটা শাক কেনার টাকার৷ টের পায়নি হিসেবটা বদলে গেল এক্ষুনি৷ ঘরের ভেতরের হিসেবের একজন কমে গেল এইমাত্র৷

‘অনেক ঝগড়াঝাটির পর একটা এড্রেস জোগাড় করলাম ওই লেডির থেকে৷ প্লেসমেন্ট অফিসের এড্রেস৷ ডেল্লির৷ যেই ওই লেডিটার খোঁজ পেলাম এইখানকার পুলিশকে গিয়ে বললাম, ওই মিসিং মেয়েটার একটা খোঁজ পেয়েছি৷ পুলিশকে গিয়া জিজ্ঞাসা করছি কী কেস হবে এইসব! এইখানের পুলিশও তখন জানে না এইসব হিউম্যান ট্র্যাফিকিং কী আছে? ওরা ট্র্যাফিকিং মানে বোঝে ওই সব রোডের ট্র্যাফিক৷ পুলিশ বলল, ঠিক আছে! রঙ্গু, তোমার সাথে একটা পুলিশ দিচ্ছি৷ নাও তুমি যদি পারো খোঁজো৷ মেয়েটাকে পেলেই তো হল৷ ওসব কেস বেসের কথা ছাড়ো এখন৷

একজন লোকাল পুলিশ দিল আমার সঙ্গে৷ আমরা স্টার্ট করলাম এনজিপি থেকে৷ ট্রেনে৷ ওর ফাদার গেছিল সাথে৷ আর আমার একটা ফ্রেন্ড৷ আর ওই একটা পুলিশ৷ আর ডিল্লি রিচ করার পর ডিল্লি পুলিশ থেকে আরও একটা পুলিশ দিলো আমার সাথে৷ সেই প্লেসমেন্ট অফিস খুঁজছি খুঁজছি৷’
—সেই প্লেসমেন্ট অফিসের ঠিকানা পেয়েছিলেন ওই লেডির থেকে?

‘ঠিকানা একটা পাইছিলাম৷ সেটা ফেক৷ আসলে এরা কেউ একটা অফিসে থাকে না বেশিদিন৷ এই রুম রেন্ট করে অফিস বানালো আবার সেটা দুই পাঁচ মাস পরে ছেড়ে আবার একটা নিল৷ আবার নতুন অ্যাড্রেস৷ অনেক প্লেসমেন্ট অফিস আছে তারা ঠিকঠাক৷ তারা স্যালারি থেকে কমিশন নেয়৷ এগারো মাসের কন্ট্রাক্ট করায়৷ এরা তো পুরা বছরের মেয়েটার স্যালারিটা তুলে নিয়েছে ওই বাড়ি থেকে৷ মেয়েটার হাতে একটাও টাকা দেয় নাই৷ মেয়েটাকে বলেছে, তোর বাড়িতে টাকা পাঠিয়েছি৷ আর কোনোদিন বাড়িতে নিয়েও আসত না৷ এইভাবে লাখ লাখ কামিয়ে নিয়েছিল৷ জালি সব অ্যাড্রেস লিখে রেখেছে অফিসে ! ব্যাস আর কী!

একটা ফোন নম্বর দিয়েছিল ওই লেডিটা৷ সেই ফোন নম্বরে খুঁজতে খুঁজতে করণের অফিসটা বার করলাম৷ কী একটা হানুমান মন্দিরের পাশে ছিল৷ একটা রেন্টে নেওয়া রুম৷ করণ নাই৷ অন্য লোক ছিল৷ ওদের রেজিস্টার বার করালাম৷

দেখি রেজিস্টারে মেয়েটার ছবিটা ঠিক৷ কিন্ত্ত কী করেছিল জানেন, নামটা ফেক৷ বাবার নাম ফেক৷ পাশে ওর এজ কত লিখেছে জানেন! নাইন্টিন৷ এড্রেস বানায়ে বানায়ে ফেক দিয়া রেখেছিল৷ ওর নামে ফেক ফেক ভোটার কার্ড বানায়ে নিয়েছিল৷ ওইসব ফেক ডকুমেন্টস তৈরি করে চিপকে রেখে দিয়েছিল খাতায়৷
ওর ফাদারের কাছে মেয়েটার ওরিজিনাল ডকুমেন্টস ছিল৷ ওদের অফিসের ওই ছোট্ট পাসপোর্ট ছবি দেখে কে এত বুঝবে বলেন তো মেয়েটা থার্টিন কী নাইন্টিন! আর ওইসব যা লিখেছিল কে ওইসব লেখা ভেরিফাই করবে? সাপোজ এখান থেকে আমরা কেউ গেলাম না, শুধু কোনও পুলিশ গেলে সে দেখে কী ভাবতো! হ্যাঁ একটা নাইন্টিন ইয়ারসের মেয়ে ডোমেস্টিক কাজ করতে এসেছে৷ এডাল্ট৷ নিজের ইচ্ছাটাতে এসেছে৷ কী প্রবলেম?’

ভাবছি বসে আস্ত একটি মানুষের পুরো পরিচিতিটাই এতো সহজে বদলে দেওয়া যায়! যেসব মানুষ যে ভূ-প্রকৃতি যেসব পেশা যে জীবন যে জগতের গল্প শুনছি, সেসব এই নিয়ম কানুন আইন আদালত নানা রকম নম্বর লেখা আইডেন্টিটি কার্ডওয়ালা জগতেরই কথা৷ কিন্ত্ত কী অচেনা! কী অজানা! এতোদিনের সব জানা সূত্রগুলি গুলিয়ে যাচ্ছিল গল্প যত এগোচ্ছিল৷

ওই রেজিস্টারে ওর কাজের বাড়ির এড্রেসটা খুঁজতে খুঁজতে বার করলাম৷ পুরা মনে আছে এখনও সেই এড্রেসটা৷ সেক্টর টুয়েন্টি ফোর রোহিনী৷ নিউ ডেল্লি৷

ওই কমপ্লেক্সের বাইরে গিয়ে মেয়েটার ফোটো দেখাই৷ বলি এইখানে কী এইরকম একটা মেয়ে আছে?
একজন নেইবার বলল, হ্যাঁ৷ এই মেয়ে তো আছে৷ ওকে শুধু কচড়া ফেলতে একবার বাইরে দেখা যায়৷ আর কখনো ওকে দেখতে পাওয়া যায় না৷ হাসব্যান্ড ওয়াইফ জব করে৷ আর পাঁচ আর সাত বছরের দুইটা বাচ্চা আছে৷ ওর উপরে ছেড়ে ডিউটিতে চলে যায়৷ ঘরের কাজ বাজ সব করায় ওকে দিয়ে৷ মারধোর করে ওকে৷ মেয়েটা একদম উইক একদম দুব্লা হয়ে গেছে৷

ওই কমপ্লেক্সের বাইরে রোডে তখন আমরা দাঁড়িয়ে৷ রুম বাইরে থেকে লক৷ ঢুকতে পারছি না আমরা ওই ফ্ল্যাটে৷ রোড থেকেই ওর ফাদার চ্যাঁচাচ্ছে ওর নাম ধরে৷ সেই মেয়েটা কী যানো করতে এসেছিল ব্যালকনিতে৷ ফাস্ট ফ্লোরের ব্যালকনি৷ কী করল জানেন মেয়েটা! ওর ফাদারকে দেখেই ওখান থেকে জাম্প দিয়ে চলে আসতে চাইছিল ওর ফাদারের কাছে৷’

বলতে বলতে বালিশটা ছেড়ে দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে উঁচু হয়ে নিয়েছেন রঙ্গু৷ হাতটা উপরে তুলে বলছেন, ‘মেয়েটা ওই উঁচুতে৷ ও জাম্প করে আসবেই আমাদের কাছে৷ ব্যালকনিতে গ্রিল৷ জাম্প দিতে পারছে না৷ ছটফট ছটফট করছে গ্রিলের ভিতরে৷ পারছে না৷ কেঁদে চলেছে৷’

সেই মেয়েটাকে এই ঘরের ভেতর যেন রঙ্গু দেখতে পাচ্ছেন এক্ষুনি৷ যেন উনি বসে আছেন দিল্লির সেই রোডে৷ মাথার উপর খোলা আকাশ৷ চোখ দুটো কোনও এক হারিয়ে যাওয়া মেয়ের জন্য উতলা হয়ে উঠেছে৷ আমার পিছনের দেওয়াল জানলা যেন ওঁর চোখে সেক্টর টুয়েন্টি ফোর রোহিনীর ফ্ল্যাটবাড়ি৷ একতলার এই ছাতের নীচের দেয়ালটা যেন দুটো তলা হয়ে গেছে৷ তার ফার্স্ট ফ্লোরে ওঁর চোখ৷ সেখানে আটকে রয়েছে কোনও এক মেয়ে৷ তার নাম বয়স ঠিকানা সব সব ফেক হয়ে গেছে জগতের কাছে৷ চেহারাটা বদলে গেছে৷ সেই মাঞ্ধা গ্রামের সবুজ চা বাগানের পাশের মোটাসোটা মেয়েটা এখন রোগা, হাড় বেরিয়ে আছে শরীরের এখানে সেখানে৷ লম্বা লম্বা চুল আধা খেঁচড়া ছোট ছোট করে ছাঁটা৷ সে আকাশের তলায় আসতে পারে শুধুমাত্র ডাস্টবিনের নোংরার থলি যখন ওর হাতে আসে৷ হাতে গলায় পায়ে ঘাড়ে মুখে ঘা৷ চোখ নাক মুখ দিয়ে জল গড়িয়ে ভিজে যাচ্ছে৷ ছটফট করছে৷ লাফ দিতে চাইছে৷ যত উঁচু তলাই হোক৷ পায়ের নিচে শূন্যের উচ্চতা দেখার দরকার নেই ওর আর৷
—তারপর ওই ফ্ল্যাটে গেলেন?
‘কী করে ফ্ল্যাটে ঢুকব! গেটে লক করে দিয়ে যেত তো ওরা৷ ওই ফ্ল্যাটের হাসব্যান্ডটা যখন এলো তখন ঢুকলাম৷’
—ছাড়ল মেয়েটাকে?
‘কী করবে? সাথে পুলিশ দেখেছে না!

মেয়েটা বলে খুব মোটা ছিল আগে৷ আমি তো দেখি নাই আগে৷ ওর ফাদার বলল৷ দুব্লা হয়ে গেছে একদম৷ দেখি সারা বডিতে ঘা ভর্তি৷ চুলগুলি ছোটছোট করে ছাঁটা৷ থাকত কীরকম রুমে জানেন? রুমের বাইরে একটা প্যাসেজ কতগুলি কার্টেন কুলারের বক্স পানির ট্যাংক আর কুত্তার সাথে শুতে দিত ওকে৷ টি এস্টেটের ভিতর ওদের মাটির রুমটাও খুব খারাপ ছিল৷ কিন্ত্ত ওই অত্তো বড় সুন্দর একখানা ফ্ল্যাটের অত্তো খারাপ একখানা স্পেসে? খেতে দিত ওরা যা ফেলে দিত সেইগুলা৷ সেই নাইটে ডেল্লির একটা হোটেলে স্টে করলাম৷ তার পরের দিনে ট্রেনে চাপলাম৷ এনজিপি এসে মেয়েটা ওর বাড়ি ফিরে গেল ওর ফাদারের সাথে৷ মেয়েটির বিয়া হয়ে গেছে শুনেছি৷ ও এখন টি গার্ডেনে কাজ করে৷ প্লাকার৷’
কথা শুনতে শুনতে রোদটা কখন রঙ্গুর মুখে এসে পৌঁছেছে৷ জিজ্ঞাসা করলাম, কেমন লাগল মেয়েটিকে ফিরিয়ে এনে?

রোদমাখা মুখে রঙ্গু হেসে ফেললেন অনেকখানি৷ চোখদুটো আবার চকচক করে উঠল৷ বললেন, ‘উফ! কী যে আনন্দ হয়েছিল সেদিন! এমন খুশি লেগেছিল না ওকে নিয়া যখন ডেল্লি থেকে ট্রেনে উঠছি৷ খুব আনন্দ…খুব আনন্দ…৷ বুঝলাম আমি পারব৷ মেয়েদের রেসকিউ করতে পারব৷ কনফিডেন্ট হয়ে গেলাম পুরা৷ পারবো আমি!
(ক্রমশ)