• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

উনিশে মে’র ভাষা আন্দোলন এখনও জারি আছে!

স্বপনকুমার মণ্ডল বাংলা ভাষা বাঙালির পরিচয় বহন করে৷ কিন্ত্ত ইংরেজি যেমন ইংরেজের ভাষায় সীমাবদ্ধ নয়, বাংলাও তেমনই বাঙালির একান্তই আপন ভাষার গণ্ডি অনেক কাল আগেই পেরিয়ে এসেছে৷ বাংলা ভাষার এই আভিজাত্য এবং আধিপত্য তার শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির মাধ্যমে গডে় ওঠার মূলে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের অবদানকে অস্বীকার করার উপায় নেই৷ ব্রিটিশেরা এদেশে তাদের ইংরেজি ভাষা শিখিয়ে

স্বপনকুমার মণ্ডল

বাংলা ভাষা বাঙালির পরিচয় বহন করে৷ কিন্ত্ত ইংরেজি যেমন ইংরেজের ভাষায় সীমাবদ্ধ নয়, বাংলাও তেমনই বাঙালির একান্তই আপন ভাষার গণ্ডি অনেক কাল আগেই পেরিয়ে এসেছে৷ বাংলা ভাষার এই আভিজাত্য এবং আধিপত্য তার শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির মাধ্যমে গডে় ওঠার মূলে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের অবদানকে অস্বীকার করার উপায় নেই৷ ব্রিটিশেরা এদেশে তাদের ইংরেজি ভাষা শিখিয়ে কেরানি করার প্রয়াস চালিয়েছিল৷ বাঙালিরা কেরানিকুলে বাবুগিরি ফলিয়েছে বটে, কিন্ত্ত সেইসঙ্গে বিজাতীয় ভাষার মাধ্যমে স্বজাতির ভাষাকেও অভিজাত করায় তৎপর হয়েছে৷ ফলে বাঙালি সেদিন বিমাতার কোলে বসে স্বমাতার কথা ভেবেছে৷ এজন্য ‘দেশের কুকুর ধরি বিদেশের ঠাকুর ছাড়িয়া’ বলার শক্তি ইংরেজি না জানা বাঙালি সেদিন আয়ত্ত করতে পেরেছিল৷ ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলার নবজাগরণের পথকে ব্রিটিশরাই সেদিন প্রশস্ত করে দিয়েছিল৷ নব্যভারতীয় আর্য ভাষার নির্মোক থেকে মাগধী অপভ্রংশের পথ বেয়ে পূর্বের যে তিনটি ভাষা যথা বাংলা, উডি়য়া ও অসনীয়ার উৎপত্তি হয়েছিল, তার প্রথমটির আবির্ভাব-বিকাশ এবং উত্তরণ অন্য দুটির তুলনায় যে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে, তার জন্য আর প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না৷ এজন্য অবশ্য বাংলা ভাষা বিকাশের ক্ষেত্রে ব্রিটিশদের পরোক্ষ সহযোগিতার বিষয়টি বিশেষ সুবিধা প্রদান করেছিল৷ তার ফলে ১৮২৬-এ কামরূপ ও ১৮৩২-এ কাছাড় রাজ্য দখল করার পর বৃটিশ সরকার ১৮৩৬-এ কাছাডে়র সরকারি ভাষাকে অনুসরণ করে কামরূপ তথা আসামেরও সরকারি ও শিক্ষাজগতের ভাষা হিসাবে বাংলাকে চাপিয়ে দেয়৷ এর জন্য আসামের অভিজাত ও মধ্যবিত্ত শিক্ষিতসমাজ প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠেনি, বরং অনন্যোপায়ে শ্রদ্ধাই পোষণ করেছে৷ যার ফলে দেখা যায় আসামের এবং অসমিয়া ভাষার নবজাগরণের পুরোধা ব্যক্তিত্বদের অন্যতম পথিকৃৎ তথা হিন্দু কলেজের প্রাক্তন ছাত্র (১৮৪১-৪৪) আনন্দরাম ঢেকিয়াল ফুকনও (১৮২৯-১৮৫৯) আসামের বিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষার অপসারণ চাননি৷ এমনকি তিনিই ১৮৫৫-তে বাংলা ভাষায় আইন ও রাজনৈতিক দর্শন বিষয়ে প্রথম বই লেখেন৷ কিন্ত্ত সেদিন তিনি বাংলা ভাষার অপসারণ না চাইলেও অসমিয়া ভাষা তথা তাঁর মাতৃভাষার দাবিকে উচ্চকিত করায় সক্রিয় হয়েছিলেন৷ ফলে ১৮৩৬ -এ আসামিদের উপর বাংলা ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিষয়টি অসমীয়া ও বাংলা এই দুই সহোদরার মধ্যে দ্বন্দ্বের পথ ক্রমশ জটিল করে তুলেছিল৷ যার সুদূরপ্রসারী করুণ পরিণতিতে ১৯৬১-এর উনিশে মে বাঙালির ট্রাজিক জীবনে আরেকটি রক্তাক্ত ভাষা দিবসের সূচনা হয়৷ ফলে ১৯৫২-র ‘অমর একুশে’র আলোয় উনিশে মে’র দিনটি সেভাবে আমবাঙালির মনে নিবিড়তা লাভ না করলেও তার আবির্ভাবের কালমূলটি যে অনেক গভীর পর্যন্ত প্রসারিত, তা সহজেই অনুমেয়৷ শুধু তাই নয়, অন্যভাবে ভেবে দেখলে উনিশে মে’র ভাষা দিবসটি ‘অমর একুশে’র তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে প্রভাবশালী এবং সংকটময় ছিল৷

অমর একুশে যেখানে একই দেশের দুটি সুদুরবর্তী ভূখণ্ডের একটিতে শাসক বনাম শাসিতের দ্বন্দ্ব এবং যার সঙ্গে দেশের বিপুল সংখ্যক আমজনতার সঙ্গত ছিল, সেখানে ‘উনিশে মে’ একটি রাজ্যের শাসকের সঙ্গে তার একটি অঞ্চলের সীমাবদ্ধ শাসিতের সংগ্রাম৷ ‘অমর একুশে’র প্রভাব শাসক এবং শাসিতের উভয়ের মধ্যেই পডে়ছিল৷ কিন্ত্ত একই রাজ্যের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে বসবাসকারী বাঙালিদের ভাষিকচেতনায় ঐক্য গডে় ওঠা সম্ভব হলেও সেই রাজ্যের অধিবাসীদের আগ্রাসী ভাষাপ্রেম এবং তাদের শাসককুলের আধিপত্যের আনুকূল্যের মধ্যে থেকে আন্দোলন সুসংগঠিত করে সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়া সহজসাধ্য ছিল না৷ কেননা এর সঙ্গে ‘অমর একুশে’র মতো এতে পরোক্ষে দেশপ্রেম যুক্ত ছিল না৷ অথচ ভাষিক চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে এই অঞ্চলের বাঙালিরা অস্তিত্ব রক্ষা করার মধ্যে দিয়ে যেভাবে আত্মাহুতি দিতে একজোট হয়ে আন্দোলনে সামিল হয়েছিল, তা ভাবলে বাঙালির ভাষাপ্রেমের পরাকাষ্ঠা খুঁজে পাওয়া সহজ, কিন্ত্ত সেইসঙ্গে তাতে তার যূপকাষ্ঠটিও তলদেশ থেকে বুক চিতিয়ে উপরে উঠে আসে৷ যার ফলে ‘অমর একুশে’ বাঙালিকে স্বদেশ ফিরিয়ে দিয়েছে, কিন্ত্ত ‘উনিশে মে’ স্বদেশে পরবাসী বাঙালিদের স্বদেশে তো ফিরিয়ে আনতে পারেইনি, বরং পরদেশ আরও পর করে তুলেছে৷ আসামের বাংলা এবং অসমীয়ার দ্বৈরথ এখন বাঙালি আর আসামীর মনোরথকে বিষিয়ে তুলেছে৷ তার করুণ পরিণতিতে বাংলা নয়, বাঙালিকেই ‘খেদা’ বলে সমূলে উৎপাটনের প্রয়াস চলেছিল এবং এখনও যা অব্যাহত বলে আতঙ্ক রয়েছে৷ ফলে বরাক উপত্যকার বাঙালিদের কাছে ‘উনিশে মে’ ভাষামুক্তির বিশল্যকরণীতে পরিণত হয়নি৷ শুধু তাই নয়, এর ফলে এই অঞ্চলের বাঙালিদের বারবারই উনিশে মে’র মুখোমুখি হতে হচ্ছে৷ অথচ নানাভাবে বিচ্ছিন্ন বাঙালি ‘অমর একুশে’র সাফল্যকে উচ্চকণ্ঠে নিনাদিত করে ভাইয়ের রক্তে রাঙানো দিনটির কথায় আবেগপ্রবণ হয়ে পডে়, কিন্ত্ত ‘উনিশে মে’র বিষাণ যে এখনও থামেনি, সেদিকে কর্ণপাতের সময় নেই৷ ফলে অমর একুশে আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছে গেলেও বাঙালি এখনও দেশেই আটকে আছে৷ পরকে আলো দিতে গিয়ে অমর একুশে’র নীচে কি উনিশে মে’র অন্ত্যজ অন্ধকার? বরাক উপত্যকার ভূমিপুত্র তথা বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ তপোধীর ভট্টাচার্যকে তাই বোধ হয় দ্বিধাহীনভাবে বলতে হয় : ‘বরাক উপত্যকার এই ভাষা-বাস্তবতা ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়৷ এখনও অব্যাহত রয়েছে অসমিয়াকরণ প্রকাশ্যে সরকারি মদতে এবং অক্ষুণ্ণ রয়েছে প্রতিরোধও৷’