কেন্দ্রে মোদি সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে ১৯৬৭ সালের মূল বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন (ইউএপিএ) সংশোধন করে ২০১৯ সালে আরও দানবীয় চেহারা দেওয়া হয়৷ নয়া আইনের সংস্থান অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে এখন যে কোনও ব্যক্তি বা সংগঠনকে সন্ত্রাসবাদী হিসেবে ঘোষণা করার ক্ষমতা রয়েছে৷ এই আইনের রাজনৈতিক অপব্যবহারের আশঙ্কায় বিরোধীরা প্রবল আপত্তি জানালেও সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংসদের দুই কক্ষেই সংশোধনী বিলটি পাশ করিয়ে নেয় মোদি সরকার৷ ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে রাষ্ট্রপতির সম্মতি মেলায় চালু হয়ে যায় এই ভয়াবহ আইন৷
এই কুখ্যাত ইউএপিএ আইনে মামলা ও ধরকাপড়ের সংখ্যা মোদি আমলে মারাত্মকভাবে বেড়ে গিয়েছে৷ ধরপাকড় ও বিনা বিচারে মূলত বিরুদ্ধ স্বরকে জেলে আটকে রাখাই লক্ষ্য মোদি সরকারের৷ ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বু্যরো (এনসিআরবি)’র ২০২৩ সালে প্রকাশিত রিপোর্টে জানিয়েছে, শুধু কুখ্যাত আইনের প্রয়োগই নয়, এই আইনকে কাজে লাগিয়ে বিরোধীদের জেলে পুরে রাখার ঘটনাও বেশি ঘটেছে ডাবল ইঞ্জিন সরকারের রাজ্যে, মানে কেন্দ্রের মোদি সরকারের পাশে যে রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় আছে সেখানেই সবচেয়ে বেশি ব্যবহূত হয়েছে এই আইন, বিরোধী কণ্ঠস্বর দমনের জন্য৷ ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত এনসিআরবি’র রিপোর্টে সরকারিভাবে এই তথ্য কবুল করা হয়েছে৷ বলা হয়েছে, ২০২২ সালেও ইউএপিএ’তে নথিভুক্ত মামলা আগের বছরের তুলনায় এক লাফে বেড়েছে ১৭.৯ শতাংশ৷
তবে এটা লক্ষ্যণীয়, আইন প্রয়োগ হলেও গত দশ বছরে মোদি সরকারের এই আইনে দোষী সাব্যস্তের সংখ্যা নগণ্য মাত্র৷ হিসাব বলছে, ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে এই আইনে ৮,৩৭১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে৷ বিনা বিচারে তাঁদের জেলে পুরে রাখা হয়েছে৷ কিন্ত্ত এই পাঁচ বছরের মধ্যে এই আইনে দোষী সাব্যস্ত হয়ে সাজা পেয়েছে মাত্র ২৩৫ জন৷ শতাংশের হিসাব ধরলে সাজাপ্রাপ্তির হার ৯৭.২ শতাংশ৷ তথ্যেই প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে, মোদি সরকার মূলত বিরোধীদের জেলে পুরে রাখতেই এই আইন ব্যবহার করেছে৷ তা ছাত্রনেতা উমর খালিদ হোক কিংবা বর্ষীয়ান কবি, সমাজকর্মী ভারভারা রাও৷ তেমনই সমাজকর্মী সুধা ভরদ্বাজ বা সাংবাদিক প্রবীর পুরকায়স্থ৷ এঁদের বেশির ভাগ গ্রেফতারই বেআইনি৷ কিন্ত্ত এই আইনের আওতায় ধরলে বিনা বিচারে যতদিন খুশি জেলে আটকে রাখা যায়৷ তাই তার ফয়দা লুটছে মোদি-শাহ জুটি৷ সুপ্রিম কোর্ট প্রবীর পুরকায়স্থকে ছেড়ে দিয়ে এদের সেই ষড়যন্ত্রকেই বেআব্রু করে দিয়েছে৷
এনসিআরবি’র বার্ষিক রিপোর্ট জানাচ্ছে, ২০২১ সালে সারা দেশে ইউএপিএ’তে নথিভুক্ত মামলার সংখ্যা ছিল ৮১৪টি৷ ২০২২ সালে সেই সংখ্যা একলাফে বেড়ে হয়েছে ১,০০৫৷ দু’বছর আগে ২০২০ সালে ইউএপিএ’তে মোট ৭৯৬টি মামলা নথিভুক্ত হয়েছিল৷
কেন্দ্রের বিজেপি-আরএসএস আমলে বিতর্কিত ইউএপিএ’র ধারায় ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও সমাজকর্মী সহ অসংখ্য প্রতিবাদী মানুষের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও সাজানো মামলা চাপানো হয়েছে৷ বিনা বিচারে দিনের পর দিন জেলে আটকে রেখে তাঁদের যথেচ্ছ হয়রানি করা হচ্ছে৷ ২০২৩ সালের অক্টোবরে একই কায়দায় সাজানো অভিযোগে িউএপিএ’তে জেলে পোরা হয়েছিল স্বাধীন সংবাদ পোর্টাল ‘নিউজক্লিক’-এর প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থকে৷ সুপ্রিম কোর্ট প্রবীর পুরকায়স্থকে অবশ্য খালাস করে দিয়েছে৷ এখনও কমপক্ষে ১৬ জন সাংবাদিকের ঘাড়ে ঝুলছে ইউএপিএ’র খাঁড়া৷
এর আগে সিএএ-এনআরসি বিরোধী ছাত্রনেতা উমর খালিদ, কবি ভারভারা রাও, দলিত অধিকার আন্দোলনের বিশিষ্ট কর্মী অধ্যাপক আনন্দ তেলতুম্বদে, সুধীর ধাওয়ালে, সমাজকর্মী সুধা ভরদ্বাজ, ভারনন গঞ্জালভেস, অরুণ ফেরেইরা, মহেশ রাউথ, রোনা উইলসন, অধ্যাপিকা সোমা সেন, অধ্যাপক হানি বাবু, আইনজীবী সুরেন্দ্র গ্যাডলিঙ, সাংবাদিক গৌতম নাভলাখার মতো প্রতিবাদীদের জেলবন্দি করা হয়েছে৷ সরকারের হিংস্রতম অত্যাচরের পরিণতিতে বিচার বিভাগীয় হেফাজতেই মারা যান এদেশের মানবাধিকার ও আদিবাসী অধিকার আন্দোলনের কর্মী অশীতিপর ফাদার স্ট্যান স্বামী৷
প্রসঙ্গত, ইউএপিএ মূলত সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার আইন হলেও মোদি আমলে এখন এটির যত্রতত্র অপব্যবহার করা হচ্ছে৷ ‘সন্ত্রাসবাদ’ মোকাবিলার নামে বাস্তবে রাজনৈতিক বিরোধীদের মুখবন্ধ করতে এবং তাঁদের জেলে পাঠাতেই দানবীয় চরিত্রের ইউএপিএ আইনকে কাজে লাগানো হচ্ছে, এই অভিযোগ এখন দেশজুড়ে৷