শোভনলাল চক্রবর্তী
সম্প্রতি ভারত সরকারের স্বাস্থ্য বিষয়ক একটি রিপোর্টে উঠে এসেছে এক অদ্ভুত তথ্য৷ রিপোর্ট অনুযায়ী ৫৬ শতাংশ ভারতীয়ের অসুস্থতার কারণ অসংযমী ও বিকৃত খাদ্যাভাস৷ একবিংশ শতাব্দীর উন্নত প্রযুক্তির অধিকারী মানুষের খাবারের টেবিলে ৫০ থেকে ৮০ শতাংশই শস্যবীজের দখলে৷ প্রাতরাশের রুটি, পাউরুটি, কেক, বিস্কুট, স্যান্ডউইচ বা গ্রামবাংলার পান্তা; মধ্যাহ্নভোজের ভাত বা রুটি, বিকালের জলখাবারের মুডি়, বাদাম, চপ, কাটলেট, পিৎজা, পাস্তা আর রাতের খাবারের রুটি বা ভাত — এই গুলোই খাবারের প্রধান অংশ৷ সঙ্গের পদগুলো বৈচিত্র্যময় হলেও পরিমাণের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাধান্য পায় না৷ ভাত বা রুটি আমাদের প্রধান খাবার; যদিও পৃথিবীর কোন কোন জনগোষ্ঠীর খাবারের থালায় মাঝেমধ্যে প্রধান খাদ্য হিসেবে আলুর দেখা মেলে৷
তা সে চালই হোক বা গমই হোক, ঘাস জাতীয় শস্যদানার অবিকৃত গঠন একই রকম৷ বর্তমানে প্রচলিত ধান থেকে চাল বানানোর মেশিনে ধানের বাইরের খোসা (ব্রান) আর মধ্যবর্তী অঙ্কুর বা বীজযুক্ত আবরণ (জার্ম) ছাডি়য়ে ভেতরের সাদা (এন্ডোস্পার্ম) অংশটি ব্যবহারের জন্য আলাদা করা হয়৷ চাল ও আটার সওদাগরেরা প্রায় ২৫ ধরণের রাসায়নিকের সন্ধান জানেন যার দ্বারা এরপরে একে আরও চকচকে, লোভনীয় ও সুস্বাদু বানানো হয়৷ ধান গাছের নিজের বংশবৃদ্ধির জৈবিক প্রয়োজনের অঙ্কুরটি হল মাঝের “জার্ম” অংশটি৷ তাকে রক্ষা করার জন্য ও অঙ্কুরোদগমের সময় প্রয়োজনীয় ভিটামিন যোগায় বাইরের খোসাটি৷ ভেতরের সাদা যে অংশটি আমরা চাল হিসাবে বেছে নিই সেটা মামুলি ভিটামিন ও অন্যান্য পুষ্টিগুণ বর্জিত জটিল শর্করা৷ চালের তুষে বাইরের খোসা আর মাঝের প্রাক- অঙ্কুর (জার্ম) থাকে৷
ভবিষ্যতের শিশু উদ্ভিদটির বীজের (মূলতঃ প্রোটিন) পুষ্টির প্রয়োজনীয় সংকেতওয়ালা জিন এই মধ্যেকার আবরণে থাকে৷ বাইরের খোসায় থাকে প্রতিরক্ষার বর্ম হিসাবে ফাইবার, ভিটামিন আর প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থ৷ মধ্যেকার এন্ডোস্পার্ম অংশ, যেটাকে আলাদা করে পরিশোধিত চাল অথবা সাদা আটা আর ময়দা খাবার জন্য ব্যবহার করা হয় সেটা নিছক শর্করা৷ বীজ থেকে জন্মানোর পরে সদ্য অঙ্কুরিত উদ্ভিদটির পাতা সৃষ্টির আগে পর্যন্ত (অর্থাৎ যখন নবঅঙ্কুরিত উদ্ভিদটি সালোকসংশ্লেষের বা photosysthesis মাধ্যমে খাদ্য প্রস্তুতের জন্য অপরিণত) উদ্ভিদের শর্করার প্রয়োজন মেটায় ভেতরের এন্ডোস্পার্ম অংশটি৷ শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট অপেক্ষাকৃত সস্তা আর আসক্তি উদ্রেককারী খাবার৷ তাই সহজে আমাদের খাবারে বড় অংশের অংশীদার হয়ে পডে়৷ যত চকচকে সুদৃশ্য লম্বাদানার পালিশ করা পরিশোধিত চালের ভাত হবে, পেট ভরানোর জন্য তত বেশী পরিমানের ভাতের প্রয়োজন হবে আর তাড়াতাডি় হজম হয়ে আবার খিদে পাবে৷ শর্করা জাতীয় খাবারে আসক্তি আমাদের অগোচরে ঘটে যায়৷
মিষ্টির দোকানের প্রতি আকর্ষন একরকমের প্রাদুর্ভাবের মত আমাদের আগ্রাস করেছে যদিও এটা আমাদের সহজাত প্রবৃত্তি নয়৷ ঘটনাচক্রে শর্করা জাতীয় খাবারের প্রতি এই আসক্তি সচেতন পশ্চিমী দুনিয়ার প্রতিপত্তিবান নাগরিকদের চেয়ে আমাদের মত গরিব দেশগুলোর (ধনী দরিদ্র সবার) মধ্যে বেশী পরিমানে দেখা দেয়৷ গত শতাব্দীর আটের দশকের জনপ্রিয় হলিউডের চলচিত্র “প্রেটি উওম্যান”-এর একটা দৃশ্যের কথা প্রাসঙ্গিক৷ বিলাসবহুল হোটেলের পেন্টহাউসের প্রাতরাশের টেবিলে ধনী নায়ক গরীব নায়িকার সামনে সযত্নে চয়ন করে রাখা ফল, বেরি আর সসেজ-স্যালামি পুর্ণ দুটো থালা পেশ করলেন৷ প্রিয় নায়কের ভালোবাসা মেশানো সুষম খাবারের প্রাতরাশের থালা ঠেলে ফেলে, নায়িকা দূরে রাখা ঝুডি় থেকে ময়দা-মাখন-মিষ্টির সংমিশ্রণে তৈরী মিষ্টি পাউরুটি তুলে নিলেন৷ এক বা দুই পুরুষ আগেও খাবারের থালায় ঢেঁকিছাঁটা চাল থাকতো, প্রাতরাশে চিডে়, মুডি়, থাকতো৷ বরিশালের বালাম চালের কথা শুনেছেন? লালচে ঢেঁকিছাঁটা বালাম চালের খ্যাতি আছে৷ ঘরোয়া এবং নিকট প্রতিবেশী দেশের সেই খাদ্যসংস্কৃতি অবহেলা করে দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা পশ্চিমী খাবারের বাছাই করা ক্ষতিকারক খাবারগুলো গ্রহণ করেছি৷ স্বাস্থ্যহানিকর বিস্কুট, পাউরুটি ও অজস্র বেকিং করা খাবার, চটজলদি খাবার, মেশিনে ছাঁটা সুদর্শন সুঘ্রাণযুক্ত চালের ভাত আমাদের খাবারের মূখ্য অংশ৷
ইদানিং কালে যে উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগের বাড়বাড়ন্তের কথা শোনা যাচ্ছে তার প্রধাণ কারন বিকৃত খাদ্যাভ্যাস৷ আঠারোশো খ্রিস্টাব্দে বিদেশে যন্ত্রচালিত ধান ও গম ভাঙা কলের আবিষ্কার হয়েছিলো৷ বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে সেই প্রযুক্তি আমাদের গ্রাস করে আমাদের খাদ্যাভ্যাস পালটে দিয়ে৷
বংশ পরম্পরায় আমাদের রোগ সৃষ্টিকারী জিনের পরিবর্তন করে আমাদেরকে দুনিয়ার সবচেয়ে হৃদরোগের ও ডায়াবেটিসের মত মারণ রোগের উপযোগী করে তুলেছে৷ আরও কারণ আছে, তবে খাদ্যাভ্যাসের ভূমিকা মূখ্য৷ আমরা পেটে যা ঢোকাচ্ছি, তাই দিয়েই তৈরী হচ্ছে আমাদের পার্থিব এই শরীর৷ কখনো কখনো পরিশোধিত শস্যদানা বা তার থেকে প্রস্তুত খাদ্যবস্তুতে অতিরিক্ত ভিটামিনের অন্তর্ভুক্তির (enriched, fortified) কথা বলা হয়ে থাকে৷ সেটা পরিমাণে প্রাকৃতিক পরিমাণের চেয়ে কম ও মানের দিক দিয়ে সেগুলো অত্যন্ত নিম্নমানের৷ এখন বাজার ব্রাউন পাউরুটিতে ছেয়ে গেছে, তারমধ্যে অধিকাংশই কেবল রঙ করা সাদা পাউরুটি মাত্র৷
তাহলে উপায় কি? গম জাতীয় শস্যদানা থেকে প্রস্তুত আটার ক্ষেত্রে পূর্ণদানা থেকে প্রস্তুত খাবার, রুটি ইত্যাদি ব্যবহারে অসুবিধা নেই৷ কেবল বাদামি রঙ দেখে পূর্ণদানার পাউরুটি চেনা যাবে না, প্যাকেটের ওপরে “whole grain” লেখা আছে কিনা দেখে নিতে হবে৷ কৃত্রিম উপায়ে পালিশ করা নয়, মোটা দানা লালচে চালের ভাতই শ্রেয়৷ পেট ভরানোর জন্য এই চালের ভাত পরিমাণে কম লাগে বলে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণেও সাহায্য করে৷ সুস্বাদু, সুদর্শন আর সুগন্ধিত নয় এই সব কারন ছাড়াও পূর্ণদানার শস্য থেকে তৈরী খাবার বেশী চিবোতে হয় বলেও অনেকের এটা অপছন্দ৷ মনে রাখতে হবে, এটা এগুলোর গুণ হিসাবে দেখা উচিত৷ বেশী চিবোনোর জন্য খেতে সময় বেশী লাগলে আমাদের ভক্ষণ প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রক মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস সক্ষমভাবে কাজ করতে পারে৷ ওজন বশে রাখায় এটা বেশ কাজে আসে৷ তন্ত্তসমৃদ্ধ আস্তদানার গমের আটা ও মোটা লালচে চালের ভাত অনেকক্ষণ পাকস্থলীতে থেকে নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় বহুক্ষন ধরে শক্তি যোগাতে থাকে, কৃত্রিমভাবে তাড়াতাডি় খিদে পায় না৷ খাবারে শস্যদানা মুখ্য অংশ অধিকার করে থাকলেও এর অপরিহার্যতা সব বৈজ্ঞানিকগন স্বীকার করেন না৷ কৃষি-প্রযুক্তি উদ্ভাবনের আগে আদিম মানুষ শস্যদানা ছাড়াই জীবিকা নির্বাহ করত৷ শস্যদানার এই বিকৃত রূপে অভ্যস্ত হবার পিছনে ব্যবসায়িক ষড়যন্ত্র আছে৷
পরিশোধিত শস্যদানায় মধ্যেকার জার্মের অংশ না থাকার জন্য গুদামে আর খাবারের দোকানের আলমারিতে বহুদিন পর্যন্ত শস্যদানা সংরক্ষণ করা যায়৷ আসলে আমরা শস্যদানা ছাড়াই বেশ সুস্থ থাকতে পারি৷ সেটা বড় বিপ্লব৷ যতক্ষণ না সেটা সম্ভব হচ্ছে, শস্যদানার পরিমাণ কমানো ও তার গুণমান পরিবর্তন করা জরুরি৷ রান্নাঘরে এই বিপ্লব করতে পারলে আমাদের শরীর আমাদের প্রচেষ্টা কে অনেক ধন্যবাদ দেবে৷ “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে”-প্রবচনটা ভুলে ভরা৷ কোন মা যেন এটা বিশ্বাস না করে৷ ইস, আমার স্কুল জীবনে আমাকে যদি এ সব কথা বিশ্বাস জাগানোর মত করে কেউ বলতো! খাবারের শস্যদানার নির্বাচনের সময় তার সঙ্গে অঙ্কুরিত ডাল ও ছোলা জাতীয় খাবার (স্প্রাউট, লেগুম) অন্তর্ভুক্ত করলে বিশেষ লাভ হবে৷ এতে প্রয়োজনীয় ফাইবারের সাথে সাথে ভিটামিন ও বেশ খানিকটা প্রোটিনও পাওয়া যাবে৷ প্রাকৃতিক ভিটামিন কৃত্রিম রাসায়নিক উপায়ে প্রস্তুত ভিটামিনের চেয়ে বেশী কাজে আসে৷ অঙ্কুরিত শস্যদানার শর্করা খাবারের থালায়ই মলটোজে পরিণত হয়ে হজমের প্রথম ধাপ পেরিয়ে থাকে৷ বদ হজমের সম্ভাবনা নির্মূল করে৷
খাবারে শস্যদানার সাথে কাঁচা বাদাম জাতীয় খাবার মিশিয়ে খাবার প্রস্তুত করলে বিশেষ উপকার হয়৷ এতে রক্তে চিনির মাত্রা কমে ও উপকারী অসম্পৃক্ত ফ্যাট পাওয়া যায়, যেটা রক্তের ক্ষতিকারক লঘু ঘনত্বের কোলেস্টেরল কমায়৷ কিন্ত্ত কে শোনে কার কথা! এ ছাড়া বাজারে রয়েছে ছোট, বড়, বৃদ্ধ সমস্ত বয়সের মানুষের জন্য নানারকম হেলথ ড্রিংক, যেগুলি স্টেরয়েডে ভরা৷ এগুলো পান করা মানে শরীরের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ন অঙ্গের হানি করা, যার মধ্যে প্রথম নাম কিডনি৷ কিন্ত্ত আমরা বিজ্ঞাপনে মজেছি৷ আমাদের কে রক্ষা করবে?