• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

উচ্চমাধ্যমিকের কৃতীর লক্ষ্য ব্যতিক্রমী ভবিষ্যতের

স্বপনকুমার মণ্ডল: এবছর উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরিয়েছে৷ স্বাভাবিক ভাবেই তাতে কৃতী ছাত্রদের কাছে কয়েকটি ধরাবাঁধা প্রশ্ন ছুটে আসে৷ এই রেজাল্ট প্রত্যাশিত কিনা, বা, এজন্য কীরকম প্রস্তুতি নিয়েছিলে গোছের পরেই যে প্রশ্নটি ধেয়ে আসে, তা হল, এখন ‘তুমি কী নিয়ে পড়বে’ বা ‘তোমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী’৷ মোদ্দা কথা, ‘তুমি কী হতে চাও’-এর কৌতূহলের বাতিক অজান্তেই প্রশ্নের মুখে উঠে

স্বপনকুমার মণ্ডল: এবছর উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরিয়েছে৷ স্বাভাবিক ভাবেই তাতে কৃতী ছাত্রদের কাছে কয়েকটি ধরাবাঁধা প্রশ্ন ছুটে আসে৷ এই রেজাল্ট প্রত্যাশিত কিনা, বা, এজন্য কীরকম প্রস্তুতি নিয়েছিলে গোছের পরেই যে প্রশ্নটি ধেয়ে আসে, তা হল, এখন ‘তুমি কী নিয়ে পড়বে’ বা ‘তোমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী’৷ মোদ্দা কথা, ‘তুমি কী হতে চাও’-এর কৌতূহলের বাতিক অজান্তেই প্রশ্নের মুখে উঠে আসে৷ যেন সেই শিক্ষক-ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার উত্তর এল বলে৷ সেখানে পেশায় উচ্চ পদমর্যাদার চেয়ে সামাজিক প্রতিষ্ঠা আপনাতেই আভিজাত্য লাভ করে৷ শুধু বড়সড় কেউকেটা হলেই চলে না, সমাজসেবার আদর্শ তাতে সমান সচল৷ এজন্য সংবাদমাধ্যমের সরাসরি সম্প্রচার মাধ্যমের সাংবাদিকদের কৃতীদের ছেকে ধরে ছকবন্দি প্রশ্নবাণ ছুটিয়ে তার উত্তর পাইয়ে দেওয়ার অস্থিরতাকে তীব্র প্রতিযোগিতা মনে হলেও সকলের মধ্যেই তার উত্তর মেলানোর গা ছাড়া ভাব জেগে থাকে৷ যেন সবাই সেগুলি জানে, শুধু মিলিয়ে নেওয়ায় অপেক্ষামাত্র৷ প্রশ্নগুলি যেমন কমন, উত্তরগুলোই প্রায় একই গড়নের৷ এবার তাতেই তাল কাটল৷ এ বছর উচ্চমাধ্যমিকে রাজ্যের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানাধিকারী নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের সৌম্যদীপ জানিয়ে দেয়, সে রাশিবিজ্ঞানী হতে চায়৷ ব্যতিক্রমী উত্তর শুনে সাংবাদিকের অনেকেই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার না হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিলেও তার অনিচ্ছার কারণ জানতে চাইলে সপাটে সে জানিয়ে দেয় সবাই ডাক্তার হলে রোগী হবে কে ! এতে যেমন প্রশ্ন, তেমনই উত্তরের মোক্ষম দাওয়াইয়ে স্বাভাবিকভাবেই সেই ভিডিও ক্লিপটি ভাইরাল হয়ে যায়৷ যেন অনেকদিন পরে কেউ মুখের মতো জবাব দিয়েছে৷ শুধু তাই নয়, সবাইকে কেন ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে, কেন ইচ্ছেটা সবার একরকম হবে, এসব নিয়ে দীর্ঘদিনের জমে থাকা মনের কথা এতদিনে বেরিয়ে এল মনে হল৷ ছকবন্দি কৃত্রিম ইচ্ছেগুলো যে আর বহন করা যাচ্ছে না, সেই বার্তাই যেন সৌমদীপের কথায় সোচ্চার হয়ে উঠেছে৷

আসলে আমরা অতীতে বাস করলেও দৃষ্টি থাকে ভবিষ্যতে৷ এজন্য জন্মানোর পর থেকেই নয়, তার অনেক আগে থেকেই শুধু বাবা-মা থেকে আত্মীয়স্বজনের অনেকের মধ্যেই নব্জাতকের ভবিষ্যতে নিজের স্বপ্নপূরণের সদিচ্ছা জেগে ওঠে৷ সেখানে কল্পনার লাগামহীন চলনে কোনো স্থিরতা নেই৷ এজন্য শৈশবেই ‘বড় হয়ে তুমি কী হতে চাও’ থেকে ছাত্রজীবনে ‘তোমার জীবনের লক্ষ্য কী’র প্রতিই প্রশ্নকর্তার কৌতূহলী অন্তর্দৃষ্টি সার্চলাইট হয়ে ওঠে৷ কারও ভবিষ্যৎ জেনে নেওয়ার অদম্য কৌতূহলের মধ্যে যেমন মানসিকতা বুঝে নেওয়ার সদিচ্ছা থাকে, তেমনই তার লক্ষ্যের মিলিয়ে দেখার বাতিক ভর করে৷ সেখানে যোগ্যের উৎকর্ষ বিচারে বাছাইয়ের আভিজাত্য স্বাভাবিক মনে হয়৷ তাতে আবার কৃতিত্ব জাহিরের আয়োজনে কৃত্রিমতা অনিবার্য৷ সায়েন্স পড়লেই পড়াশোনায় ভালো, মানেই তার ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ারের লাইন পাকা, বা আর্টস বা কমার্স নিয়ে পড়া মানে মধ্যমেধা বা সাধারণ মানের ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষকতার চাকরির অভ্যস্ত ছকের বাইরে কেউ আর তেমন ভাবতেই পারে না৷ সেখানে কেউ ব্যতিক্রমী হলেও হয় সন্দেহ, নয় ব্যঙ্গের খোরাক হয়ে ওঠে৷ সায়েন্সে রেজাল্ট ভালো হলেও যে আর্টস নিয়ে পড়তে চায়, তার ইচ্ছেটাই তখন গোলমেলে মনে হয়৷ তার সায়েন্সের কমজুরি বা দুর্বলতাই সন্দেহের আধার হয়ে ওঠে৷ আবার আর্টসের ভালো ছাত্র কমার্স বা সায়েন্সে পড়ার কথা ভাবতেই পারে না৷ মেধার সঙ্গে বিষয়ের যোগ এতই নিবিড় এবং আভিজাত্যমুখর, সেখানে ইচ্ছে প্রকাশের পথটাই হারিয়ে যায়৷ শুধু তাই নয়, পেশার আভিজাত্যের সঙ্গে কৃতিত্বের সংযোগ এতই সুদৃঢ় যে, কেউ আর ভিন্ন মত প্রকাশ করে লোকের কাছে ছোট হতে চায় না৷ সেখানে শিক্ষকতার মহৎ পেশার কথা আকছার শোনা যেত আগে, এখনও শোনা যায়৷ সেখানে পেশা হিসাবে ডাক্তারের পরেই ইঞ্জিনিয়ার দড়৷ স্বাভাবিক ভাবেই শিক্ষকতার আদর্শ যাইহোক, বেতনবৃদ্ধির পরে শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছে আপনাতেই বেড়ে যায়৷ আগে ছিল, যার নেই কোনো গতি, সে করে পণ্ডিতি৷ এখন মেয়ের বাবার কাছেও স্কুল মাস্টারের কদর সমাদরে ঠেকে৷ এখন আবার দুর্নীতির ফেরে পড়ে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্নটাই চুরি হয়ে গেছে৷ উনিশ শতকে উকিল আর ডাক্তাদের পসার ছিল ভালো৷ বিশ শতকেও সেই ধারা অক্ষুণ্ণ থাকলেও উকিলের প্রতি আগ্রহ কমে যায়, ডাক্তারের শ্রীবৃদ্ধি বাড়তেই থাকে৷ সেদিক থেকে সায়েন্সের কৃতী ছাত্রদের ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছেই কৃতিত্বের পরিচয়বাহী মনে হয়৷ সেই পরিচয়কে সরিয়ে রেখে কেউ রাশিবিজ্ঞানী হতে চাইলে সে তো শুধু আমাদের বিদ্যাচর্চারই লাভই নয়, সবচেয়ে বেশি মানবসম্পদ তা থেকেই আসবে৷ সৌমদীপ তার মনের কথা বলে প্রত্যেকের স্বতন্ত্র ইচ্ছের কথা বলে দিয়েছে৷ সেই ইচ্ছে তো কাউকে তুষ্ট বা পুষ্ট করার জন্য নয়, যাতে কেউ মনের মতো করে সবচেয়ে সেরাটা উজাড় করে দিতে পারে, তা তার সদিচ্ছার প্রকাশ৷ সেখানে কাউকে খুশি করতে গিয়ে নিজের ইচ্ছেকে জলাঞ্জলি দিলে আখেরে শুধু ইচ্ছেরই মৃতু্য ঘটে না, চাপিয়ে দেওয়া বিষয় দুর্ভার হয়ে ওঠে৷ সেখানে সবার প্রতিভা একরকম নয়, কাজের বিস্তৃতিও বৈচিত্রময়, সকলের ইচ্ছেও স্বতন্ত্র৷

আসলে আমাদের গড়ে তোলা ধারণার মধ্যে ফাঁক ও ফাঁকি অন্তহীন৷ প্রথমত, দারিদ্রপীড়িত দেশে পেশার দায় স্বাভাবিকভাবেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে৷ সেখানে প্রথমেই বিষয়াসক্তের ক্ষিদে মেটাতেই মনের ইচ্ছেগুলো নিঃস্ব হয়ে পড়ে৷ যাতে দ্রুততার সঙ্গে দারিদ্রমুক্ত হতে পারে সেদিকেই তার দৃষ্টি অন্তর্দৃষ্টি লাভ করে৷ মোটা মাইনের চাকরি যেখানে সমাদর পায়, সেখানে নিদেনপক্ষে সরকারি চাকরিতে সামাজিক প্রতিষ্ঠা বড় হয়ে ওঠে৷ সেখানে স্বাভাবিক ভাবেই পড়াশোনার লক্ষ্যে সরকারি চাকরির দিকে সতৃষ্ণ দৃষ্টি মুখিয়ে থাকে৷ ভালো রেজাল্টের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার চেয়ে সেই ক্ষুধা নিবারণের স্বপ্নই জেগে ওঠে৷ দ্বিতীয়ত, ছোটবেলা থেকে নিরন্তর বড় হয়ে ওঠার কথায় যেখানে বড় লোক হয়ে ওঠার টীকা দেওয়া দেওয়া হয়, সেখানে নিজের মতো করে বড় মানুষ হওয়ার স্বাদ ও স্বপ্ন অচিরেই ব্রাত্য হয়ে পড়ে৷ স্বাভাবিক ভাবেই ইচ্ছেডানায় ভর করে চলার চেয়ে অনিচ্ছেয় চাকরির লক্ষ্যেই উচ্চশিক্ষা পুঁজি হয়ে ওঠে৷ তৃতীয়ত, চাকরির মধ্যে জীবন খুঁজতে গিয়ে মনের ইচ্ছেগুলোকেই প্রথমে অস্বীকার করতে হয়৷ ভালো ছাত্র প্রমাণ করতে যেমন সায়েন্সে পড়ার বাতিক ভর করে, তেমনই সায়েন্সে পড়লেই জয়েন্ট দিয়ে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছে না থাকলেও কৃতিত্ব প্রকাশে মুখর হতে হয়৷ অথচ কোনোটাই যুক্তিসঙ্গত তো নয়, উল্টে কৃতিত্ব প্রমাণের দায়ের দায়ে জীবনটাই অচল অসার হয়ে ওঠে৷ যেকোনো বিষয়ে সর্বোচ্চ রেজাল্ট ও যথাযথ শিক্ষা লাভ বা জ্ঞান অর্জন করলে সব বিষয়েই কর্মসংস্থানও মেলে, কৃতিত্বেও খ্যাতি ছড়ায়৷ শুধু তাই ন্য, সেখানে বিষয়ের চেয়ে বিষয়ীর গুরুত্ব অধিক৷ সেখানে কে কীভাবে বিষয়টি দেখছে বা নিচ্ছে, তা তার নিজস্ব চিন্তাভাবনা থেকে উঠে আসা উচিত৷ বাংলা নিয়ে পড়লেও একজনের সঙ্গে অন্যজনের ইচ্ছে বা লক্ষ্য এক হতে নাও পারে৷ অথচ বিষয়টির চাকরির বাজারের চাহিদায় ভালোমন্দের রকমফেরে চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতায় শিক্ষার্থীর অনিচ্ছায় বিষ হয়ে উঠতে পারে৷ আরও একটি জরুরি বিষয় মারাত্মক মনে হয়৷ চাকরি লক্ষ্যে উচ্চশিক্ষার বুনিয়াদি চেতনাতেই মনের ইচ্ছের ডানা মেলতে পারে না৷ সেখানে প্রতিভা প্রকাশের আলো কর্মক্ষেত্রের সীমায় বন্দি থেকে যায়৷ নিজের মতো বিস্তারের চেতনাই সেখানে আলোহীন৷ অর্থাৎ ছোটবেলা থেকে ইচ্ছের অস্থিরতায় পরিবর্তন যেমন স্বাভাবিক, তেমনই তার পরিণতির অপমৃতু্যও অস্বাভাবিক নয়৷ সেখানে ইচ্ছে পূরণে পড়াশোনা নয়, বরং স্বেচ্ছায় স্বপ্নকে হত্যা করে বড় হওয়ার দুঃস্বপ্ন তাড়া করে, জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ৷ অর্থাৎ মনের মতো পড়াশোনা নয়, পড়াশোনার মতো মন করতে হয়৷ আবার সেই পড়াশোনার লক্ষ্যেই থাকে ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য কর্মসংস্থানের তীব্র চাহিদা৷ আর সেখানেই গড়ে ওঠে আত্মপ্রতিষ্ঠার চেয়ে সামাজিক প্রতিষ্ঠার নিবিড় হাতছানি৷ সামাজিক প্রতিষ্ঠাই হয়ে ওঠে আত্মপ্রতিষ্ঠার নামান্তর৷ সেখানে শিক্ষক-ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারের ছকবন্দি জীবন বড় কামনার, বড় আকাঙ্ক্ষার৷ জীবনের লক্ষ্য সেখানেই আবর্তিত হয়৷ তার বাইরে কবি-সাহিত্যিক, গায়ক-নায়ক, বা চিত্রশিল্পী-খেলোয়াড়- অভিনেতা বা সাংবাদিক প্রভৃতি হওয়ার ইচ্ছে জাগতেই পারে না, জাগলে অস্বাভাবিক মনে হয়৷ সেখানে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘অমলকান্তি’ কবিতার অমলকান্তির মতো কেউ রোদ্দুর হওয়ার কথা আজও কারও মনে আসে না৷ অমলকান্তির সহপাঠীদের মতো কেউ ডাক্তার, কেউ শিক্ষক, কেউ উকিল হতে চায় এখনও৷ শুধু অমলকান্তি ‘সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল!’ সেই রোদ্দুর তো আলোর প্রকাশ৷ কৃতীদের সেই ইচ্ছেগুলো্কে হারিয়েই সামাজিক প্রতিষ্ঠা মেলে, প্রতিভা প্রকাশের আলো তার অধরা মাধুরী৷ সৌমদীপের ইচ্ছে ব্যতিক্রমী নয়, সেটাই স্বাভাবিক৷ সে শুধু সাহস করে বলতে পেরেছে৷ অমলকান্তির রোদ্দুর হওয়ার কথা এখনও কেউ কল্পনা করতে পারে না! সে সৎসাহস এখনও আমরা অর্জন করতে পারিনি!