• facebook
  • twitter
Saturday, 23 November, 2024

১২৫তম জন্মবর্ষে বনফুল, রবীন্দ্রনাথের ‘ছোট ছোট দুঃখ কথা’র মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ ছিলেন তিনি

ধ্রুবজ্যোতি মন্ডল বনফুলের লেখার প্রতি আকর্ষণ বাডে় ওঁর ছোটভাই চিত্রপরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয়ের পর থেকে৷ সেটা সম্ভবত ২০০১ সাল৷ একটি সাহিত্য পত্রিকার তরফে সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে জমিয়ে আড্ডা হয়েছিল৷ ভীষণ প্রাণ খোলা মানুষ৷ হই হই করে কথা বলেন৷ গল্প করেন৷ দাদা বনফুলের প্রসঙ্গ উঠতেই বললেন, আমাদের ছয় ভাই দুই বোনের মধ্যে সবচাইতে বড় ছিলেন

ধ্রুবজ্যোতি মন্ডল

বনফুলের লেখার প্রতি আকর্ষণ বাডে় ওঁর ছোটভাই চিত্রপরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয়ের পর থেকে৷ সেটা সম্ভবত ২০০১ সাল৷ একটি সাহিত্য পত্রিকার তরফে সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে জমিয়ে আড্ডা হয়েছিল৷ ভীষণ প্রাণ খোলা মানুষ৷

হই হই করে কথা বলেন৷ গল্প করেন৷ দাদা বনফুলের প্রসঙ্গ উঠতেই বললেন, আমাদের ছয় ভাই দুই বোনের মধ্যে সবচাইতে বড় ছিলেন এক দিদি৷ তারপরেই বনফুল৷ আর আমি সবার ছোট৷ ফলে বয়েসের ফারাক ছিল অনেকটাই৷ তাও কুডি় বছরের তফাৎ হবে৷ তাই বড়দা আমার বাবার মতোই ছিলেন৷ আমার অভিভাবক৷ বিয়ে দিয়েছেন উনি৷ শান্তিনিকেতনে পড়তে যাওয়া, গুরুদেবকে কাছে পাওয়া সব দাদা বনফুলের সৌজন্যে৷ শুধু তাই নয় ডাক্তারি পড়া ছেডে় সাহিত্য নিয়ে মেতে ওঠা এবং শেষে দাদার লেখা গল্প-উপন্যাস নিয়ে একের পর এক ছবি করা ওঁর প্রশ্রয় ছাড়া সম্ভব ছিল না৷ বলতে গেলে, এমনই মানুষ ছিলেন বনফুল অর্থাৎ বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়৷ সেসময় বিহারের মনিহারি গ্রামের মুখোপাধ্যায়রা ছিলেন বেশ সম্ভ্রান্ত পরিবার৷ ‘কাঁটাবুনে’ মুখুজ্জে নামে পরিচিত ছিলেন৷ ওখানেই কেটেছে তাঁর ছোটবেলা৷ বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়ানোর কারণে নাকি তাঁর আর একটি নাম জুটেছিল বনফুল৷ পরবর্তীকালে ওই নামটাই পেন নেম হয়ে যায়৷ তখনকার দিনে স্কুল পড়ুয়া ছেলে লেখালিখি সাহিত্যচর্চা করুক এটা মাস্টারমশাইরা ভালো চোখে দেখতেন না পড়াশোনায় বিঘ্ন ঘটবে বলে৷ কিন্ত্ত ১৯১৫ সালে সাহেবগঞ্জ স্কুলে পড়ার সময় বনফুলের প্রথম কবিতা ‘মালঞ্চ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়৷ এরপর ‘প্রবাসী’ ও ‘ভারতী’-তে তাঁর কবিতা ছাপা হয় বনফুল ছদ্মনামে হয়তো শিক্ষকদের নজর এড়াতেই৷ তবে বনফুল সবসময়ই তাঁর লক্ষ্যে স্থির থেকেছেন৷

১৯১৮-তে ম্যাট্রিক ও হাজারীবাগ সেন্ট কলম্বাস কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করে ডাক্তারি পড়তে আসেন কলকাতা মেডিকেল কলেজে৷ পরে পাটনা মেডিকেল কলেজ থেকে ১৯২৭ সালে ডাক্তারি পাশ করে ভাগলপুরে প্যাথলজিস্ট হিসাবে চল্লিশ বছর কাজ করেন৷ এবং এরই পাশাপাশি চলতে থাকে তাঁর সাহিত্যকর্ম৷ মূলত মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময় তাঁর লেখা ছোটগল্পগুলি পাঠক মহলে বেশ জনপ্রিয়তা পেতে থাকে৷ প্রথম উপন্যাস ‘তৃণখণ্ড’ ডাক্তারি জীবনের গোড়ার দিকে লেখা৷ কলেজ জীবনে সহপাঠী পেয়েছিলেন কবি অমিয় চক্রবর্তী এবং ঔপন্যাসিক সরোজকুমার রায়চৌধুরীকে৷ এরই সঙ্গে সাহিত্যসাধনায় প্রধান প্রেরণাদাতা ছিলেন সাহেবগঞ্জের বটুকদা অর্থাৎ সুধাংশুশেখর মজুমদার৷ আর মেডিক্যাল কলেজে মাস্টারমশাই হিসাবে পান ব্যঙ্গরচনার গুরু ডা. বনবিহারী মুখোপাধ্যায়কে৷ তাঁর জীবনকে ভিত্তি করে বনফুলের উপন্যাস ‘অগ্নীশ্বর’ রচিত হয়েছিল ১৯৫৯ সালে৷ এবং এই উপন্যাস আজও প্রবীণ বাঙালি হূদয়কে আচ্ছন্ন করে রেখেছে তার প্রধান কারণ তার উপাদানে নির্মিত হয়েছে দু-দুটি ছবি৷ তরুণ মজুমদার পরিচালিত ‘আলোর পিপাসা’ ও অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘অগ্নীশ্বর’, উপন্যাসের নামেই৷
আসলে ‘অগ্নীশ্বর’ শাখাপ্রশাখায় পল্লবিত একটি দীর্ঘ উপন্যাস৷ এর আখ্যান-উপাদানকে মোটামুটি দু’ভাগে ভাগ করা যেতে পারে৷ একভাগে বিবিধ বৈপরীত্যে তৈরি ডাক্তার অগ্নীশ্বর মুখোপাধ্যায়ের আপোষহীন বেপরোয়া মনোভাব, ক্রোধ, মর্মভেদী ব্যঙ্গতীক্ষ্ণ তীব্রতা, কটু কথা— অথচ অন্তরঙ্গে লালিত এক সংবেদনশীল মন৷ টুকরো টুকরো বিভিন্ন ঘটনার এবং দুর্ঘটনার মধ্যে দিয়ে পাঠক সমক্ষে চরিত্রটিকে এনে হাজির করেছেন বনফুল৷ অতীব উপভোগ্য সে উপস্থাপন৷

উপন্যাসের অন্য ভাগে অগ্নীশ্বরের স্মৃতিকথনে উঠে এসেছে পঞ্চকন্যার উপাখ্যান৷ অহল্যা, দ্রৌপদী, কুন্তি, তারা বা মন্দোদরী নন৷ এঁদের নাম সুছন্দা, পদ্মাবতী, সরমা, রৌশনআরা, আর সরস্বতী৷ এই পঞ্চকন্যার অন্যতমা রূপোপজীবিনী রৌশন, যাঁকে ঘিরে তরুণ মজুমদারের চলচ্চিত্র ‘আলোর পিপাসা’৷ এই ছবি মুক্তি পায় ১৫ জানুয়ারি ১৯৬৫৷ অন্যদিকে ‘অগ্নীশ্বর’ মুক্তি পায় ১৯৭৫ সালে৷ ‘অগ্নীশ্বর’ ছবিটিতে অগ্নীশ্বর চরিত্রটি বিবিধ অভিজ্ঞতার সমাহারে নির্মিত হয়েছিল৷ এখানে অভিনয় করেছিলেন উত্তমকুমার৷ আর তরুণ মজুমদারের ছবিতে অগ্নীশ্বর সেজেছিলেন পাহাডি় সান্যাল৷ ছোটগল্প, নাটক, উপন্যাস, কাব্য সকল রচনাতেই তিনি সমান দক্ষ ছিলেন৷ প্রায় শতাধিক গ্রন্থের লেখক৷ উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে আছে স্থাবর, জঙ্গম, মন্ত্রমুগ্ধ, হাটেবাজারে, কিছুক্ষণ, বিন্দু বিসর্গ, দ্বৈরথ, ভীমপলশ্রী, শ্রীমধুসূদন, বিদ্যাসাগর প্রভৃতি৷ ‘পশ্চাৎপট’ তাঁর আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থ৷ পক্ষিজগৎ নিয়ে তিন খণ্ডে সম্পূর্ণ ‘ডানা’ উপন্যাসে তাঁর অগাধ অধ্যয়ন এবং পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়৷

তাঁর লেখা রবীন্দ্রনাথ খুব পছন্দ করতেন৷ নানা চরিত্র থেকে রকমারি অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের সুযোগ মেলে তাঁর লেখায়৷ এই যেমন ‘কিছুক্ষণ’ রেল স্টেশনের কয়েক ঘণ্টার গল্প৷ সত্যিই কিছুক্ষণের গল্প৷ কিন্ত্ত এখানে বাস্তববাদী প্রতিরূপায়ণের একটা মজা আছে৷ মেডিক্যাল কলেজের একজন হাউস সার্জেন দেশের বাড়ি থেকে কলকাতা যাওয়ার পথে তার নিকটবর্তী রেল স্টেশনে গিয়ে এক আশ্চর্য ঘটনার মধ্যে জডি়য়ে পডে়৷ স্টেশনে একটি এক্সপ্রেস ট্রেন সিগন্যাল না পেয়ে দাঁডি়য়ে৷ সেই ট্রেনের যাত্রীদের অনেকের সঙ্গেই তার পরিচয় হয়৷ এই মানুষদের মধ্যেকার লোভ, মহত্ত্ব, উদারতা, নীচতা ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে মানুষগুলির মনের পরিচয় পায়৷ ‘হাটেবাজারে’-র কাহিনীতে একজন চিকিৎসক মানুষের সেবায় নিয়োজিত৷ অবসর জীবনে মানুষের সেবার জন্য তিনি ভ্রাম্যমান চিকিৎসা কেন্দ্র নিয়ে হাটেবাজারে উপস্থিত হতেন৷ এবং বিনামূল্যে মানুষের সেবা করতেন৷

ছোটগল্প কী, কেন, কেমন সেটা তো রবীন্দ্রনাথ তাঁর এক কবিতায় আমাদের বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন৷ আর রবীন্দ্র পরবর্তী সময়ে যাঁরা আমাদের ছোটগল্পের ভাণ্ডার আরও সমৃদ্ধ করেছেন বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় তাঁদের অন্যতম৷ তিনিও যে রবীন্দ্রনাথের ‘ছোট ছোট দু্ঃখ কথা…’ বা ‘শেষ হইয়াও হইলনা শেষ’ মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ ছিলেন৷ স্বল্প কথায় তাঁর গল্পগুলোয় মানবজীবনের করুণ অভিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন৷ ছোটগল্পে তাঁর জীবনদৃষ্টির শিল্প চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়৷ তিনি ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী ছিলেন৷ তাঁর জীবন সম্পর্কে অতীন্দ্রিয় মোহ ছিল না৷ যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা যতটুকু জেনেছেন ততটুকুই লিখে গেছেন৷ বনফুলের ব্যক্তিত্ব সুষ্ঠু বলিষ্ঠ জীবন থেকে উদ্ভুত হয়েছে নতুন নতুন মানুষের জীবন কথা৷ অন্যায় ও পাপাচারের প্রায়শ্চিত্ত, ন্যায়দণ্ড, দুর্নীতি ও অনাচারের বিরুদ্ধে বিবেককে গল্পের ভাষায় বিস্তার করেছেন৷ শুধু গল্প উপন্যাস নয়, কবিতাও লিখেছেন সহস্রাধিক৷ আর ব্যঙ্গ কবিতা লেখার অভ্যাস তো ছোটবেলা থেকেই ছিল৷ বনফুল আর একটি কাজ করেছিলেন৷ ১৯৭১ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত তাঁর প্রতিদিনের দিনলিপি লিখতেন ‘মর্জিমহল’ শিরোনামে৷ বালক বয়েসে কবিতা নিয়ে যখন লেখালিখি শুরু হয় তখন একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল৷ তখন তিনি বিহারের সাহেবগঞ্জ রেলওয়ে হাইস্কুলে পডে়ন৷ ছাত্র শিক্ষকদের কাছে খুবই পরিচিত মুখ৷ ‘মালঞ্চ’ ও ‘বিকাশ’ পত্রিকায় তাঁর দুটো কবিতা প্রকাশিত হল৷ সবাই খুশি৷ ব্যতিক্রম একজন৷ স্কুলের হেডমাস্টারমশাই৷ তাঁর ধারণা কবিতা লিখেই বিগডে় যাচ্ছে ছেলে৷ সংস্কৃতে নম্বর কম পাচ্ছে৷ তাই নির্দেশ— এর কবিতা লেখা চলবে না৷ এবার কী হবে? অবশেষে ছদ্মনামের আশ্রয়৷

বনফুল কিন্ত্ত খুব আনন্দপ্রিয় মানুষ ছিলেন৷ মজলিসী আড্ডায় ও ভোজন রসিকতায় তাঁর নাম ছিল৷ কেমন খাইখাইয়ে লোক ছিলেন তা চলচ্চিত্র পরিচালক তরুণ মজুমদার বলেছিলেন৷ ১৯৬৩-তে ‘পলাতক’ সুপার-ডুপার হিট হল৷ তারপর একদিন মিসেস সেন অর্থাৎ সুচিত্রা সেন তাঁর নীল রঙের ইমপালা চেপে নিজেই একদিন হাজির হলেন তরুণ মজুমদারের অফিসে৷ সঙ্গে নিয়ে এলেন সোনার ফ্রেমের চশমা, সিল্কের পাঞ্জাবিতে হীরের বোতাম লাগানো তখনকার দিনে নামজাদা প্রযোজক প্রেমচাঁদ আড্ডিকে৷ যিনি বাণিজ্য-সফল ‘হসপিটাল’ (১৯৬০), ছবির প্রযোজনা করেছেন৷ প্রেমচাঁদবাবু ছবি করাতে চান তরুণ মজুমদারকে দিয়ে৷ তখনো গল্পই বাছা হয়নি৷ অথচ ভদ্রলোক একেবারে এগ্রিমেন্ট পেপার নিয়ে হাজির৷ সঙ্গে পাঁচ হাজার টাকার চেক৷ ক’দিন পরেই একটা গল্প মনে ধরে গেল তনুবাবুর৷ বনফুলের লেখা ‘অগ্নীশ্বর’৷ পুরোটা নয়৷ তার থেকে নির্বাচিত একটা অংশ৷ বনফুল থাকেন ভাগলপুরে৷ চিঠি লিখে জানার চেষ্টা হল কবে তনুবাবুরা যেতে পারেন৷ উত্তর এলো আসবার দরকার নেই৷ অমুখ তারিখে উনি দুর্গাপুরে থাকবেন৷ ওখানেই দেখা হবে৷ প্রেমবাবুর ‘রোভার’ গাডি়৷ দৌড়োয় বাঘের বাচ্চার মতো৷ দুর্গাপুরের এ-রাস্তা ও-রাস্তায় লাট খেতে খেতে শেষে হাজির হওয়া গেল৷ ঘডি়তে তখন সোয়া বারোটা৷ বনফুল বসে আছেন বাইরের ঘরে৷ আদুর গায়ে৷ পরনে ধুতি৷ নিজেই নিজের শরীরে ইঞ্জেকশনের ছুঁচ ফোটাচ্ছেন৷ কিছু বলবার আগেই বলে উঠলেন, তরুণ তো? এসো এসো৷ যেন কতো দিনের চেনা৷ তারপর ভিতর বাডি়র দিকে চেয়ে হাঁক মারলেন, ‘বলি শুনছ! তরুণরা এসে গেছে—’
একটু পরে ভদ্রমহিলা ঢুকলেন৷ পায়ের ধুলো নিয়ে তনুবাবু জিজ্ঞেস করলেন, উনি যে ইঞ্জেকশন নিচ্ছেন, কী জন্যে?

আর কী জন্যে! হাই সুগার৷ এবার শরবৎ এলো৷ সঙ্গে হরেকরকম মিষ্টি৷ সবেমাত্র একটা তুলে মুখে পুরতে যাবেন তনুবাবু, সঙ্গে সঙ্গে ধমকানি৷ কী খুঁটে খুঁটে একটা একটা করে তুলছো? তুলতে হয় এমনি করে৷ কেমিস্ট্রির ল্যাবরেটরিতে ডিমনস্ট্রেটার যে ভঙ্গিতে ছাত্রদের শেখান সেই কায়দায় ঝপ করে গোটা চারেক কড়াপাকের সন্দেশ প্লেট থেকে তুলে নিয়ে এক কামডে় আধখানা শেষ করে দিলেন৷ তরুণবাবু আঁতকে উঠে যেই বলতে গেছেন— ‘এ কী? আপনার না—’ উনি বললেন, ‘ধুৎ! সন্দেশ খেলে কী হয়? আমি নিজেই তো ডাক্তার৷ সন্দেশে কত প্রোটিন জানো?’ বলে বাকি আধখানা সোজা মুখের ভিতর৷ খাওয়াদাওয়ার সঙ্গে গল্পগুজব চলতে লাগল৷ কাজের কথা তুললেই বলেন, ‘আরে হবে, হবে৷ তাড়া কিসের৷ সময় কাটতে লাগল৷

এ-কথা  সে-কথা৷ বেলা যখন প্রায় দুটো, ভিতর বাডি় থেকে মূর্তিমান বিভীষিকার মতো এসে পৌঁছলো দুটি প্রকাণ্ড সাইজের ফুলকাটা পিতলের থালা৷ সঙ্গে অগুনতি বাটি৷ পর্বতপ্রমাণ ঘি-ভাত৷ দু’রকমের মাংস৷ পাকা রুইয়ের কালিয়া৷ ভাজাভুজি, ডাল, ডালনা, চাটনি, পাঁপড়, জমাটি ক্ষীর ইত্যাদি ইত্যাদি৷ —‘এগুলো কী?’ আঁতকে উঠে প্রশ্ন করা মাত্র উত্তর এলো, ‘একদম কথা না বলে চেটেপুটে সাফ করে দাও সব৷’
তনুবাবু বললেন, ‘কী বলছেন? এ কি সম্ভব? পারব না কিছুতেই—’
—‘তাহলে গল্পের রাইটও পাবে না৷ যেখান থেকে এসেছ সেখানে ফিরে যাও৷’ গল্পের স্বত্ব পাবার জন্যে বেলা চারটে পর্যন্ত অপেক্ষা করে, খিদে বাডি়য়ে তারপর কাজ হাসিল হল৷ বনফুল নিজে যেমন খেতে ভালোবাসতেন তেমন খাওয়াতেও তাঁর জুড়ি মেলা ভার৷

দীর্ঘ লেখক জীবনে বহু স্বীকৃতি, পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছেন৷ রবীন্দ্র পুরস্কার, জগত্তারিণী পদক, ভাগলপুর ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি.লিট উপাধি লাভ করেন৷ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি ছিলেন৷ এছাড়াও আরও বহু সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন তিনি৷

১৯৬৮ সালে ভাগলপুর থেকে পাকাপাকি ভাবে তাঁর কলকাতা চলে আসা৷ ফেরার দিন গোটা ভাগলপুর স্টেশনে তাঁকে বিদায় জানাতে এসেছিল৷ দিন যে আস্তে আস্তে ফুরিয়ে আসছে সেটা তিনি বুঝতে পারছিলেন৷ শেষ উপন্যাসে লিখে গিয়েছিলেন, ‘আমি আর ফিরব না৷ তোমরা যন্ত্র-সভ্যতার বিলাসে সুখে থাকো৷’ কিন্ত্ত এই আধুনিক সময়েও তিনি আমাদের কাছে ফিরে ফিরে আসেন তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে৷ ১৮৯৯ থেকে ১৯৭৯— একশো পচিঁশ বছরেও তিনি যেন আমাদের কাছের মানুষ হয়েই আছেন৷